আমার ছোট পুতুর বয়স আর দুইদিন পর সাত মাস হবে। ওর চিন্তা ভাবনা আমি কিছুটা বুঝতে পারি। ওর চিন্তা হল- বাবা র বসা বা শোয়ার দরকার কি? সারাক্ষণ আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটলেই ত হয়। আমি ছোট পুতুকে বুকের সাথে চেপে ধরে অজস্র চুমু খেতে খেতে মনে মনে বলি- হে ছোট পুতু তোমাকে পালা বড় কষ্ট। কিন্তু তুমি আছ বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। ছোট পুতু আমার মনের কথা বুঝতে পারে, তাত তাত তাত থা আ আ... বলে বুঝিয়ে দেয়- বাবা তোমার কথা ঠিক আছে!
বড় পুতু ততক্ষণে রাগ করে ফেলেছে। বাবা শুধু ‘ছোটইয়া’ কে আদর করে,আমাকে করেনা! একসাথে বড় টাকেও কোলে নিতে হয়। বড় টা তখন হাসি মুখে বলে-বাবা বাবা মটর সাইকেলে চড়ব বাবা!
আমি তখন হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার পেটের উপর আমার দুই পুতু বসে। আমার দুই হাত হয়ে যায় মটর সাইকেলের হ্যান্ডেল। মুখ দিয়ে শব্দ করি- ব্রো, ব্রো ও ও ও ও ও ম ম ম... দুই পুতুর আনন্দিত মুখ দেখে মনে হয় তারা সত্যি সত্যি মটর সাইকেল উড়িয়ে কোথাও যাচ্ছে! সেই মুহুর্তে ক্ষণিকের জন্য আমি হিংসা, ঈর্ষা, লোভ, ইগো হীন একটা মহাপুরুষে পরিণত হই। কারন সেই মুহুর্তে আমি পরিপূর্ন সুখী মানুষ। আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।
দুঃখী অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্ক কখনো পরিপূর্ন ভাবে কাজ করে না। কারণ মস্তিষ্কের বড় অংশ সেই দুঃখ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পৃথিবীর সব সেরা আবিষ্কার সুখী মস্তিষ্কের আবিষ্কার। এটা জানি বলেই আমার জীবনের পরিপূর্ন সুখী মুহুর্ত গুলোতে আমি আমার মন কে কিছু না কিছু প্রশ্ন করি। যেমন সেদিন প্রশ্ন করলাম- আচ্ছা আমার পুতু দের যে আমি এত ভালোবাসি, আমি কি করলে বুড়া কালে যখন আমার পুতুরা আমার উপর নির্ভরশীল থাকবে না তখন আমাকে সম পরিমাণ ভালবাসবে?
সুখী মস্তিষ্ক আমার প্রশ্নের জবাবে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল- আগে বল, তোমার বৃদ্ধ বাবা মা কি তোমার চেয়ে গরিব?
আমি যা বুঝার বুঝতে পারলাম!
নিজের বৃদ্ধ বাবা মা কে নিজের চেয়ে গরিব রেখে বাচ্চা কাচ্চা কে যতই আদর করি না কেন, তাদের পেছনে যত টাকাই ঢালি না কেন, তাদের কে যতই উচ্চ শিক্ষা দিই না কেন, যতই আদব কায়দা শিখাই না কেন, আমার জন্য ফলাফল শূন্য। তারাও বড় হয়ে তাদের ছেলেমেয়েকেই ভালবাসবে। আমাকে ভালবাসবে না।
এই জিনিষ টা মাথায় আসার পর মনে মনে নিজের জন্য একটা ‘কুলাঙ্গার মিটার’ কল্পনা করে নিলাম। প্রতিদিন রাতে শুয়ে ঘুমানোর আগে বন্ধ চোখের সামনে কাল্পনিক কুলাঙ্গার মিটার টা ধরব। কুলাঙ্গার মিটারে র ডায়াসে ঠিক মাঝখান টায় শূন্য। ডান পাশে প্লাস। বাম পাশে মাইনাস।
মনের চোখে কুলাঙ্গার মিটারের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করব- আমার মা( বাবা মারা গেছে) কি আমার চেয়ে গরিব?
প্রশ্নের জবাবে কুলাঙ্গার মিটারের কাঁটা নড়বে।
ঘুমাতে যাবার আগে প্রতিদিন নিজের ‘কুলাঙ্গার লেভেল’ টা দেখে নেব।