সকাল সাড়ে দশটা। ধানমন্ডি এলাকায় হাঁটছি। বাসা খুঁজে এদিক সেদিক যাচ্ছি। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিনা কোনভাবেই। এরকম একটা বিরক্তিকর অবস্থায় রোদের মধ্যে হেঁটে বেড়াতে কার ভালো লাগে? রোদটা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বাসাটা কোনভাবেই খুঁজে পাচ্ছিলামনা। বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই সবাই ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখছে। এমন কোন ঠিকানা ধানমন্ডি এলাকায় আছে কি না সে বিষয়ে মানুষজনের চোখে-মুখে একটা সন্দেহ ফুটে উঠছে। যাক মানুষের সাহায্য ছাড়াই অবশেষে খুঁজে পেলাম বাড়ীটা। বাড়ীটা ধবধবে সাদা। আমার প্রিয় রং লাল, কিন্তু, বাড়ীর রঙের বেলায়, অবশ্যই আমার প্রথম পছন্দ সাদা। আর ধবধবে সাদা হলে তো কথাই নেই। একটু বলে নেই আমি যাঁর বাড়ী খুঁজছি, উনি বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। ওনাকে 'ভদ্রলোক' বলেই সম্বোধন করবো। আমার অফিসের খুব জরুরী কিছু কাগজ পৌঁছিয়ে দেয়াই আমার লক্ষ্য। যাই হোক, বাড়ীর মূল ফটকে বসে আছে একজন রক্ষী। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোক বাসায় আছেন কি না। রক্ষীর প্রথম প্রশ্ন আমি কে? আমার পরিচয়ের পর্ব ঝটপট সেরে ফেলতেই আমাকে ভেতরে যেতে দেওয়া হলো। ও মা। ভেতরে গিয়ে দেখি দ্বিতীয় রক্ষী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকেও পুনরায় আমার পরিচয় দিলাম। উনি মুচকি হেসে আমাকে বললেন সোজা চারতলায় উঠে যেতে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা চারতলায় উঠে আসলাম। একটা কলিংবেলের সুইচ দেখে চাপ দিতে যখনই আমি উদ্যত, তখনই খটাস শব্দে দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দু'জন মানুষ। বলাবাহুল্য, এরাও রক্ষী, কিন্তু ইউনিফর্মহীন। আগেরবারের দু'জন কিন্তু ইউনিফর্মওয়ালা রক্ষী ছিলেন। এই দুজনের মুখে গদগদ হাসি। কি আজব অবস্থা! আমার চেহারাতে কোন সমস্যা হয়েছে কি না জানিনা, এরা আমাকে দেখে এভাবে হাসছে কেন? তাদের সেই হাসির সায়স্বরুপ আমাকেও খানিক ফিকে হাসি দিতে হলো। আমাকে ভেতরে নিয়ে বসানো হলো। যেই কামরায় আমাকে বসানো হলো, তার পুরোটা জুড়েই অজস্র কিতাব, মানে বই। এত বই যে মাথা ঘুরে যাবার মত কারবার। বসে আছি। গৌতম বুদ্ধের একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। বেশ পুরোনো মনে হলো। দেখে যদিও আঁচ করতে পারা যায়না। একটা কম্পিউটার, যার সারা শরীরে হলুদ রঙের ট্যাগ-স্টিকার লাগানো। 'ওয়াট টু ডু' কেন্দ্রিক কাগজপত্র সেঁটে দেওয়া হয়েছে পুরো কম্পিউটারের গায়ে। আমি অবশ্য লেখাগুলো দেখিনি কারণ তা অপরাধ হতো। চুপচাপ বসে আছি। একটা ফ্যাক্স মেশিন চোখে পড়লো। ফ্যাক্স-মেশিনের ট্রে-তে অনেকগুলো কাগজ পড়ে আছে। যত্রতত্র অবস্থা, কিন্তু ভালোই লাগছে, কারণ এই কামরায় যাই থাকুক না কেন বোঝা যাচ্ছে তা প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয় এবং তা কাজেই ব্যবহৃত হয়। কোন কিছুই এখানে অব্যবহৃত থাকেনা- ততটুকুই আমার ধারণা হলো।
এরকম একটা মগ্ন সময়ের ভেতর হঠাৎ একটা গলার আওয়াজ শোনা গেলো, "আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউ।" ভদ্রলোক চলে এসেছেন। প্রবীন ভদ্রলোক। উচ্চতা হবে ছয় ফিট এর ওপরে। হালকা সবুজ রঙের একটা ফতুয়া পড়ে চলে আসলেন রিডিং রুমে এবং তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে করমর্দনের জন্য।
"কেমন আছো? তোমার তো দশটায় আসবার কথা ছিলো। এত দেরী করলে যে?"
"আপনার বাসাটা খুঁজে পেতে একটু সময় চলে গেলো। অনেক বেশী দেরী করে ফেলেছি কি স্যার?"
"না...না... তেমন কিছু নয়। সো ইউ আর কিপিং আপ দি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস, আরন'ট ইউ?"
"জ্বি স্যার। চেষ্টা করছি। আর গবেষণা বিশ্লেষক হিসেবেও আছি।"
"কাগজগুলো এনেছো?"
তাড়াতাড়ি জরুরী কাগজগুলো বাড়িয়ে দিলাম ওঁনার দিকে। এছাড়াও আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কিছু সু্ভেনির'ও দিলাম। উনি খুব খুশী হলেন। কাগজগুলো একনজর চোখ বুলিয়ে বললেন, "থ্যাংক ইউ। আমি যা চেয়েছি তার থেকেও ভালো জিনিষ পেলাম। খুব কাজে আসবে এই কাগজগুলো। তুমি কি খাবে বলো? "
"কিছু না স্যার।"
"ঠান্ডা কিছু?"
"হতে পারে।"
আবার শুরু হলো কথা। যদিও তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। উনি ওঁনার বিভিন্ন লেখার কথা বলতে থাকলেন। এক পর্যায়ে আমি কোন বিষয়ে পড়েছি জানতে চাইলেন।
"ইংরেজী সাহিত্য"
উনি যেন জ্বলে উঠলেন! "কি বলছো? আমি তো ৪২ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য পড়িয়েছি!" কথাটা শুনে একটা ঢোক গিললাম। এবং নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হলো যে ভদ্রলোক যে ইংরেজীর অধ্যাপনা করেছেন এই ব্যাপারটি আমার জানা নেই বলে। এরপর, আমাদের কথোপকথনটা খানিকটা আনঅফিসিয়াল হওয়া শুরু হলো। একদম গৎবাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা চলে এলো সাহিত্যে। ওঁনার লিখিত বিভিন্ন কবিতা উনি পাঠ শুরু করলেন একে একে। আমি খানিকটা অবাক হলাম কারণ ওঁনার বাংলা জ্ঞান যে এতটা দারুণ হতে পারে তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না। পরে আবার মনে হলো মাতৃভাষায় ভালো না হলে তো অন্য কোন ভাষায়'ই ভালো হওয়া সম্ভব নয়। এই বিষয়ে অন্য আলোচনা হতে পারে। সেটা না হয় থাক। এরপর "প" অক্ষর নিয়ে পুরো একটি কবিতা পড়ে শোনালেন। যার প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষর "প"। কবিতা শেষ হবার পর উনি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন আমার জবাবে প্রতীক্ষায়। আমি বললাম, "স্যার, আমার ঠিক জানা নেই বাংলা ভাষায় আমাদের দেশে কেউ এ্যালিটারেশন (অনুপ্রাস) নিয়ে কাজ করেছে কি না। আমার জীবনে প্রথম আমি বাংলায় এরকম একটা বাংলা কবিতা শুনলাম যার পুরোটাই এ্যালিটারেশন।"
"সো ইউ হ্যাভ গট ইট। ইয়েস সারটেইনলি দিজ ইজ এ্যালিটারেশন। বাট, আই এ্যাম নট শিউর ওয়েদার সামওয়ান হ্যাজ রিটেন দিজ ইন বেঙ্গলী। প্রব্যাবলি দেয়ার উইল বি সামওয়ান...আই এ্যাম শিউর, ওয়াট ডু ইউ থিংক?"
আমি হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকালাম। এরপর উনি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের প্রাচীন সব ম্যাপ দেখাতে লাগলেন। এটা ওনার হবি। মানুষের যে কত ধরণের হবি থাকে। কেউ কয়েন জমায়, কেউ বা ডাকটিকিট। পুরোনো ম্যাপ কালেকশন আমার কাছে নতুন একটি বিষয়। এরপর উনি আমাকে দুর্লভ কিছু বই দেখালন। জন মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্ট এবং রিগেইনড এর মূল কপি। এমনভাবে ফ্রান্সিস বেকন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের বিভিন্ন বইয়ের মূল কপি। এই বইগুলো তিনি অকশন থেকে কিনেছেন। দাম আর জিজ্ঞেস করিনি। সেটা জিজ্ঞেস করলে হার্ট এ্যাটাক হবার সম্ভাবনা ছিলো। অকশন বলে কথা। এরপর, লেবানন'এর একটা গল্প বললেন। উনি রাষ্ট্রীয় কাজে লেবাননের একটি গ্রামে গিয়েছিলেন, সেই গ্রামটা এখন আর নেই । একটা মরুভূমি হয়ে গেছে। মানুষ যেখানে মরেছে হাজারে হাজার। সেই গ্রামটা নিয়েও তার একটা কবিতা শোনালেন। তা অবশ্য বাংলায়। অসাধারণ ইমেজরি...চিত্রলেখ। বারবারই কথার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে বলতে থাকলেন তিনি আমাকে দেরী করিয়ে দিচ্ছেন কি না। আমি মনে মনে বললাম আর একটু দেরী হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। অনেক কিছুই জানতে পারছি মনে হলো। অনেক কিছুই শিখতে পারছি বলে মনে হলো। এভাবে পার হলো দেড় ঘন্টা। এবার তো যেতেই হবে তাই না? অফিস তো আমাকে জিজ্ঞেস করবে এত দীর্ঘ মিটিং হয় কিভাবে! অগত্যা, ওঁনাকে বললাম, "স্যার আমাকে আজ উঠতে হবে, যদিও একবারের জন্যও উঠতে ইচ্ছা করছে না।" উনি লাঞ্চ করে যেতে বললেন, কিন্তু সেই দাওয়াত গ্রহণ করতে পারলামনা বলে দুঃখপ্রকাশ করলাম। পুরো দেড় ঘন্টায় দাপ্তরিক কথা হলো প্রথম এবং শেষের ১০ মিনিট। বাকী পুরো আলোচনাই যেন এক অন্য জগতে বিচরণ। "খুব ভালো লাগলো স্যার আপনার সাথে কথা বলতে পেরে।"
"ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। আবার খুব শীঘ্রই দেখা হবে নিশ্চয়ই"
"আই উড বি ভেরী মাচ প্রাউড স্যার। দ্যাট উইল বি এ্যান অনার ফর মি।"
এই বলে বিদায় নিলাম। সব রক্ষীগুলো আগের মতোই আছে যার যার জায়গায়। এবার তাদেরকেও যেন অনেক আপন মনে হতে লাগলো। দাপ্তরিক ঝামেলায় এমন কতগুলো রোবট হয়েছি আমরা যে কি বলবো। এই দিনটা তাই আমার কাছে খুব হালকা লাগলো। মনে হলো অফিসে গিয়ে যতই ঝামলো আসুক না কেন কাজগুলো খুব সহজেই সামলে উঠতে পারবো। ধানমন্ডির রাস্তায় বের হয়ে হাঁটলাম আরও কিছুক্ষণ। এরকম তৃপ্তি যেন অনেকদিন পাইনি। মনে মনে আবারও ভদ্রলোক-কে বললাম, "ধন্যবাদ। একজন রোবটকে কিছুটা হালকা করে দেবার জন্য। ধন্যবাদ স্যার।" আমার এই যান্ত্রিক সময়টাকে সহজ করে দেবার জন্য আরও হাজার, লক্ষবার তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম মনে মনে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০০৮ বিকাল ৪:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




