রান্দ আব্দেল-ক্বাদের...সতেরো বছরের এই ইরাকী তরুণী তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যায়নাবকে বলেছিলো তার প্রথম প্রেমের কথা। প্রথম দেখাতেই রান্দ প্রেমে পড়েছিলো এক যুবক ব্রিটিশ সেনার। সে স্বপ্ন দেখেছিলো...সে চেয়েছিলো এই ছেলেটার সাথেই তার বাকী জীবনটা পার করতে। আপসোস। হয়ে উঠলোনা। নিস্পাপ মুগ্ধতায় ঘেরা এই মেয়েটি পড়তো বসরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে। আর, ব্রিটিশ সেনা পল (২২) দক্ষিণ ইরাক-এ নিয়োগপ্রাপ্ত। সেখান থেকেই পরিচয়। সেখান থেকেই এতকিছু। যখন এই তরুণীর দেখা হয় পলের সাথে, তখন থেকেই ওর ভেতর জেগে ওঠে প্রেম। পল'ই যেন ওর সবকিছুর উৎস হয়ে ওঠে। তার স্বপ্নভঙ্গ হয়। না পল ওকে আস্তাবলে ফেলে দেয়নি। রান্দের সম্মানীয় পিতা পলের সাথে ওর সম্পর্কের কথা জানতে পেরে নারকীয়ভাবে নিজ হাতে হত্যা করে তার নিজের মেয়েকে। কারণ মেয়ে উচ্ছন্নে গিয়েছে। একজন খ্রিষ্টান, বেধর্মী, বদমাইশ এবং লম্পট শত্রুসেনার সাথে এমন পরিণয় মেনে নেওয়া যায়না। নিজের সম্মান এর ওপর এমন আঘাত মেনে নিতে না পারে পিতা হত্যা করলো কন্যাকে। বাহ্...বাহ্...কি সুবিচার! ইরাকে এই ধরণের হত্যা করাকে বলা হয় "মর্যাদাপূর্ণ বধ" বা ইংরেজীতে বললে "অনার কিলিং"। গত মার্চে (২০০৮) হত্যা করা হয় রান্দ-কে। ওকে অভিযুক্ত করবার জন্য হাতিয়ার ছিলো অনেক। ছেলে ব্রিটিশ, ধর্মচ্যুত এবং বিভ্রান্ত। এই তো ঢের অভিযোগ। দুজনের পরিচয় হয় যখন ব্রিটিশ সেনারা বসরায় বিভিন্ন দুঃস্থ পরিবারকে ত্রাণ-কর্মসূচীর মাধ্যমে সাহায্য করছিলো, তখন রান্দ আবার ঐ কার্যক্রমে অংশ নেয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সেখান থেকেই শুরু হয় ওর ভালোলাগা। রান্দের ইংরেজী ভালো ছিলো বলে কাজটা পেতে ওর খুব একটা বেগ পেতে হয়নি অবশ্য। মৃত্যুর দুমাস আগে অর্থাৎ জানুয়ারীতে (২০০৮) শেষবারের মতো রান্দ দেখতে পেরেছিলো পলকে। সবচাইতে মজার ব্যাপার ওদের সাধারণত রাস্তায় দেখা হতো কাজের ক্ষেত্রে আর একাকী ওরা হেঁটেছে মাত্র চারবার। এইতো গত ১৬ মার্চের (২০০৮) ঘটনা যখন রান্দের পরম শ্রদ্ধেয় পিতা তাঁর এক বন্ধুর কাছ জানতে পারে পলের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা। সেই বন্ধুর আবার ভালো সম্পর্ক বসরার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে। ঘটনা জানতে পেরে পিতাজী দৌঁড়িয়ে আসেন বাসায়। জানতে চান তাঁর মেয়ের কাছে এবং জেরা করতে থাকেন। রান্দের বাবা যখন বাসায় ঢুকলেন তখন উনি রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন। তাঁর স্ত্রী লায়লা হোসেন আতংকিত। কি হবে এখন। কিছু একটা হতে যাচ্ছে বোধহয়। উন্মাদের মত চিৎকার করতে থাকেন পিতাজী। অসহায় হয়ে বসে থাকেন লায়লা হোসেন। "বল্ হারামজাদী তোর ঐ ব্রিটিশ কুত্তাটার সাথে কি সম্পর্ক?" কাঁদতে শুরু করে রান্দ। ও প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছে আর একইসাথে খানিকটা জেদ'ও ওর ভেতর কাজ করতে শুরু করেছে যেন। সেই জেদই ওর কাল হলো। বাবাজী রান্দের মাথাটা ধরে দেয়ালে ঠোকানো শুরু করেন। বারবার, বারবার, যতক্ষণ না সে বেহুশ হয়ে পড়ে। রান্দের মা চিৎকার করে ডাকতে থাকে তার অন্য দুই ছেলে সন্তানদের যেন তারা এসে বাঁধা দেয় এরকম নারকীয় কান্ড। কিন্তু যখনই রান্দের ভাইয়েরা জানতে পারে তাদের বোন কি করেছে, তখন তারাও হিংস্র জানোয়ারের মতো তাদেরই নিজের বোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর বাপ এবং বেটাগণ মিলে নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে রান্দের ওপর। রান্দ তখন মৃত্যু থেকে কয়েক কদম দূরে। পিতাজী তার নিজের মেয়ের গলার ওপর তার পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছেন শ্বাসরোধ করবার নিমিত্তে। এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। উনি হাঁক দিয়ে একটা ছোরা চান। নিয়ে আসা হয় ছোরা। তারপর তার মেয়ের শরীর উনি কাটতে শুরু করেন নিজের হাতে। হায় ঈশ্বর! এ কোন দুনিয়া ! এ কেমন নির্মমতা। কিভাবে সম্ভব এসব! এরপরই জ্ঞান হারান লায়লা হোসেন। এবং যখন ওনার জ্ঞান ফেরে ততক্ষণে যা হবার তা তো হয়েই গেছে। চোখ মেলে উনি দেখতে পান চারপাশে তার প্রতিবেশীরা তাকে ঘিরে রয়েছে। আর সাথে রয়েছে স্থানীয় পুলিশ। রান্দ ইন্তেকাল করেছে। তার অপরিসীম প্রেমটাও ইন্তেকাল করলো। জানলেন লায়লা হোসেন। রান্দের "মর্যাদাপূর্ণ বধ" সম্পন্ন হয়েছে। পিতাজী পরিশুদ্ধ হয়েছেন তার পাপ থেকে। সম্মান ফিরে এসেছে কার্যগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পিতাজী এখন হালকা বোধ করছেন। যখন কোন রকমের ইসলামী আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ জানাযা ছাড়া রান্দকে পুঁতে ফেলা হয় মাটির নিচে, তখন রান্দের চাচা-মামাগণ ওর লাশটার ওপর থুথু ছিটাতে থাকেন। কারণ একটাই। ওনাদের সম্মানে লেগেছে বিষয়টা। আর ওর একমাত্র অপরাধই হলো ঐ ব্রিটিশ-সেনার সাথে প্রেম। ও প্রেম করেছিলো আর উন্মুক্ত জায়গায় কথা বলেছিলো পলের সাথে। এটাই ওর অপরাধ। লায়লার ভাষ্যমতে, তাঁর স্বামী এই খুনের সাথে সাথেই গ্রেফতার হন। কিন্তু ঘন্টা দুয়েকের ভেতর আবার ছাড়া পেয়ে গর্বের সাথে তার নিজ এলাকায় ফেরেন। এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি যে একজন ইরাকী পুরুষের জন্য এহেন ঘটনা ঘটানো অত্যন্ত সম্মানের এবং গর্বের। দুঃখজনক হলেও বড় নিষ্ঠুর এই বাস্তবতা। বসরার স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের সার্জেন্ট আলী জব্বার বিখ্যাত পত্রিকা "দ্যা অবজারভার" কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন- "আমাদের সেরকম কিছুই করার থাকেনা যখন কোন "মর্যাদাপূর্ণ বধ" এর মত ঘটনা ঘটে। এরকম ঘটনা থানা পর্যন্ত গড়িয়ে কোন লাভ হয়না। আপনি একটি মুসলিম সমাজে বাস করেন। অবশ্যই আপনাকে ধর্মীয় নিয়ম-নীতি-অনুশাসন মেনে চলতেই হবে। ইরাকে তেমনটিই হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। রান্দের বাবার বসরা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষের সাথে পরিচয় আছে। আমাদের কিছুই করবার ছিলোনা আসলে। তাকে আটকে রাখবার মত শক্তি আমাদের নেই। এর থেকে বেশী আমি কিছু বলতে চাইছিনা।"
রান্দ আব্দেল-ক্বাদের, যে কিনা অপবিত্র, তাকে কবর দেয়ার নামে স্রেফ পুঁতে ফেলা হয়। আত্মীয়-স্বজন কেউই তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন না, পাছে সম্মানহানি হয়! ইরাকে অবশ্য মৃত্যু-পরবর্তী জানাযার বাইরেও একটি শোকযাত্রা হয় যেখানে পরিবারের সবাই অংশগ্রহণ করে। বেচারা রান্দ অতটুকুও পেলোনা। বসরা নিরাপত্তা কমিটির তথ্য অনুযায়ী গত বছর (২০০৭), বসরাতে ১৩৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়। আর, ৪৭ জনই "মর্যাদাপূর্ণ বধ" এর আওতাভুক্ত। আর ঐ ৪৭ টি ঘটনার মধ্যে মাত্র তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে হত্যার দায়ে। আদৌ তাদের শাস্তি হবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ বছরের শুরু থেকে এই লেখাটা পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ৩৬ জন নারী। সমস্ত হত্যাকান্ডগুলো ঘটিয়েছে ইরাকীরা। ব্রিটিশ-আমেরিকানরা যে ইরাক দখল করেছে তার পুরো বিরোধিতা করি। কিন্তু তাই বলে ধর্মের নামে এরকম নৃশংসতা কোনভাবেই মেনে নিতে না পেরে এই লেখাটা লিখলাম। কারও হৃদয়ে প্রবেশ করানোর জন্য লেখাটা লিখিনি। শুধুমাত্র কিছু তথ্য উপস্থাপন করলাম আর উপস্থাপন করলাম একটি পরিণতির কথা।
এই ধরণের হত্যার মাধ্যমে নাকি ফেরত আসে সম্মান, যা খোয়া গিয়েছিলো। হায়! কি নিদারুণ প্রক্রিয়া! পরিশুদ্ধ পিতা। মৃত রান্দ আব্দেল ক্বাদের...নিথর দেহে অসম্মানের সাথে পড়ে আছে বসরার মাটির নিচে।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




