গত বছর একটি উপন্যাসের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। পড়ুন .......১০০% হালাল উপন্যাস।......(অমুক)... লেখক... (অমুক) ...। জঘন্য! জঘন্য!!
এই রকম বিজ্ঞাপন অহরহ দেখছি। স্মার্ট লেখক, কিংবদন্তী লেখক, সেরা লেখক, সমাজসচেতন লেখক, প্রতিবাদী লেখক..উজানি কইমাছের ঝাঁকের মত বইমেলা এলেই এইসব লেখক এসে জুটে যায়। তাদের লক্ষ্য বইমেলায় আগত অধিকাংশ ব্যক্তি।
বই মেলায় কারা আসে?
অধিকাংশই রবাহুত। তারা অধিকাংশই সাহিত্যের কেউ নন, বাণিজ্য মেলা দেখলে বাণিজ্য মেলায় যাওয়া লোক, যাত্রা দেখলে যাত্রায় যাওয়া লোক, ক্যানভাসার দেখলে দাঁড়িয়ে যাওয়া লোক... এইসব লোকেই ভরে থাকে মেলা, অধিকাংশই এসেছে রব শুনে। এইসব বিজ্ঞাপনবাজ লেখকদের টার্গেট এরাই।
আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো সাধারণত লেখকদের দুই ভাগে ভাগ করে। একভাগে থাকে মননশীল সৃজনশীল সাহিত্যিকেরা (যেমন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ওয়াসি আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, সেলিনা হোসেন, হরিপদ দত্ত, মঞ্জু সরকার, মাহমুদুল হক, আহমদ ছফা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, জাকির তালুকদার এঁরা), অপরদিকে থাকে জনপ্রিয় তথা ট্র্যাশ সাহিত্যিকেরা (যেমন হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন এঁরা)। জনপ্রিয় সাহিত্যের চলও বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আছে। তার্ও আছে একটা ধরণ। যেমন হুমায়ুন আহমেদ একটা গল্প লিখলেন, হয়তো সস্তা প্রেমের গল্প, তার সরল বুনুনি হয়তো কয়েকজন পাঠকের ভাল লাগল। তারা বইটি কিনল। তিনি একই ধাঁচের, একই কাঠামোর সরল গদ্যের আরেকটি বই লিখলেন, সেটিও চলল। বই চলল এই দিকটিই তার এবং তার প্রকাশকের মনে ধরল। তিনি পাঠকের মন জুগিয়ে লিখতে থাকলেন, প্রকাশকরাও বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিতে থাকলেন যে তার নতুন অমুক বই বেরিয়েছে। ..জনপ্রিয় লেখকদের ধাঁচটা হয় এইরকমই।
তাহলে বিজ্ঞাপন বাজ লেখক কারা? তারা সাহিত্য জগতে কি উপদ্রব? ক্ষতিকর??
ক্ষতিকর কিনা সে প্রশ্ন তর্ক সাপেক্ষ, তবে এরা বিশাল উপদ্রবই বটে। তাদের রুচিহীন রঙিন বিজ্ঞাপনের জ্বালায় চোখে অস্বস্তি ধরে যায়...মন পীড়িত হয়। এবং এরা এক অর্থে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের জন্য্ও স্বস্তির কারণ নয়। উদাহরণ দেই, লোকটির টাকা পয়সা আছে। নাই কালচার বা সাহিত্য জ্ঞান বা মেধা। নাম করা দরকার। কি করবে। লোক ঠিক করে একটা বই লিখে ফেলে বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করল। (তিনি চট্টগ্রামের একজন রাজনীতিক, কলাম লেখক, নাট্যকার, তার নামে প্রকাশিত লেখাগুলি তার নয় বলেই জনশ্রুতি আছে।) চলল ব্যাপক প্রচার। শুনি যে বইটা নাকি ভালই বিক্রি হয়েছে। কিনল কারা? ওই সব রবাহুতেরা। যারা বই কেনার জন্য বিজ্ঞাপনের উপরই নির্ভর করে পুরোপুরি।
একুশের বাংলা একাডেমী বইমেলাতেই এই বিজ্ঞাপনবাজদের তৎপরতা চোখে পড়বে এটাই স্বাভাবিক, কিছু মুর্খ ক্রেতা তো টাকা নিয়ে হাত বাড়িয়ে আছে, টাকাটা বুঝে নিয়ে বইটা গছিয়ে দাও।
আরেকটা ধাঁচ আছে।
এই কুলের শিরোমনি হল মোহিত কামাল। এই ডাক্তারকে কে চিনতো আগে? আজ তাকে অনেকেই চেনে নামে। আহ! টাকা যাদু জানে!
দেখুন পরিতোষ বাড়ৈর বিজ্ঞাপনটা। তার চারটা ভিন্ন রকম বই বের হয়েছে। চারটি প্রকাশনী থেকে। বিজ্ঞাপনটা দেখতে পাচ্ছি চার প্রকাশণীর নামেই দেয়া আছে, অর্থাৎ প্রাপ্তিস্থানের কথা বলা হল। এখন প্রশ্ন, চারটি প্রকাশনা সংস্থা মিলেই কি বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে নাকি লেখকই দিয়েছে?
জামাল রেজা নামের একজনের ক্ষেত্রেও দেখি এই অবস্থা। টাকা ছড়াও, নাম ফাটুক।
আরেকজন আরেক কাঠি সরেস। স্ত্রী স্বামীকে আন্ডারওয়ার গিফট করেছে... বড় বড় করে শোভা পাচ্ছে বিজ্ঞাপনে...কুৎসিত!
আজ প্রণব ভট্ট কোথায়? তিনি টাকার জোরে হঠাৎ করে জাঁকিয়ে বসেছিলেন বইমেলায়। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন মনে হতো কত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক! আহা!! আসলে সাহিত্যের জায়গাটা বড় নির্মম, এই জিনিস কালের গর্ভে টেকে না যদি না ভেতরে আসলেই কিছু থেকে না থাকে।
ফলে তিনি নাই, তার সাহিত্যও নাই, সাহিত্যিকের শারীরীক মৃত্যুর সাথে সাথে তার সাহিত্যেরও মৃত্যু ঘটে যায়? যায়, যদি বিজ্ঞাপন দেয়ার লোক না থাকে। এরা বই লেখক, ঠিক সাহিত্যিক নন। ঘটনাটা এই ই।
বইমেলা এলেই এরা (তথাকথিত লেখক) কারা জুটে যায়? সারা বছর সাহিত্য অংগনে তো এদের নাম ধাম চিহ্ন পর্যন্ত দেখি না।
হাফিজ আল ফারুকী নামের একজনের তো দেখি একটা সাক্ষাৎকারও নিয়ে ফেলেছেন এক ব্লগার। আরেকজন লিখেছেন আলোচনা। সমস্যাটা ওখানেই। বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ভুল মানস গড়ে উঠছে, মূঢ় সাহিত্য রুচি, ধারণা গড়ে উঠছে। পত্রিকার রির্পোটের চেয়ে কাঁচা লেখাকে উপন্যাস বলে চিৎকার করা হচ্ছে, তরুন সমাজ তো বটেই, পাঠকও হয়ে পড়ছে বিভ্রান্ত। যেন বই মেলায় শুধু ওই বিজ্ঞাপনবাজদেরই বই বের হয়।
সাহিত্য রুচি, আলোচনার ধরণটা কেমন নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেখি। জনৈক হাফিজ আল ফারুকীর কথাই বলি। একজন পাঠিকা উল্লেখ করলেন, " জলের বুকে জলের ছায়া পড়ে না" আহা মরি মরি! এসব নাকি বাক্যের অলঙ্কার, উপন্যাসের বাক্য। কয়েকজন ব্লগারও দেখি বিভ্রান্ত, তারাও ওদিকে জুটার চেষ্টা করছে। এইসব ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গায় সাহিত্যকে নিয়ে যাওয়াটাই আপত্তিকর, অপরাধ। এসবও নিচুদরের প্রচারণা, সত্যিকারের সাহিত্যিকেরও এতে স্বস্তি পাবার কথা নয়। এইসব বিজ্ঞাপনের সাথে মেগাসপ নন্দনের গরুর মাংসের বিজ্ঞাপনের ফারাকটা কোথায়?
মুশকিল বা সাহিত্যের ক্ষতিটা ঠিক ওখানেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



