ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস বা ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি মুশকিল আছে। বলা হয়ে থাকে যে, বাস্তবতা ফিকশনের চেয়ে নির্মম। অর্থাৎ বলা যায়, যা কিছু বাস্তব বা ইতিহাসে ঘটেছে তার পুরোটাই উপন্যাসে আনা যায় না। আনতে হয় উপন্যাসের ধরণ বা বিষয়বস্তু অনুসারে, না হলে সেটি সাহিত্যমান ক্ষুন্ন করে নিছক একটি প্রতিবেদনে পরিণত হতে পারে।
যখন হিন্দু মুসলমান এই তত্ত্বের ভিত্তিতে (দ্বিজাতি তত্ত্বটি জিন্নাহর তত্ত্ব, এটি কুৎসিত সাম্প্র্রদায়িক তত্ত্ব, এটি অনেকেই স্বীকার করে না) পাকিস্তান গঠিত হয়, তখন ধরেই নেয়া যায় যে, এই ভুখন্ডটি রাষ্ট্র হিসাবে যাত্রা শুরু করার প্রাক্কালে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য কী ভয়ানক, পীড়াদায়ক, নির্মম, সহিংস অবস্থা তৈরী করতে পারে। রাস্ট্রীয় উদ্যোগে, প্ররোচনায়, আনুকুল্যে হিন্দু পীড়ন ও তাদের এ দেশ থেকে তাড়ানোর যে তৎপরতা শুরু করে এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ, নির্মমতায় তা কী ভীষন ছিল, শুধুমাত্র "সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা" বলে পাকিস্তান শুরুর কয়েক দশককে চিহ্নিত করা যাবে না।
শুরু থেকেই পাকিস্তান ছিল আগাগোড়াই এক সাম্প্রদায়িক রাস্ট্র। যার নেতারা জননেতা নয়, তারা মুসলিম, পুলিশরা পুলিশ নয়, তারা মুসলিম, সরকারী কর্মকর্তারা ডিসি, এস পি, সচিব নয়, তারা নিছক মুসলিম, শিক্ষকরা শিক্ষক নন, তারাও মুসলিম....ধর্ম নিয়ে এমন নোংরামি, জিঘাংসা, অশ্লীলতা পৃথিবীর কম দেশের মানুষের চোখেই পড়েছে।
পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল এমন এক দানব গোষ্ঠির, তাদের রাষ্ট্রীয় সহযোগী হিসাবে, দেশে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অরক্ষিত সম্পদ, নারী লুন্ঠন করাই ছিল তাদের কাজ বা দেশপ্রেমের নমুনা। এমন এক অরাজক অবস্থার তৈরী করা যাতে হিন্দুরা ব্যাপক ভাবে দেশ ছেড়েছিল কিন্তু রয়ে যাওয়া সাধারণ মুসলিমরাও দানবদের ক্ষুধার শিকারে পরিণত হতে বেশী সময় লাগে নি...
নিজ মাতৃভুমি ছাড়তে কেউ চায় না, প্রাণের বিনিময়েও না। তবু ছাড়তে হয়..যদি সেই মাতৃভুমি হয় পাকিস্তান।...বিষাদবৃক্ষ উপন্যাসটি থেকে কয়েকটি অংশ শোনাই আপনাদের।
বাড়ির কিশোরী মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছে তিন যুবক কর্তৃক। রাতে ডাকাত পড়েছিল। (এই ডাকাত দলের সদস্যদের মাঝে অনেক নামি পরিবারের মুসলিম যুবকেরা থাকত, যারা ধন সম্পদ লুঠ করত না, তাদের নজর ছিল হিন্দু কিশোরী মেয়েদের দিকে)
বিধ্বস্ত পরিবার। পুলিশ এল। ওসি বলল, মেয়েটিকে একা জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। মুরুব্বীদের সামনে সবকিছু নাও বলতে পারে। একা একটি রুমে মেয়েটিকে ঘন্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হল দরজা আটকে। .....
পুলিশি রায় এল, মেয়েটিই খারাপ। আসলে তার প্রেম ছিল আপনাদের রাখালের (মুসলিম) সাথে, মেয়েটিই ডাকাতির এই নাটক সাজাইছে, দিনে তো "করতে" পারতেছে না, তাই রাইতে নাগরের লগে "মিলিত" হওনের জন্য....এই হল পাকিস্তানী পুলিশ।
বরিশাল বি এম কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষার দুইদিন আগে হিন্দু ছেলেকে বলল কেরাণী, তোমার পরীক্ষা দেয়া হবে না......
পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক মুসলিম প্রিন্সিপালেরও মন্তব্য, এ দেশ আসলে তোমাদের জন্য নয়।
কোন দেশ? পাকিস্তান।
পাকিস্তান হিন্দুদের জন্য নয়, কিন্তু মানুষের জন্য কি? না তাও নয়। এ দেশ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছিল এ অরাজকতা।
উপন্যাসটিতে হিন্দু মুসলিম সমস্যাটাই শুধু আসেনি, এসেছে দেশ ভাগ, তার ইতিহাস, তৎকালীন রাজনৈতিক সামাজিক মনস্তত্ব, জীবনসংগ্রাম, পাশাপাশি স্বপ্ন দ্রষ্টা কিছূ মানুষের উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, মোট কথা, একটি ভুখন্ডের ইতিহাস।
উপন্যাসটির পরিচিতিতে আছে, "আমাদের সাহিত্য এবং সমাজবিজ্ঞান এমন একখানা গ্রন্থের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল। ১৪১১ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরষ্কারে ভুষিত এই গ্রন্থে প্রাপক মিহির সেনগুপ্ত দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তার নিজের জীবনের প্রথম ১৭-১৮ বছরের গল্প বলেছেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের বছরে জন্মগ্রহন করে মিহির দেশভাগের ট্রমা উপলদ্ধি করেছেন প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে বসে এবং পরে পড়াশুনার কারণে জেলাশহরে বসে। আমাদের সাহিত্যে দেশভাগ বিষয়ে যে অকিঞ্চিতকর লেখালেখি আছে সে সব মুলত পূর্বপাকিস্তান থেকে এদেশে আসা মানুষদের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন ভঙ্গ, জীবনসংগ্রামের কাহিনী। মিহিরের "বিষাদবৃক্ষ" ঠিক এর উল্টো। তিনি একটি ইসলামী রাষ্ট্রে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে বসবাস করে দেখেছেন দেশভাগ উভয় সম্প্র্রদায়ের মানুষের মনে কী এক ভয়াবহ বাস্তবতার জম্ম দিয়েছে। কীভাবে একসময়ের শিক্ষিত স্বচ্ছল পরিবার গুলোর পরিবর্তন হচ্ছে, হচ্ছে সর্বার্থে অধঃপতন, উঠে আসছে নতুন শ্রেনী, নতুন মানুষ, তৈরী হচেছ নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক। তার ভাষায় অপরর্ণী বা অপবর্গী মানুষের পরিণতিই বা কী হচ্ছে, সমান গুরুত্ব ও দরদ দিয়ে মিহির লিখেছেন সেসব কথা। সম্ভ্রান্ত ভুস্বামী পরিবারের সন্তান মিহির জীবন সংগ্রামে কিভাবে নিজের শ্রেনী গন্ডি অতিক্রম করে নিম্মবর্গের শ্রেণীতে উর্ত্তীর্ণ হয়েছেন "বিষাদবৃক্ষ" সে যন্ত্রণারও দলিল। এই কঠিন কাজটি করতে গিয়ে তিনি নিজেকে কিংবা নিজের পরিবারকেও তিক্ত উম্মোচনের গ্লানি থেকে আড়াল করেন নি।
বিষাদবৃক্ষ একখানি শক্তিশালী এবং বিষাদময় আত্মস্মৃতি যা এই উপমহাদেশের এক ভয়াবহ সময়ের প্রতিবিম্বিত দর্পণ মাত্র।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



