"মিত্তিকা -"
"আমি বুঝতে পেরেছি যে এই সৃষ্টিজগতে অন্যায় - ভয়ঙ্কর অন্যায় যেরকম থাকবে তাকে
থামানোর জন্যে সেরকম সত্য আর ন্যায় থাকতে হবে। অন্যায়কে অন্যায় দিয়ে যুদ্ধ করা যায়
না। ন্যায় দিয়ে অন্যায়ের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।"
"মিত্তিকা শোনো -"
"আমি তোমার উপর অভিমান করেছিলাম ইবান। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে এই
ভয়ঙ্কর মানুষের হাতে তুলে দিয়েছ। এই নিঃসঙ্গ অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে শুয়ে আমি হঠাৎ
করে বুঝতে পেরেছি যে আসলে কেউ আমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাসের হাতে তুলে দিতে পারবে না !
কেউ না।"
মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হাসল, হেসে বলল, "আমার ভেতরকার যত সুন্দর অনুভূতি, যত
ভালোবাসা সবকিছু এই মানুষটি ধ্বংস করে দেবে। তারপর যেটা বেঁচে থাকবে সেটা তো
মিত্তিকা নয়। সেটা অন্য কেউ। সেই ভয়ঙ্কর অমানুষ চরিত্রটির শরীর হয়ত আমার কিন্তু সেটি
আমি নই। জগতের সব ভালোবাসা, সব সুন্দর, সব ন্যায় সরিয়ে নিলে সেটা আমি থাকব না।
আমার ভেতরকার ভালোটুকু আমি, খারাপটুকু আমি নই।"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস উৎফুলব্জ্থ গলায় বলল, "চমৎকার মিত্তিকা, এর চাইতে ভালোভাবে এটা করা
সম্ভব ছিল না। তোমার মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা অংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তোমাকে অনেক
ধন্যবাদ।"
ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্যে নিহিলা39 গ্যাস মাস্কটি মিত্তিকার মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে ক্লদ
বলল, "এখন ঘুম পাড়িয়ে দেব, ক্যাপ্টেন ?"
"হঁ্যা। ঘুম পাড়িয়ে দাও। আর একঘণ্টার মাঝে মিত্তকা নতুন মানুষ হয়ে উঠবে।"
ক্লদ মিত্তিকার মুখের উপর গ্যাস মাস্কটি নামিয়ে আনল। মিত্তিকা খুব সুন্দর করে হাসল,
হেসে বলল, "ইবান, বিদায়। আমার চোখে ঘুম নেমে আসছে। এই ঘুম থেকে যে মানুষটি
জেগে উঠবে সেটি আর মিত্তিকা থাকবে না। সেই ভয়ঙ্কর মানুষটিকে তুমি ক্ষমা করে দিও
ইবান।"
আমি মিত্তিকার হাতে চাপ দিয়ে বললাম, "মিত্তিকা, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। তোমার
ভেতরকার ভালোবাসা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।"
মিত্তিকা তার শক্ত করে বেঁধে রাখা হাত দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করার চেষ্টা করল, পারল
না, আমি, অনুভব করলাম তার হাত দুর্বল হয়ে আসছে, আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।
সেখানে গভীর ঘুম নেমে আসছে। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ম্যাঙ্গেল
ক্বাস তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, "আমি ভেবেছিলাম
তুমি কাউকে মিথ্যা সান্ত্বনা দাও না।"
"না। আমি দেই না।"
"তাহলে তাকে কেন বলেছ কেউ তার ভেতরকার ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারবে না ?"
"কারণ তার আগেই সে মারা যাবে।"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চমকে উঠে বলল, "কী বললে ?"
"শুধু মিত্তিকা নয়। তুমি, আমি তোমার এই প্রভুভক্ত অনুচর সবাই মারা যাবে।"
"কেন ?"
"আমি ফোবিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলছি ম্যাঙ্গেল ক্বাস। তুমি টের পাচ্ছ না ফোবিয়ান তার
গতিবেগ পাল্টে নিউট্রন স্টারের দিকে ছুটে যাচ্ছে ?"
আমি এই প্রথমবার ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে আতঙ্কের চিহ্ন দেখলাম। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে
আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, "কী বললে ? তুমি ফোবিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলছ ?"
"হঁ্যা।"
"কেন ?"
আমি মিত্তিকাকে দেখিয়ে বললাম, "এই মেয়েটার মাঝে একটা আশ্চর্য সরলতা রয়েছে।
তাকে একজন কুৎসিত অপরাধীতে পাল্টে দেবে সেটা আমার জন্যে গ্রহণযোগ্য নয়।"
"এই একটা তুচ্ছ মেয়ের জন্যে তুমি -"
"একজন মানুষ কখনো তুচ্ছ হয় না। আমি তোমার মতো দানবকেও উদ্ধার করে
এনেছিলাম। তার তুলনায় মত্তিকা একজন দেবী, মিত্তিকা খুব ভালো একটি মেয়ে, আমি তার
ভালোটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এক-দুইটি মহাকাশযান ধ্বংস করে ফেলতে পারি।"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস হঠাৎ আমার কাছে এসে বুকের কাছাকাছি পোশাকটি শক্ত করে ধরে
চিৎকার করে বলল, "তুমি মিথ্যা কথা বলছ।"
আমি ম্যাঙ্গেল ক্বাসের হাতটি সরিয়ে বললাম, "আমি সাধারণত মিথ্যা কথা বলি না।"
ক্লদ এবং মুশ ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাছে ছুটে এসে বলল, "এখন কী হবে ?"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা ঝাকিয়ে বলল, "এ মিথ্যে কথা বলছে। এত সহজে কেউ পঞ্চম
মাত্রার মহাকাশযান ধ্বংস করে দেয় না।"
"কোনটি সহজ কোনটি কঠিন সে-ব্যাপারে তোমার এবং আমার মাঝে বিশাল পার্থক্য -"
আমার কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযান ফোবিয়ান হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে উঠল,
মনে হলো পুরো মহাকাশযানটি বুঝি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে !"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপা গলায বলল, "নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চল, দেখি কী হচ্ছে।"
কথা শেষ করার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস এবং তার পিছু পিছু ক্লদ এবং মুশ ছুটে বের হয়ে
গেল। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিত্তিকার কাছে এগিয়ে গেলাম, তার ঘুমন্ত মুখটি স্পর্শ করে
নরম গলায় বললাম, "ঘুমাও মিত্তিকা। আমি দেখি তোমাকে বাঁচাতে পারি কি না।"
আমি মিত্তিকার মাথার কাছে রাখা নিহিলা গ্যাস সিলিণ্ডারটি তুলে নিলাম। কৃত্রিম শ্বাসপ
্রশ্বাসের জন্যে ছোট অক্সিজেন সিলিণ্ডার থাকে, একটু খুঁজে সেটাও বের করে নিলাম।
পোশাকের ভেতরে সেগুলো লুকিয়ে নিয়ে এবারে আমিও ছুটে চললাম নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখানে
এখন আসল নাটকটি অভিনীত হবে। আমি তার মূল অভিনেতা - আমাকে থাকতেই হবে।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষে আমাকে দেখে ম্যাঙ্গেল ক্বাস দাঁতের ফাঁক দিয়ে কুৎসিত একটা গালি
উচ্চারণ করে বলল, "নির্বোধ আহাম্মক কোথাকার।"
আমি অত্যন্ত সহজ একটা ভঙ্গি করে বললাম, "এখন আমার কথা বিশ্বাস হলো ? দেখছে,
মহাকাশযানটা ধ্বংস হতে যাচ্ছে।"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চিৎকার করে বলল, "না। ধ্বংস হচ্ছে না। আমি সেটাকে ফিরিয়ে আনব।"
"তুমি পারবে না।"
"দেখি পারি কি না।"
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অভিজ্ঞ মহাকাশ-দসু্য - মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে নিতে হয় সেটি খুব
ভালো করে জানে। সে দ্রুত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর প্যানেল স্পর্শ করে
মূল ইঞ্জিন দুটো পরিপূর্ণভাবে চার্জ করে নেয়। এখন ইঞ্জিনদুটো চালু করতেই প্রচণ্ড শক্তিশালী
দুটো ইঞ্জিন মহাকাশযানটিকে সঠিক যাত্রাপথে নেয়ার চেষ্টা করবে। সেই ভয়ঙ্কর শক্তি
মহাকাশযানটিকে প্রচণ্ড ত্বরণের মুখোমুখি এনে ফেলবে, মহাকাশযানের ভেতরে সেটি এক অচিন্তনীয় মাধ্যাকর্ষণের জন্ম দেবে। ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লেদ আর মুশ সেই অচিন্তনীয় মহাকর্ষণে
অচেতন হযে পড়বে, কিন্তু আমাকে চেতনা হারালে চলবে না, যেভাবেই হোক আমাকে স্থির
হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আমি জানি না পারব কি না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল স্পর্শ করার জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিল, আমি নিজেকে
রক্ষা করার জন্যে নিচে লাফিয়ে পড়লাম, দুই হাতে শক্ত করে দুইপাশের দুটি ধাতব রিং আঁকড়ে
ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস সুইচ স্পর্শ করল এবং সাথে সাথে প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের
শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল। আমার প্রথমে মনে হলো মহাকাশযানটি বুঝি টুকরো
টুকরো হয়ে উড়ে যাচ্ছে, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে না মহাকাশযানটি এখনো টুকরো
টুকরো হয়ে যায় নি - প্রচণ্ড ঝাকুনিতে মহাকাশযানের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে উড়ে গেছে মাত্র।
আমি চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম বলে ম্যাঙ্গেল ক্বাস, ক্লদ বা মুশকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু কাতর
চিৎকার শুনে বুঝতে পারলাম তাদের কেউ-না-কেউ ছিটকে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। পদার্থ-প্রতিপদার্থের শক্তিশালী ইঞ্জিন
ভয়ঙ্কর গর্জন করে শব্দ করছে, আয়োনিত গ্যাস অচিন্ত্যনীয় গতিবেগে ছুটে বের হয়ে
মহাকাশযানটিকে নিউট্রন স্টারের মহাকর্শ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে
পারছি মাধ্যাকর্ষণের টানে আমার ওজন বেড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে সমস্ত শক্তি দিয়ে অদৃশ্য
কোনো দানব আমাকে মহাকাশযানের মেঝেতে চেপে ধরছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না,
আমার চোখের উপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি এক্ষুনি
অচেতন হয়ে পড়ব।
কিন্তু আমি জোর করে নিজের চেতনাকে শানিত করে রাখলাম, আমার কিছুতেই জ্ঞান
হারালে চলবে না, আমাকে যেভাবেই হোক নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জেগে থাকতে হবে।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জেগে রইলাম।
আমি অনুভব করতে পারছি মহাকাশযানের প্রচণ্ড ত্বরণে আমার চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে,
অদৃশ্য শক্তি মুখের চামড়া দুইপাশে টেনে ধরেছে, হাত নাড়ানোর চেষ্টা করে নাড়াতে পারছি না,
মনে হচ্ছে কেউ যেন পেরেক দিয়ে আমার সমস্ত শরীরকে মেঝের সাথে গেঁথে ফেলছে, শরীরের
সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ কেউ যেন পিষে ফেলছে। নিজের শরীরের প্রচণ্ড চাপে আমার নিজের অস্তিত্ব
যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কষ্টে আমার মুখ শুকিয়ে যায়, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক হা হা করতে থাকে। মনে হয় কেউ যেন মহাকাশযান থেকে সমস্ত বাতাস শুষে নিয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও
আমি একফোটা বাতাস বুকের ভেতরে আনতে পারি না। মাথার ভিতরে কিছু একটা দপদপ
করতে থাকে, মনে হয় বুঝি এক্ষুনি একটা ধমনী ছিঁড়ে যাবে, নাক মুখ চোখ দিয়ে গলগল করে
রক্ত বের হয়ে আসবে।
আমি আর পারছি না, অনেক চেষ্টা করেও আর নিজের চেতনাকে ধরে রাখতে পারছি না।
হঠাৎ করে মনে হতে থাকে চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে আসছে, চারপাশে সবকিছু
অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়ে অচেতনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম,
ঠিক তখন কে যেন আমাকে ডাকল, "ইবান।"
কে ? কে কথা বলে ? আমি চোখ খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আমি আবার
গলার স্বর শুনতে পেলাম, "ইবান। তুমি কিছুতেই জ্ঞান হারাতে পারবে না। তোমাকে যেভাবে
হোক চেতনাকে ধরে রাখতে হবে। যেভাবেই হোক।"
কে কথা বলছে ? মানুষের গলার স্বরটি আমি আগে কোথাও শুনেছি কিন্তু কিছুতেই মনে
করতে পারছি না। গলার স্বরটি আবার কথা বলল, "ইবান। তুমি চোখ খুলে তাকাও।"
আমি পারছিলাম না, কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিলাম না, কিন্তু গলার স্বরটি আবার জোর
করল, "চোখ খুলে তাকাও, ইবান।"
আমি অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকালাম, আমার মুখের কাছে ঝুঁকে রিতুন ক্লিস দাঁড়িয়ে
আছেন। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বললেন, "আমি হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি না হয়ে
সত্যিকারের মানুষ হলে তোমাকে বুকে করে তুলে নিতাম ইবান। কিন্তু আমি সেটা পারব না।
তোমাকে জেগে উঠতে হবে ইবান। যেভাবেই হোক জেগে উঠতে হবে। যদি মিত্তিকাকে বাঁচাতে
চাও এই মহাকাশযানটিকে বাঁচাতে চাও তোমাকে জেগে উঠতেই হবে।"
আমি দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললাম, "আমি পারছি না, কিছুতেই পারছি না।"
"তোমাকে পারতেই হবে। যেভাবেই হোক তোমাকে পারতেই হবে। ওঠ। ম্যাঙ্গেল ক্বাস
আর তার দুইজন অনুচর অচেতন হয়ে আছে, ওঠ তুমি।"
"আমি কী করব ?"
"নিহিলা গ্যাসের সিলিণ্ডারটি এনেছ না ?"
"হঁ্যা, এনেছিলাম।"

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



