somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অফিস পাড়া

১০ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বেশিরভাগ দিন লাঞ্চ সারা হয় অফিসের ডাইনিংয়ে, আর মাঝেসাঝে সাত তলা থেকে নিচে নেমে রাস্তার পাশের ছোট্ট এক হোটেলে, যাদের তেহারিতে টানা ছয় বছর বাঁচিয়ে রাখা নীলক্ষেতের তেহারির খানিকটা সুবাস থাকে । গেইটের ঠিক পাশেই ভ্যানে নিয়ে দাড়ান সুমন সাহেব - আপেল, কমলা, নাশপাতি আর মৌসুম বুঝে আম, লিচু এসব নিয়ে, যে দন্ত্যস স আর তালব্য শ এর উচ্চারণে জিবের জড়তায় নিজের নাম বলে " ষুমন " । ভ্যান, ডিজিটাল ওজন মাপার মেশিন, একটা পরিষ্কার গামছা, ছোট্ট একটা বালতি এবং ফ্রেশ কোম্পানির দুই লিটারের বোতলে কয়েক লিটার পানি নিয়ে তার সংসার । সুমন যেদিন থাকে আমি প্রায়ই তার থেকে একটা বা দুটো আপেল কিনি ( স্বাস্থ্যগত কারণে নয় ঠিক ; কারণ প্রথমত অভ্যাস, দ্বিতীয়ত অফিসের গন্ডির বাইরে এসে সুমনের সাথে দেশ, খেলা, রোদ, বৃষ্টি এসব নিয়ে গল্প করতে আমার ভালোই লাগে বেশ, তৃতীয়ত স্বাদ ), দাম পড়ে চৌদ্দ থেকে উনিশ টাকা করে । অবশ্য আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সুমন নিরুদ্দেশ ছিলো বলে আমার নিয়মিত বিতং করে আপেল খাওয়াও বন্ধ ছিলো ।

আজ সুমন আমাকে দেখে বিশাল এক হাসি দিয়ে জিজ্ঞাস করলো- কেমন আছেন ভাই? সম্বোধনে স্যার শব্দের অনুপস্থিতি স্বস্তি ও আন্তরিকতা বয়ে আনে এবং আমি জিজ্ঞাস করি - কই ছিলা মিয়া এতোদিন?

জবাব আসে - দ্যাশে । সুমনের মা তাকে হুট করে একদিন ফোনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং ডেকে নিয়ে সুমনকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন । নিজের পছন্দে বিয়ে কিনা জিজ্ঞাস করতে জানা গেলো পাত্রী মায়েরই ঠিক করা । সুমন অবশ্য মাস তিনেক যাবত ফেসবুকে একটা মেয়ের সাথে বেশ কথা - বার্তা বলছিলো যাকে সে কখনো দেখে নি, আর ঠিক প্রেমও হয় নি তাদের মাঝে - হব হব করছিলো । তাই জোরালো ভাবে আপত্তি জানানোর সুযোগ বা জোর সুমন পায় নি । সে সম্ভবত এমনিতেও বেশ মা ভক্ত । এর আগে একাধিকবার দেখেছি কোন কাস্টমার বেশি বাছাবাছি করতে গেলে সে কঠোর গলায় বলে - " এতো বাইছেন না ভাই, সবগুলাই ভালো । আমি খারাপ জিনিস বেচি না, আমার মা'য় না করছে " । আর তার মুখের লাজুক আভা আর চোখের প্রজাপতি ভাব বলে দিলো সুমন নতুন বউ নিয়ে খুব সুখে আছে ।

বেছে বেছে উজ্জ্বল হলুদে হালকা লালের ছোপ থাকা একটা আপেল বের করে, ওজন নিয়ে, গামছা দিয়ে মুছে, ফ্রেশ কোম্পানির বোতলে থাকা পানি দিয়ে ধুয়ে সুমন আমার হাতে ধরিয়ে দেয় । দাম আসে ষোল টাকা, বলে - আপনি পনের টাকা দেন । ছোট্ট এই ডিসকাউন্ট আমার কাছে হাজার, আড়াই হাজার টাকার Buy One Get One বুঁফে ডিনারের অফারের চেয়েও বেশি ভালো লাগে । আপেল হাতে করে আমি আবার মৌমাছির চাকে ঢুকে ভীড়ের একজন হয়ে হারিয়ে যাই ।

দিনের আলো থাকতে থাকতে বিকেলে অফিস থেকে কোনভাবে কাট্টি মেরে সিনেপ্লেক্সে সন্ধ্যার শো-তে মুভি দেখতে যাবো, এমন চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করছিলো বলে সেদিন দুপুর থেকে মন ছিলো বেশ উড়ুউড়ু । কিন্তু মৌচাক থেকে বের হতে হতে বাজলো রাত সাড়ে নয়টা । নানা কারণে বিরক্ত, রাগান্বিত বা চিন্তিত একসাথে বের হওয়া অন্য চারজনও । পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ (এবং বেশি, প্রায় এক কাড়ি, টাকা বেতন পাওয়া জন) জন প্রস্তাব করেন আমরা এখন ইচ্ছামতো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করবো এবং পথে চিংড়ি মাছের মাথা থেকে শুরু করে তোকমার শরবত সহ যা যা খাবার পাওয়া যায় সব খাবো । চমৎকার প্রস্তাব । পথে রাস্তা পেরোনোর সময় আইলেনে চোখে পরে অফ হোয়াইট কালারের একটা কুকুর পায়ে মুখ রেখে শুয়ে আছে, কেমন মনমরা ভাব, যেন বেশ মন খারাপ কোন কারণে । আমি তাকে জিজ্ঞাস করি কি হয়েছে, তার মন খারাপ কিনা? জবাবে সে একটু চোখ পিটপিট করে উদাস ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে । মনমরা ভাব কাটাতে উৎসাহ দিয়ে আবারও বলি - বৃহস্পতিবার রাতে এমন ম্যান্দা মাইরা থাকলে তো হবে না রে বেটি .. এই রাত হলো Chilling এর রাত .. So, chill. তবুও তার নড়াচড়ায় অনীহা দেখে আমাদের মধ্যে থেকে একজন সুচিন্তিত মন্তব্য করে - ওর মনে হয় পেট ব্যথা । এই শুনে অন্য আরেকজন বলে - হাজব্যান্ডের সাথে ঝগড়াও লাগতে পারে । নিশ্চয়ই বার্থ ডে বা বিয়ের দেড় সপ্তাহপূর্তি উপলক্ষে হাজব্যান্ডের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, নেয় নাই বলে রাগ করছে । এসব শুনে বয়োঃজ্যেষ্ঠ জন মন্তব্য করেন - এইটা অবশ্য হইতে পারে । বসের ডেডলাইন মিস করলে একভাবে, না একভাবে ম্যানেজ করা যায়, কিন্তু কোন অকেশনে বউয়ের ডেডলাইন মিস করলে খবর আছে ।

রাত বেশি হয়ে গেছে বলে তেমন কিছু পাওয়া গেলো না । আমরা প্রথমে খেলাম বিট লবন আর গোল মরিচ দিয়ে হাফ বয়েলড সিদ্ধ ডিম । ওটার পর ধূমপায়ীজন আয়েসে ধরালেন সিগারেট । তারপর নিজেদের পছন্দমতো তিনটা আঁখ বাছাই করে আঁখের রস । চটপটি ওয়ালারা চলে গেছে । হালিমের ডেকচিতে উঁকি দিয়ে হালিমের চেহারা - ছবি ভালো লাগলো না । থাকুক, হালিমের বদলে সিটি সেন্টারের নিচে চাচার ঝালমুড়ি খাওয়া যেতে পারে ... রাতের নীরব হয়ে আসা মতিঝিল দিয়ে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে । গিয়ে দেখি চাচা বেঁচা - বিক্রি শেষ করে দোকান গোছাচ্ছেন । হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ গল্প করি দাড়িয়ে দাড়িয়ে । প্রোমোশন - ইনক্রিমেন্টের গল্প, গ্রামের বাড়ির মিষ্টি পাট শাকের গল্প, ডুব সাঁতার দিয়ে উঠে মুখের সামনে সাপ দেখার গল্প, জামাকাপড়ে উত্তোরোত্তর আঁটসাট ভাব ও স্বচ্ছ অংশের পরিমান বাড়িয়ে চলে, সচেতন অসচেতনতায় কাঁধের কালো, ব্রাউন বা মেরুন রঙের ফিতে নিয়মিত দৃশ্যমান করে রেখে ও নানা প্রসাধণের প্রলেপে আবেদনময়ী হতে চাওয়ার প্রানান্তকর চেষ্টা করেও ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলা পরিচিত কোন তরুনীর গল্প, কিংবা এমন পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার গল্প যার চুড়োয় দাড়ালে ধোঁয়াটে মেঘ ঘিরে ফেলে সারা শরীর - যে মেঘ হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, আবার যায়ও না ।

হুট করে এক টুকরো বিষন্ন মন্তব্য আসে - আজকের দিনটাও শেষ হয়ে গেলো ।
আমি হেসে বলি - ভাই, বছরটাই তো শেষ হয়ে গেলো ।
- সময় যে কোনদিক দিয়ে যায় বুঝি না ।
- সময় আসলে চলে যাওয়ারই জিনিস ... চলেই যায় ।
যাচ্ছে যাক ... চলে যাওয়া নিয়ে ভাবার অবসর কই? আমার বদলে আপাতত আমার শেলফে অলস সময় কাটিয়ে চলা হুমায়ুন, কুন্ডেরা, মুরাকামি, অরুন্ধতীরা বরং যৌথভাবে ভেবে চলুক বহমান নিস্তরঙ্গ এ সময়ের চলে যাওয়া নিয়ে । কখনো অবসর এলে তখন আমার না হয় ভাবা যাবে ।

" ... সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;
অমিতা কি মিহিজামে?
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই ।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয় । "
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×