তোমার এ গল্পটার মতো প্রায় একডজন গল্প আমি এখনি লিখে দিতে পারি।
আচ্ছা, এতদূর?... তার মানে তুমি বলতে চাইছো গল্প লেখাটা একটা মামুলি ব্যাপার?
তা নয়তো কি? এর থেকে সহজ কিছু আর আছে নাকি? থাকলে তো তুমি সেটাই করতে, তুমি যেরকম অলস।
আচ্ছা, আচ্ছা, দাঁড়াও। এতো সহজ কাজ মনে করো না। পারলে একটা গল্প লিখে দেখাও দেখি।?
সহজ নয়তো কি? খুব সহজ। কতগুলো চরিত্র নিলাম আর তারপর তাদের মধ্যে একটা কাহিনী ঘটিয়ে দিলাম। এই ধরো যেসব কাহিনী সচরাচর ঘটে থাকে। প্রেম, ভালোবাসা অথবা অন্যকিছু। মনে করো, কেউ কারো টাকা চুরি করে পালালো, অথবা ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তির জন্য মারামারি কিংবা সবাইকে একেবারে অপ্রস্তুত করে দিয়ে হঠাৎ ঘটিয়ে দিলাম কোনো দূর্ঘটনা। তারপর ওই নিয়ে কিছুক্ষণ এটাসেটা বললাম। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল একটা গল্প। কি ব্যাপার, তুমি হাসছো কেন?
তোমার গল্পের কথা শুনলে যে কেউ হাসবে।
দ্যাখো, আমাকে চটিওনা বলে দিচ্ছি। খুব খারাপ হবে কিন্তু?
কি করবে শুনি, কালকের মতো আবারো কি মুখে বালিশ ছুড়ে মারবে নাকি?
না। তার চেয়ে ভয়াবহ কিছু করবো?
কি?
রাতে ভাত বন্ধ করে দেব আর বিছানায় কাছেও ঘেঁষতে দেবো না। তখন বুঝবে মজা।
আচ্ছা আচ্ছা বাবা, এই কানে ধরলাম। আর হাসবো না। এবার খুশি তো?
শোনো?
কি?
মাঝে মাঝে আমারো না তোমার মতো গল্প আর কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, লিখতে গেলে কি কি থাকতে হয়?
একেকজন লেখক একেকটা ব্যাপারকে গুরুত্ব দেয়। যেমন আমি বলি, লিখতে গেলে কমপক্ষে দুটো জিনিস থাকতে হয়।
মাত্র দুটো? কি কি?
ভাষা আর উপস্থাপনা।
ভাষা? এটা আবার কেমন কথা? আমি কি ভাষা জানি না নাকি?
ভাষা তো সবাই জানে। কিন্তু আমি সে ভাষার কথা বলছি না। আমি বলছি যে ভাষাটা তোমার নিজস্ব সেটার কথা। যেমন তোমার হাসিটা একান্তই তোমার নিজস্ব। তোমার আচরণ অথবা এই যে হুট করে আমার উপর চটে যাও যখনতখন এটাও তোমার একটা নিজস্বতা।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো তোমার পণ্ডিতের মতো বকবকানি। আর কি বললে? আমি তোমার উপর যখনতখন চটে যাই? এক্ষনি নামো তুমি বিছানা থেকে, তোমার চেহারা যেন আজকে রাতে আর না দেখি। যাও ড্রয়িং রুমে যেয়ে ঘুমাও।
দেখলে দেখলে, আমার কথা প্রমাণ হয়ে গেলো তো।
কি প্রমাণ হয়ে গেলো? আমি কখন চটে গেলাম? আজব তো! ভালোভাবেই তো বললাম যে, যাও ড্রয়িং রুমে যেয়ে ঘুমাও। আচ্ছা, ঠিক আছে বাদ দাও। এবার বলো, তুমি বলো কি যেন বলছিলে?
বলছিলাম ভাষার কথা। যেমন পাখির কথা ধরো। প্রত্যেক পাখির নিজস্ব একটা ভাষা আছে। ডাক শুনলেই আমরা বুঝতে পারি কোনটা কোকিল আর কোনটা কাক। সেরকম গল্পকার, কবি, সাহিত্যিক প্রত্যেকেরও নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। সেই ভাষা শুনলেই আমরা বুঝতে পারি কার লেখা। বোঝা যায় লেখায় মাধুর্য আছে নাকি নিতান্তই নিরস কর্কশ লেখা।
ধুর ছাই ! কি মাথামুণ্ডু বলো কিচ্ছু বুঝি না। কথা সহজ করে বলতে পারো না তুমি?
আচ্ছা, সহজ করেই বলছি শোনো । তার আগে জানালার কাছে চলো।
জানালার কাছে কি?
চলোই না?
হুম, চলো।
জানালাটা খুলে দাও?
দিলাম।
কি দেখতে পাচ্ছো?
কি দেখতে পাবো? বাইরে তো অন্ধকার।
উপরের আকাশে তাকাও।
তাকালাম।
এবার বলো, কি দেখতে পাচ্ছো?
কি আবার? চাঁদ দেখতে পাচ্ছি।
এই হলো তোমার ভাষা। একদম ডাইরেক্ট অ্যাকশন। আমি হলে এটা কিভাবে কবিতায় লিখবো জানো?
কিভাবে?
আমি লিখবো - জানালায় খুলি বন্ধ কপাট এই ঘরে আমি একা
রোজ রাতে তবু চন্দ্রের সাথে নিয়মিত হয় দেখা।
বাহ, খুব সুন্দর লাগলো তো। এভাবে তো ভাবিনি।
হ্যাঁ, এটাই। এটাই আমার কবিতার ভাষা। আর তোমার ভাষা হলো ‘চাঁদ দেখতে পাচ্ছি’। ফালতু কোথাকার!
কি? কি বললে? আমার ভাষা ফালতু? দাঁড়াও তোমার চেয়ে সুন্দর লিখব আমি।
সে লিখো। তার আগে বলো ভাষা আর উপস্থাপনার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছোঁ? উপস্থাপনার জন্যই কিন্তু কোনোটা হবে কবিতা, কোনোটা হয়ে উঠবে গল্প আবার কোনোটা হবে বিশাল উপন্যাস। তবে উপন্যাসে চরিত্র থাকে বেশি কাহিনী হয় বিস্তৃত ঘটনাবহুল। অন্যদিকে গল্প হয় অল্প চরিত্র নিয়ে কোনো একটা বা দুটো নির্দিষ্ট ঘটনাকে লক্ষ্য করে।
আর কবিতা?
কবিতায় থাকে ভাব। আবেগ। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আবেগ নয়। যা ইচ্ছা তাই নয়। অনিয়ন্ত্রিত আবেগে কবিতা সৌন্দর্য হারায়। তাই আবেগ হতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত। পাঠকের সাথে যাতে সাবলীলভাবে কমিউনিকেট করা যায়; বুঝলে?
হুম, বুঝলাম। তবে তুমি কিন্তু মিথ্যে বলেছো?
কখন মিথ্যে বললাম?
ওই যে বললে, জানালায় খুলি বন্ধ কপাট এই ঘরে আমি একা। তুমি কি একা? এই যে আমি আছি তোমার পাশে।
হ্যাঁ, তুমি তো আছোই। কিন্তু কবিতাটা যে পড়বে তার পাশে তো কেউ নাও থাকতে পারে। পাশে কেউ থাকলে কি আর গল্প-কবিতা পড়ার প্রয়োজন হয়? তাই আমি অনুভূতি সম্প্রসারিত করে দিলাম। মানে পাঠকের অনুভূতির সাথে আমি নিজেকে মিশিয়ে দিলাম। এটাকে ‘মিথ্যে’ বলে না। এটা শিল্পের সৌন্দর্য। আচ্ছা তুমিই বলো, বিষপানে কারো মৃত্যু যন্ত্রণার কষ্ট তোমার গল্পে তুলে আনতে চাইলে তুমি কি বিষ খেয়ে দেখতে যাবে? বরং তুমি যন্ত্রণার কষ্টটা কল্পনায় ভেবে নেবে। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। সাহিত্যিক যদি সব সত্যি সত্যি লিখবে তাহলে সে পত্রিকায় রিপোর্টারের চাকই নিলেই পারে, গল্প কবিতা লেখা কেন।
হুম, বুঝলাম।
কি বুঝলে বলো?
বুঝলাম তাকালে হবে না দেখতে হবে; শুনলে হবে না ভাবতে হবে।
এখন বলো, চাঁদের পাশে কি দেখছো?
দেখছি, - চাঁদের পাশে মেঘের ভেলা আমরা দুজন সাথী
অনন্তলোক অম্বর পানে তুলিয়াছি আজ আঁখি
বাহ, চমৎকার। তোমার ভাষা আর উপস্থাপনা তো আমার থেকেও কাব্যিক হয়ে উঠছে। তবে একটা যায়গায় একটু সমস্যা আছে।
সমস্যা! সমস্যা কোথায় দেখলে?
দেখো, প্রথম লাইনটা খুব সুন্দর বলেছো। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে এসে ক্রিয়াপদের ব্যবহারটা করেছো সেকেলে স্টাইলে। মানে ‘তুলিয়াছি’ না বলে যদি বলতে তুলেছি দীঘল আঁখি, তবে আরো সুন্দর হতো। অথবা যদি বলতে, মহাশূন্যের শূন্যতা মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছি আঁখি – তাহলে আরো আকর্ষণীয় হতো।
ছাই হতো! আমাকে বোকা পেয়ে নিজের জ্ঞান জাহির করছো তাইনা?
মোটেই না। আচ্ছা তুমিই শোনো, চাঁদের পাশে মেঘের ভেলা আমরা দুজন সাথী / মহাশূন্যের শূন্যতা মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছি আঁখি ... এটা শুনতে কেমন ভালো। কিন্তু তোমারটা শুনলে মনে হবে অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ঢঙে লেখা। ভারী ভারী শব্দ ব্যবহার করা অবশ্যই যাবে কিন্তু সেটা যখন সিচুয়েশন ডিম্যান্ড করবে তখন। তুমি প্রথম লাইনে সাবলীল কিছু শব্দ লিখে পরে নিশ্চয়ই ভারী উচ্চারণের শব্দ ব্যবহার করতে পারো না।
কেন পারি না?
কারণ সেটা শ্রুতিমধুর হয় না। আবার শুতিমধুর হলেও দেখা যায় ভাষা হয়ে গেছে অন্য লেখকের মতো। স্বকীয়তা থাকে না বুঝলে?
হইছে, আমার পণ্ডিত। চুপ করো এখন।
কেন? চুপ করবো কেন?
চুপ। একটাও কথা বলবা না।
এই শোনো, তাকাও না আমার দিকে?
নাহ, জ্বালাতন করো না তো। চাঁদ দেখতে দাও।
আমিই নিয়ে আসলাম জানালার কাছে। আর এখন আমাকেই উপেক্ষা? এই, কি হলো, কথা বলো না কেন?
বলছি তো।
কি ভাবছো এতো?
তোমার আজকের গল্পটার কথা ভাবছি। আচ্ছা, তুমি নায়ক আর নায়িকার মধ্যে এইরকম ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে দিলে কেন?
কেন দেব না? ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ, অভিমান এগুলো ছাড়া কি সম্পর্ক হয়?
হবে না কেন, ...আমি কি কখনো তোমাকে ভুল বুঝি?
বোঝোনা?
না তো।
তাহলে গতমাসে যে অফিস থেকে পিকনিকে গেলাম সেটা নিয়ে রাগারাগি করে টানা দুই দিন আমার সাথে কথাই বললে না, সেটা কি?
ওইটা তো তোমার দোষ। যে পিকনিকে ওয়াইফকে নেওয়া যাবে না সেখানে যাওয়া লাগবে কেন?
তুমি কি আমার অফিসের কলিগ যে তোমাকে নিয়ে যাবো? ওইটা তো কলিগদের জন্য শুধু।
না, তবুও তুমি যাবে না। আমি ঘরে বসে থাকবো আর উনি যাবেন কলিগদের সাথে পিকনিকে? আহা, কতো আনন্দ! আমাকে ছাড়া আর কোনোদিন যদি কোথাও যাও তাহলে তোমার সাথে আর কথাই বলবো না।
আচ্ছা, তাই? না কথা বলে থাকতে পারবে?
হ্যাঁ, খুব পারবো?
কতোদিন?
জানিনা। চুপ করো তো এখন।
আচ্ছা, শোনো?
তুমিই না চুপ করে থাকতে বললে। এখন আবার কি?
শোনোই না?
বলো।
আচ্ছা, তোমার গল্পটার শেষটা ওরকম হলো কেন?
কি রকম?
এই যে, একটা রেস্টুরেন্টে অনেক বছর পর হঠাৎ করে আবার ওদের দু’জনের মধ্যে দেখা হয়ে গেল। আর তাঁদের চোখাচোখি হতেই হুট করে তুমি গল্পটার সমাপ্তি টেনে দিলে।
কেন এমন করেছি জানো?
কেন?
ভুলবোঝাবুঝি যদি বেশি হয় তাহলে তার পরিণাম এমনটাই হয়। দু’জন দুদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আলাদা আলাদা সংসার হয় তাদের। জীবন কেটে যায় কিন্তু সুখ থাকে না। কারণ মনের মধ্যে একজনকে পুষে রেখে আরেকজনের সাথে বাস করে কোনোদিন সুখী হওয়া যায় না। এই ব্যাপারটাই আমি পাঠককে বোঝাতে চাইলাম। তাই অনেকবছর পর আবার তাদের টেনে নিয়ে একজায়গায় দাঁড় করালাম আর সাথে সাথেই পাঠক দেখতে পেল যে ছোট্ট একটা ভুলবোঝাবুঝি কিভাবে একটা শূন্যতার দেয়াল তৈরি করে দিতে পারে দুজন মানুষের মধ্যে। সচেতন পাঠকেরা সাবধান হবে। সম্পর্কিত মানুষগুলোর মধ্যকার বোঝাপড়াটা ভালো হবে। এটাও গল্পের একটা দিক ।
আচ্ছা, কি কি নিয়ে গল্প লেখা যায়?
সবকিছু নিয়েই গল্প লেখা যায়। মানুষ, পশু, পাখি। মন, মানসিকতা, সম্পর্ক। চেয়ার, আলমারি, শোকেস। দারিদ্র, ক্ষুধা, ঐশ্বর্য। কাছে আসা, দূরে যাওয়া সবকিছু। এমনকি একটা ভাঙা চায়ের কাপ কিংবা রাস্তায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক-বোতল নিয়েও গল্প লেখা যায়।
আচ্ছা, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে একটা গল্প লেখা যায় না?
হ্যাঁ, যাবে না কেন? অবশ্যই যায়। এই যে তুমি আমি এতক্ষণ গল্প-কবিতা নিয়ে কথা বললাম, চাঁদ দেখলাম; এটা নিয়েও কিন্তু একটা গল্প লিখে ফেলা যায়।
তাই?
হ্যাঁ।
তাহলে লেখ না একটা গল্প আমাদের দুজনকে নিয়ে। লিখবে বলো?
আচ্ছা লিখবো। গল্পের নাম কি হবে - সেটা তাহলে তুমি ঠিক করে দাও।
নাম হবে, গল্প ও কবিতার গল্প।
আচ্ছা, এখন চলো ক্ষুধা পেয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৪ রাত ১২:৩৭