পরিচিতি:
নাম যুবাইর, উপনাম আবূ আবদুল্লাহ, বিশেষ উপাধি ‘হাওয়ারিয়্যূ রসূলিল্লাহ’। পিতার নাম ‘আওওয়াম, মাতার নাম সাফিয়্যা বিন্তু আবদিল মুক্তালিব। হযরত সাফিয়্যা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার আপন ফুফু। সুতরাং হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ফুফাতো ভাই। উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ছিলেন উনার ফুফু। অন্যদিকে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর কন্যা হযরত আসমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে তিনি বিয়ে করেন। এভাবে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে ছিল উনার একাধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক।
বিলাদত শরীফ:
হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হিজরতের ২৮ বছর পূর্বে বিলাদত লাভ করেন। শৈশবকাল থেকে উনার মাতা তাঁকে এমনভাবে প্রতিপালন করেছিলেন, যাতে বড় হয়ে তিনি একজন সাহসী, দৃঢ় সংকল্প আত্ম্য প্রত্যয়ী মানুষ হন।
ইসলাম গ্রহণ:
প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য এবং বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। উনার বয়স যখন ১৫ অথবা ১৬ বৎসর তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পরেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এদিক দিয়ে তিনি ইসলামে ৪র্থ বা ৫ম ব্যক্তি। তিনি প্রথমে এবং পরে মদীনা শরীফে হিজরত করেন । মক্কা শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন। মদীনা শরীফে হিজরতের পরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সালমা ইবনে সালামাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক করে দেন। (উসুদুল গাবা)
শাহাদত বরণ:
হিজরী জুমাদাল উখ্রা বছরার অনতিদূরে ‘যীকার’ নামক স্থানে দুই মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয়। ইতিহাসে এটি উষ্ট্রের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ উষ্ট্রের যুদ্ধই ছিল উনার শাহাদতের মূল কারণ। যদিও তিনি শুরুতেই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্য অন্য কোথাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন' পথিমধ্যে ইহুদী ইবনে সাবার গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতক ইবনে জারমুয হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে যুহরের নামায আদায়কালে শহীদ করে। তিনি হিজরী ৩৬ সনে শাহাদত বরণ করেন এবং আস-সিবা উপত্যকায় সমাহিত হন। তিনি ৬৪ বছর হায়াত লাভ করেছিলেন। (কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড)
হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর ফযীলত ও মর্যাদা:
হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন অত্যন্ত মহৎ চরিত্রের অধিকারী। তাক্বওয়া, সত্য-প্রীতি, দানশীলতা, উদারতা ও বেপরোয়াভাব ছিল উনার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। শিশুদের মত উনার অন্তর ছিল কোমল। সামন্য ব্যাপারেই তিনি মোমের মত বিগলিত হয়ে যেতেন। উনার সততা, আমানতদারী, পরিচালন ক্ষমতা ও সংগঠন যোগ্যতা ছিল অসাধারণ। ইন্তিকালের সময় লোকেরা তাঁকে আপন আপন সন্তান সন্ততি ও ধন সম্পদের যিম্মাদার বানাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন। ফারুক্বে আ‘যম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দ্বীনের একটি রুকন বা স্তম্ভ।
তিনিই প্রথম আল্লাহ পাক-উনার পথে তরবারী ধারণ করেছিলেন। এর কারণ ছিল এই যে মুসলমানগণ যখন মক্কা শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে ছিলেন, তখন খবর ছড়াল যে কাফিরেরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ধৃত করেছে। তখন যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু তরবারী হাতে নিয়ে লোকজন ভেদ করে দ্রুত অগ্রসর হলেন এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে ছিলেন সেখানে উপসি'ত হলে তিনি বললেন: তোমার কি হয়েছে? হে যুবাইর! হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আমি শুনেছি আপনাকে ধৃত করা হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন উনার জন্য এবং উনার তরবারীর জন্য দোয়া করলেন। (উসুদুল গাবা)
বদরের জিহাদে উনার মাথায় ঘিয়া রং এর পাগড়ী ছিল এবং বর্ণিত আছে যে, ফেরেস্তাগণ এ জিহাদে উনার ছূরতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। (উসুদুল গাবা) অতঃপর তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সকল জিহাদ যেমন, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া, খয়বর, হুনাইন, তায়েফ ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার পরবর্তী খলীফা মনোনয়নের জন্য যে ছয় সদস্য বিশিষ্ট মজলিসে শুরা (উপদেষ্টা পরিষদ) গঠন করেছিলেন, তন্মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। (উসুদুল গাবা)
যখন মুশরিকরা উহুদের জিহাদ পরিত্যাগ করে চলে গেল, এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ছাহাবা কিরামগণ যে সব মুছিবত ও কষ্টে নিপতিত হয়েছিলেন তা অতিক্রম হলো, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা করলেন, মুশরিকরা আবার ফিরে আসতে পারে। তিনি ইরশাদ করলেন: তাদের (মুশরিকদের) পেছনে (ধাওয়া করার জন্য) কে এদের (একদল ছাহাবী) প্রতিনিধিত্ব করবে, যেন তারা (মুশরিকরা) জানতে পারে যে, আমরা শক্তিশালী। অতঃপর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু -এর প্রতিনিধিত্বে সত্তর জন ছাহাবী মুশরিকদের পিছু ধাওয়া করলেন। মুশরিকরা জানতে পেরে তাড়াতাড়ি প্রস্থান করল। তৎপর আল্লাহ পাক নাযিল করলেন: (অর্থ) তারা আল্লাহ পাকের নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করে ফিরে আসল এবং কোন অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেনি)। (সুরা আলে ইমরান-১৭৪) অর্থাৎ শত্রুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাত হয় নি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
বদান্যতা, দানশীলতা ও আল্লাহ পাক-উনার রাস্তায় খরচের ব্যাপারে তিনি অন্য কারো থেকে কখনো পিছিয়ে থাকতেন না। উনার এক হাজার গোলাম ছিল। প্রতিদিন তিনি তাদের ভাড়া খাটিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ করতেন। কিন' তার একটি পয়সাও নিজের বা পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করতেন না। সবই বিলিয়ে দিতেন।
আল্লাহ পাক-উনার হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবীর একজন হাওয়ারী থাকে, আমার হাওয়ারী যুবাইর ইবনে আওওয়াম। (উসুদুল গাবা) (হাওয়ারী অর্থ: সাহায্যকারী, বন্ধু, সব কাজে বিশেষ সঙ্গী)। মোট কথা, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার একজন হাওয়ারীর মধ্যে যত রকমের গুণ থাকা সম্ভব, সবই হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মধ্যে ছিল।
হযরত যুবাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সবচেয়ে বড় পরিচয় ও সৌভাগ্য এই যে, তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারা অর্থাৎ দুনিয়াতে জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রাপ্ত দশজন ছাহাবীর একজন। (কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড)