আমার বাবা ছিলেন একজন বহির্মূখী মানুষ, এঙ্ট্রো্রভার্ট । আমাদের বংশে কেউ খালাসী পেশায় না থাকলে ও আমার বাবা খালাসী হয়েছিলেন কলম্বাস হওয়ার জন্য। শহর-বিচিছন্ন মুন্সীগঞ্জের কোর্ট গা্ঁওয়ের মত অজ পাডাগাঁ থেকে বেডিয়ে পডেছিলেন বঙ্গোপ সাগর,ভারত মহা সাগর এবং অতলানতিক মহা সাগর পাডি দিয়ে কলম্বাসের নূতন দেশ আমেরিকা দেখার উল্লাসে । আমার বাবার বাবার বংশ পদবী ছিলো শেখ । আমার প্রথম মা, যিনি মোল্লা বংশের আমার বড নানা হদু মোল্লার একমাত্র উত্তরাধিকারী,মারা গেলে (এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে) আমার বাবা এক বিশাল সমপত্তির মালিক হন । চার-পাঁচ বিঘা বাডীর অর্ধেক এবং পরিমান রা জানা চাষের জমির অর্ধেক তার অধিকারে আসে । বড মা মারা গেলে বাবা তার পৈতৃক বাডী শিলমন্দিও নগণ্য অধিকার ছুডে ফেলে চলে আসেন আমার আপন 4 মামার তাদেও উত্তরাধিকারবিহীন মৃত চাচার পাশের বাডীতে । এখান থেকেই তিনি একদিন নিরূদ্দেশ হন সমুদ্রগামী জাহাজের খালাসী হয়ে । তার সংগে তার সমবয়সী এক বন্ধু ছিলেন । তার নাম গাইজুদ্দিন । মুন্সীগঞ্জের এ ভি জে এম গার্লস হাই স্কুলের পাশেই ছিল তার বাডী । তারা দুই বন্ধু ভাসতে ভাসতে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ইউরোপ হয়ে চলে যান আমেরিকার যুক্তরাস্ট্রের নিউ ইয়র্ক বন্দরে । বাবার মুখেই প্রথম শুনি নিউ ইয়র্কের ইলিস আইল্যান্ড, স্টেচু অব লিবার্টি ও 110 তলা দালান এমপায়ার সটেট বিল্ডিংয়ের কথা । তার মুখেই শুনি 1912 সালে টাইটানিক জাহাজের সলিল সমাধির গল্প । তাই 1996 সালে প্রথম যখন নিউ ইয়র্কে যাই , বাবার গল্পের সেই 110 তলা ভবনের 102 তলায় উঠে নিউ ইয়র্ককে দেখি চতুর্দিকে বসানো আলাদা আলাদা দূরবীন দিয়ে । শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের বানিজ্যিক দ্বীপ ম্যানহাটানের পশ্চিম উত্তর জুডে প্রবাহিত হাডসন রিভারের অপর তীরে অবস্থিত নিউ জার্সি স্টেট্রের 15/20 মাইল পর্যনত । বাবা বলেছিলেন আটলান্টিক তীর থেকে তারা ছোট জাহাজে হাডসন রিভার দিয়ে ইলিস আইল্যান্ডে যান শরীওে কোন রোগ আছে কিনা তা পরীা করার জন্য । সেখান থেকে 1000 গজ দূরে অবস্থিত স্টেচু অব লিবার্টি দেখেন । বাবা বলেছিলেন স্টেচুর উচচতা এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং এর সমানই হবে । রোগ-বালাই পরীার পর ইলিস আইল্যান্ড থেকে তাদের অনুমতি মিলে ম্যানহাটানে ঢোকার , 34 স্ট্রীটে এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং এ ওঠার ।
1998 সালে হলিউডের নির্বাক যুগের নামকরা চিত্র তারকা,পরবর্তীতে বিখ্যাত ফ্যাশন ও ইনটেরিয়র ডিজাইনার বার বারা ব্যারোন্ডেস ম্যাকলেইন 93 বৎসর বয়সে আমাকে একই রকম গল্প বলেন আট বছর বয়সে রাশিয়া থেকে তার নিউ ইয়র্কের ব্রূকলিনে ফিরে আসার গল্প শোনাতে গিয়ে । বার বারার সাথে আমার পরিচয় মেয়ের জামাইয়ের মারফত ম্যানহাটানের 57 স্ট্রীটে । বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশের মানুষ হয়ে ও আমি হেমিংওয়ের মত বিখ্যাত লেখকের বই পডেছি শুনে তিনি প্রীত হয়ে আমাকে তার নিজ হাতে বেস্ট উইশেস লিখে তার আত্ম জীবনীর প্রথম খন্ডের এক কপি উপহার দেন।এবং কথা ছিল পরের বার যখন আমি নিউ ইয়র্কে যাব তখন তিনি তার আত্ম-জীবনীর দ্বিতীয় খন্ড খুজে বেড করে রাখবেন আমার জন্য । কিন্তু আমার সেই সৌভাগ্য হবার দুই বছর পূর্বে, 2000 সালের এপ্রিল মাসের 30 তারিখে তিনি শেষ নি:শ্ব্বাস ত্যাগ করেন । তিনি নি:সনতান ছিলেন । তাই দুই হাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দান করে গেছেন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে । তার বাবা ছিলেন এক রাশিয়ান লাম্বার কিং এর সনতান । নিউ ইয়র্কে বেডাতে এসে প্রেমে পডে যান ব্রূকলিনের এক পত্রিকা হকারের মেয়ের । ব্রূকলিনে একটি ছোট্ট মুদি দোকান চালাতেন তার বাবা । যার কারণে অপূর্ব সুন্দরী বার বারা 16/17 বছর বয়সে ম্যানহাটানের ব্রডওয়ের থিয়েটার পাডায় খুঁজে ফিরতে হয় নাটকের একটি পাশর্্ব চরিত্র বাবাকে সাহায্য করতে । এর আগে গলায় বাঁধার টাই ফেরি করে বিক্রি করেছিলেন বড বড স্টোরে । তিনি হেমিংওয়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হয়েছিলেন তার সাহিত্য প্রীতির জন্য। তার বইয়ের প্রকাশক মুখবন্ধে লিখেছিলেন - বার বারা যদি তার তিন পেশার একটিতে ও জডিত না থাকতেন ,তিনি তার আত্মজীবনীর জন্য বেঁচে থাকতেন সাহিত্য সার্কেলে । এই বই তাকে স্মরণীয় করে রাখতো মার্কিনীদের কাছে ।
আমার বাবা মরহূম আবদুল ওয়াহাব পটেটোকে বলতেন পাটাটো,ওয়াটারকে বলতেন ওয়াডার ,টুয়েন্টিকে বলতেন টুয়েন্ডি যেরূপ বর্তমানে ও আমেরিকানরা বলে থাকেন ।
আমার বাবা 1935 সালের দিকে জাহাজের চাকুরীতে ইসতফা দিয়ে চলে আসেন দেশে । অথচ তার বন্ধু গাইজুদ্দিন থেকে যান আমেরিকায় । তিনি একটি রাঞ্চের মালিক হন শেষ জীবনে । তার ছেলেরা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পডান । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনাব গাইজুদ্দিন তার গরীব আত্মীয়-স্বজনদেরকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য দেশে এসে আপন কাউকে পেতে ব্যর্থ হন ।
দেশে এসে আমার বাবা তার অর্ধেক বয়সী চাচাত শালী, আমার মাকে, বিয়ে করেন এবং বছর তিনেক পর আবার তিনি উধাও হয়ে যান । এবার ইউরোপে । বহির্মূখী মানুষদের নিয়ে এটাই বড সমস্যা পরিবারের । সেখানে কয়েক বছর জাহাজে চাকুরী করে তিনি ফিরে আসেন কলিকাতা বন্দরে । তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণদামামা বাজছে উচচ রাগে । কলিকাতা থেকে চিঠি লেখেন বাঁচার কোন ্উপায় নেই । জাপানী বোমায় যে কোন সময় ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে ।
আমার জন্ম সম্ভবত: 1938 সালের শেষদিকে । যদিও স্কুলের খাতায় আমার জন্ম তারিখ লেখা হয়েছিল 1লা ডিসেম্বর ,1940 । 1938 এর মাঝামাঝি থেকে 1945 সাল পর্যনত বাবার কোন হদিস ছিল না । সবাই ধরে নিয়েছিলেন তার মৃত্যু ঘটেছে । আমার মাকে জোর করে সাদা শাডী পডানো হয়েছিলো । হিন্দু অধ্যুষিত আমাদের এলাকায় এ প্রচলনটি কঠিনভাবে মানা হতো ।
বাবা 1945 এর কোন এক সময় দেশে ফিরে আসেন । জাহাজে চাকুরীর ধারাবাহিকতায় মহকুমা শহরের ইংরেজ মহকুমা প্রশাসক তাকে তার খাস আর্দালী-কাম-বাবুর্চি করে ধরে রাখেন । তার ইংরেজদের সাথে কি ভাবে আদপ-কায়দা রা করতে হয় জানা ছিল বলে সাহেবদের কাছে খুব আদর লাভ করেন । আমার বয়স তখন সাত । এই সময়ের কোন স্মরণীয় ঘটনা আমার মনে নেই । তবে 1945 সালে ্িদ্বতীয় মহাযুদ্ধের ফলশ্রূতিতে অবিভক্ত বাংলায় যে দুর্ভি দেখা দেয় এবং আমাদের বাডীর পাশের খাল দিয়ে প্রচুর অনাহারে মৃত নারী-পুরূষের লাশ ভেসে য়েত সে কথা মনে আছে । যে লাশগুলি উবুর হয়ে ভেসে যেত সেগুলিকে বলা হতো মেয়ে ,আর চীৎ হয়ে ভেসে যাওয়াগুলিকে বলা হতো পুরূষের লাশ ।
1945 সালেই আমার পডালেখার সূত্রপাত ঘটে । মুন্সীগঞ্জের কালিবাডীর বিপরীত দিকে রাসতার পূব পাশে ছিল শহরের একমাত্র সিনেমা হল,'ছবিঘর' । তখন সিনেমাই ছিল শহুরে জীবনের একমাত্র বিনোদনের উপাদান । প্রতি সপ্তাহে নূতন নূতন মুম্বাই ও কলিকাতার হিন্দি-বাংলা সিনেমা রিলিজ হতো । বিখ্যাত সিনেমাসমূহের আগমন প্রচার চলতো একদেড বছর পূর্ব থেকে । এই সিনেমা হল 'ছবিঘরকে' ঘিরেই এটির আশপাশে গডে উঠে উন্নতমানের কয়েকটি রেসতোরা । এ সব রেসতোরায় সন্ধ্যা হলেই মানুষের ঢল নামতো । হলের সম্মুখে প্রচুর মানুষের সমাগম হতো । সিনেমা হল থেকে তৎকালিন মধ্য আওয়াজের সপিকারে 'ছাইয়া দিলমে আনারে ,আখে ফির না জানারে ' জাতীয় হিন্দি গান শোনা ছিল সৌখিন যুবা-বুডা মানুষের নিত্যদিনের নিষপাপ আনন্দ উপভোগের বিষয় ।
সিনেমা হলের পাশেই আমার মেঝো মামা আনোয়ার হোসেন মোল্লার একটি পান বিডির দোকান ছিল । এটা দেখা শোনা করতেন জটু নামে এক হিন্দু সৎ ও সরল মানুষ । সে মোটামুটি লেখা পডা জানতো । দোকানের হিসাব-পত্র রাখতেন এবং বসে বসে হাত দিয়ে টেন্ডু পাতা ও তামাকের সুখা ভরে দোকানের জন্য নামহীন ব্রান্ডের এক প্রকার বিডি বানাতেন । বিডি বানানো এবং বিডির সাথে পান ও কিছু মনোহারঢ দ্রব্য বিক্রি করা ছিল াের কাজ । এক সপ্তাহের বিডি জমা হলে দোকানের পিছনে ছবিঘরের পুকুরের ঢালে কলিকাতা থেকে আমদানীকৃত এক প্রকার উৎকৃষ্ট মানের কয়লা চুলায় জ্বালিয়ে উপওে বসানো লোহার তারের জালিতে বিডি শেকা হতো এবং সেই বিডিই পরবর্তী সপ্তাহ ধওে দোকানে বিক্রয় করা হতো । ঐ বিডির উপাদান মামা ঢাকার নর্থব্রূক হল রোড থেকে কিনে আনতেন দুই এক মাস পর পর ।
ক্রমে জটুর হাতে বানানো নাম-হীন বিডির অপূর্ব স্বাদেও খ্যাতি ছডিয়ে পডে মুন্সীগঞ্জ শহরের ধূমপায়ীদেও মধ্যে । তখন তাদেও চাহিদা মিটাতে নূতন কারিগড রেখে বেশী বেশী বিডি বানানো ও বিক্রি চলতে থাকে । এক পর্যায়ে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় মামা আরো কারিগড বসানোর জন্য একটি ছোট কারখানা ঘর স্থাপন করেন মাঠ পাডার কাঠের পুলের উত্তর-পূব কোণায় । এবং তার দোকানে বিক্রিত বিডির নাম দেয়া হয় মজনু বিডি । মজনু বিডি তখন পাইকারী বিক্রি হতে শুরূ করেছে । মজনু নামে মামার কোন আত্মীয় বা বন্ধু ছিল না । তবু তিনি কেন এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন তা আজও জানতে পারিনি । তবে মজনু বিডির প্রেমিকরা লাইলীর মত ওটাকে ভালবাসতো । পাগল হয়ে দূও দূরানত হতে খুচডা বিক্রেতারা মজনু বিডি কিনতে আসতো । দিঘির পাড, লৌহজং এমন কি নারায়নগঞ্জ হতে ও আসতো ।
পাগল করা মজনু বিডি মামাকে অচিরেই আকিজ মিয়া বানায়ে দিণ । তিনি বিডির চাহিদা সামাল দিতে লাইসেন্স নিয়ে কলিকাতা থেকে সরাসরি টেন্ডু পাতা ও তামাকের গুঁডা আমদান তে হাত দেন । এদিকে তার কারখানায় ও নূতন কারিগড বসাবার জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় তিনি বিডি পাতা ও সুখা এবং বকঁধার সূতা দিয়ে দিতেন গ্রামে গ্রামে মজনু বিডির জন্য নূতন গডে ওঠা কারিগড সমপ্রদায়ের হাতে । তারা হিসেব কওে কাঁচামাল নিতেন এবং গুণে গুণে বানানো বিডি কারখানায় সরবরাহ কওে পরবর্তী সপ্তাহের কাঁচামাল নিয়ে যেতেন । সংগে বানানো ও মজুতদেয়া বিডির মজুরী । তার এই বিডি শহরের আশেপাশের বহু নারী-পুরুষের অব্যবহৃত হাতকে উৎপাদনের হাতিয়ার করে তুলেছিল । তিনি ও হতে পারতেন একজন ড. ইউনুস গ্রামের আনাচে কানাচে অব্যবহৃত শতেক হাতকে কাজে লাগিয়ে । তার এই উদ্যোগ গ্রামের নারী-পুরুষের মাঝে ম্চছ্বব এনেছিলো 1965 সাল পর্য়নত। তারপর ভারতের সাথে পাকিস্থানের আগ্রাসী যুদ্ধ মামার এ ব্যবসা লাটে উঠে ভারতের টেন্ডু পাতার অভাবে ।
সেকালে মানুষ অলৌকিক ভাবে কোন গুপ্তধন পাওয়া ছাডা ধনী হৗয়ার কোন বিকল্প ভাবতে পারতো না । কিন্তু আমার মামার মজনু বিডি তাকে গুপ্তধনের চাইতে বেমী সম্পদ হিয়েছিলো , যা দিয়ে তিনি চলি্লশের হশকে ও শেষ দিকে একটি বিশাল তালুক কিনেন মুন্সীর হাটের পূবদিকে ।কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত: তালুক থেকে বছরখানেক খাজনা পাতি আদায়ের পরই জমিদারী প্রথা বিলোপ হয়ে যায় । শহওে কিনা তার পাকা বাডীর এক বিশাল কোটঅ বীথৃ তঅঝণঅ াঅধঅযৈল ভ।ী ।ষৈ সময় আমরা কাগজওয়ালাদেও কাছে সের দওে বিক্রি করেছি ।
মজনু বিডির ব্যবসার পাশাপাশি মামা নূতন নূতন ব্যবসায় হাত দেন । যেমন , তদানিনতন পূর্ব পাকিসতানের
জন্য তিনি হল্যান্ড থেকে প্রয়োজনীয় আলুবীজ একাই আমদানী করার লাইসেন্স পান । পূর্ব পাকিস্থানে এক মাত্র তাকেই সরকার এ দায়িত্বটি দিয়েছিল । মামার এ ব্যবসাটির আংশিক দেখতেন মোটামুটি শিতি তার বন্ধু হাবিব মামা । তিনি হল্যান্ডে গিয়ে পার্টি এবং শিপ ঠিক করা তার দায়িত্ব ছিল । মৌসুমে জাহাজ বোঝাই আলু বীজ নামানো হতো মুন্সীগঝ্জ লঞ্চ ঘাটের দেিণ বিসতির্ণ ধলেশ্বরীর 2/3 মাইল ঢালচ তীওে । সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সেই বীজ বিক্রি হয়ে যেত ।
ফিরে আসি আমার প্রসংগে । আমার যখন 8/9 বছর বয়স তখন আমি প্রায়ই যেতাম ছবিঘর সিনেমা হলের পাশে মামার পানবিডির দোকানে । এই দোকানটি ছিল আমাদের গৌরবের বিষয়্ । কারণ একটি কৃষক পরিবার ব্যবসায়ী পরিবারে রূপানতরিত হওয়ার টার্ণিপয়েন্ট এই ছোট ব্যবসাটি । প্রসংগত উল্লেখ্য তখন আমার এই মামা ও তার ছোটজন ছিলেন পিতৃমাতৃহীন এবং পৈত্রিক পেশা থেকে বিচচ্যুত । সামান্য লেখাপডা শিখতে গিয়ে তাদের এ বিচচ্যুতি ঘটে । তাদের দেখাশোনাব দায়িত্ব আমার মায়ের উপর বর্তায় । আমাদের একটি ঘরেই তারা থাকতেন । বলা বাহূল্য, আমাদের ঘরেই তাদের দুই বেলা খাওয়া দাওয়া হতো । মেঝো মামা বিয়ে করে মামীকে আমাদের এ ঘরেই উঠান । বিয়ের কয়েক বছর পর তার ব্যবসার উন্নতি ঘটলে তার পৈতৃক বাডীর একাংশে ঘর করে উঠে যান । যাক সে কথা । দোকানে বসে মানুষের সমাগম,পথচলার ব্যসততা ও নানা ধরনের চেহারা আমাকে খুবই আনন্দ দিত । তাই বসে বসে জটুকে পান-বিডি বিক্রয়ে সাহায্য করতাম । এক সময় এটা আমার দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে গেল । আমার মামা সম্ভবত: আমার এই ব্যবসায়ী মনোভাব দেখে খুশীই হয়েছিলেন । তার মত চাষ-বাস বাদ দিয়ে ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিই এটাই বোধহয় তার মৃদু বাসনা ছিল । তাই তিনি আমার পানবিডির দোকানী হতে বকঁধা দেননি । কিছুদিনের মধ্যেই আমি পানবিডি বেচায় পাকা হয়ে গেলাম । সাধারনত দুপুরের দিকে দোকানে বেচাকিনি কম থাকতো । অবসর সময়ে জটু আমাকে নানা গল্প শোনাতেন । তার জানা ঠাকুর মা'র ঝুলি-র গল্প ,মাঝে মাঝে 'পাখীসব করে রব' কবিতা এবং আদর্শ লিপি হতে অ-তে অসৎ সংগ ত্যাগ কর , আ-তে আলস্য দোষের আকর ইত্যাদি বিষয়ে গল্প । পাখিসব কবিতাটি আমার খুব ভাল লাগতো । একদিন আদর্শ লিপি কিনা হলো ঐ কবিতাটি স্বচ েদেখার জন্য । সেই আদর্শ লিপি ও আমার প্রথম গুরু জটু (এ কথাগুলি লিখতে লিখতে আমার দু্থচোখ বেয়ে অশ্রু ঝডছে অনেক দিন আগে প্রয়াত জটুকে স্মরণ করে ) আমাকে এক অন্য জগতের দিশা দেখালো । আমার জীবনে জটুর আবির্ভাব না ঘটলে আমি একদিন বাংলাদেশ সরকারের একটি উন্নত দেশের ক্থটনৈতিক মিশনে ভার-প্রাপ্ত রাস্ট্রদূত (অনতবর্তীকালীন) হতে পারতাম কিনা তা কে জানে ! ছয় মাসেই আমার আদর্শ লিপি পডা শেষ হয়ে গেল । সেই সংগে যোগ-বিয়োগ পূরণ-ভাগ ও । আমি যে আমার মায়ের ভবিষ্যৎ চাষীকে হত্যা করছিলাম সে কথা আমার নিকট আত্মীয়রা , এমন কি মামা ও জানতেন না । আমি ও আমার খেলার ছলে যে পডা শিখা হচোছ এ ব্যাপাওে মোটেই সচেতন ছিলাম না । ঐ আমলে ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত হাতে গোনা দু'একটি মুসলিম পরিবার ও ভদ্রলোক হিন্দু পরিবার ব্যতীত অন্যরা কোন পরিকল্পনা করতো বলে আমার মনে হতো না । জীবন নৌকা উতাল বাতাসে যে ঘাটেই ভিডুক তাতেই সাধারণ মানুষ খুশী । খুব কম মানুষই তখন উচচাশা বা পরিকল্পনা মাফিক ক্যারিয়ার গঠনে মনোনিবেশ করতো ।
আদর্শ লিপি পডে আমার পাখা গজাতে লাগঅো । শিয়ালের বাচচাদের মতো আমি আমার নিজস্ব গর্ত হতে মাঝে মাঝে উঁকি মেওে আলোর জগৎ দেখতাম । এই কৌতুহল আমাকে একহিন টেনে নিয়ে গেল মুন্সীগঞ্জ শহরের কালিবাডীর বিশাল মন্ডপের এককোণায় এক টিকিধারী পন্ডিত মশায়ের পাঠশালায় । সেখানে দেখতে পেলাম আমার বয়সী এবং আমার চাইতে 2/3 বছরের ছোট ছোট ছেলে -মেয়েরা পরিপাটি জামা-কাপড পডে নামতা পডছে । বিভিন্ন শব্দের বানান মুখসত করছে ও লিখছে । আর টিফিনের সময়ে দলবেঁধে মন্ডপের ভিতরেই শুধুশুধি দৌডাদৌডী করছে । তাদের এই প্রানোচছ্বাস আমাকে ও হাত ছানি দিয়ে ডেকে নিল । জটুকে বলে পন্ডিত মশায়ের কাছে সুপারিশ করালাম -- দু'একজন মুসলমান ছেলের সাথে মাসে আট আনা বেতন নিয়মিত পরিশোধের শর্তে আমার নামটি ও তার স্কুলে লিখে নিতে । আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম । সম্ভবত: বয়স একটু বেশী হওয়ায়ই যে কোন বিষয় আমার কাছে খুব কঠিন মনে হতো না । সব বাংলা বানান আদর্শ লিপির বদৌলতে,অংক ও ইংরেজী জটুর অকৃপণ বিদ্যা বিতরনের কৃপায় অবলীলায় নির্ভুলভাবে করতে পারতাম । তাই আমার বন্ধু জুটে গেল তিন চারটি বডলোক হিন্দু সহপাঠী । তাদের একজন ছিল মেয়ে । তৎকালে তুখোর বাক্যবাগিশ মোক্তার জিতেন চক্রবর্তীর বড মেয়ে । তার নাম মনে নেই । তবে পরবর্তীতে সে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর মি: এ.টি গাঙ্গুলীর সহধর্মীনী হয়েছিল ।
আমার এই পডা পারা আমাকে টেনে নিল আরেক নেশার রাজ্যে । গল্পের বই হয়ে গেল আমার প্রকৃত আনন্দ । নানা বন্ধুর কাছ থেকে ছোটদের গল্পের বই যোগাড করতাম । পডে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফেরত দিতাম । বই চুডি করা আমার একদম ধাতে ছিল না । এ শুনামের জন্য ধারে বই পেতে আমাকে বেগ পেতে হতো না । স্কুলের পডার চাইতে বাইরের পডা আমাকে বেশী আনন্দ দিত । এমন কি রাসতায় কুডিয়ে পাওয়া চিরক্থট বা কোন ছাত্রের হোমওয়ার্কেও খাতার পডে থাকা ছেডা পাতাও আমাকে প্রচুর আনন্দ দিত ।
এর পর আমাকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি পডালেখার জন্য । 1949 সালে ভর্তি হলাম মুন্সীগঞ্জ উচচ বিদ্যালয়ে । ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর আমার প্রতি দৃণ্টি দিতে বাধ্য হলেন আমার প্রিয় 2/3 জন শিক । কাশে আমার স্থান 3/4 এর মধ্যে থাকলেও কয়েকজন মেট্রিকে ও বি এ-তে স্বর্ণ পদক পাওয়া শিক আমাকেই বেশী পছন্দ করতেন । শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী মাহবুবকে ( বর্তমানে আমেরিকার শিকাগোতে বাস করছেন । তার ছেলের শশুর 2005 সালে ও অর্থ সচিব ছিলেন । নাম জনাব জাকির আহমদ খান । তিনি ও আমি 1992-র দিকে সংস্থাপন মনত্রনালয়ে একই পদ মর্যাদায় সহকর্মী ছিলাম ) বা দ্বিতীয় হওয়া আবদুর রহিমকে বলতেন মুখসত বিদ্যার বই-কীট । আর আমাকে ্একদিন আজীবন বিপতি্নক ইংরেজী শিক বি বি চক্রবর্তী বলেছিলেন 'তুই জীবনে অনেক উঁচুতে উঠতে পারবি ' । তাঁর ভবিষ্যৎ বাণী সমপূর্ণ হতে পারেনি 71-এর যুদ্ধ ও এক স্বৈর-শাসক এবং এক সামরিক শাসকের খানখেয়ালীর জন্য্ । আমার জুণিয়ররা অতিরিক্ত সচিব বা সচিব জতে পারলেও আমি হতে পারিনি তাদের বে-সামাল কান্ড-কির্তির জন্য ।
তারা সরকারী নিয়োগ বিধি সংশোধন না করে আমরা, যারা 1970 এর বিশেষ ইপিসিএস পাশ করে জাতির পিতাকে কনভিন্স করে মুক্তিযোদ্ধাদের পর চাকুরীতে ঢোকার সুযোগ পেয়েছি লাম ,তারা হয়ে গেলাম আমাদের পরের ব্যাচের অফিসারদের জুনিয়র । আর প্রথম প্রমোশন পেলাম 19 বছর পর, এখন যেটা 10 বছরের মধ্যেই পেয়ে যাচেছ নূতন প্রজন্মের সৌভাগ্যবান বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




