পাঠক প্রথমেই ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা চাচ্ছি নির্বোধ বিশ্লেষণের জন্য। যে প্রসঙ্গে পুরোপুরি জ্ঞান নেই, সে প্রসঙ্গে আলোচনা করা বোকামি। কিন্তু যে শ্লোগানে আমি ফেষ্টুন হাতে এগোচ্ছি, সে প্রসঙ্গে কথা বলার অধিকার আমার আছে। আর আছে বলেই সাহস করছি কথা বলার। দিচ্ছি নিজের মতো করে যুক্তি । সজ্ঞা। দিচ্ছি সমসাময়িক অভিজ্ঞতার বর্ণণা। প্রসঙ্গ গানের কথা। ইংরেজিতে লিরিক।
প্রতিদিনই কয়েকটি কমন পশ্নের সম্মোখিন হতে হয় আমাকে। ফেসবুকে অথবা সামনাসামনি। প্রশ্ন, আমি গান লিখতে চাই, কিন্তু পারছি না। কিভাবে আমি গান লিখতে পারবো? “অথবা আমি গান লিখি।কিন্তু কোনো সুযোগ পাচ্ছি না। আপনার সাথে তো সবার পরিচয় আছে, আমাকে একটু সুযোগ করে দেন”......
আমার ছোট্ট জীবনে এই প্রশ্নগুলো আমাকে বিষিয়ে তুলেছে। এই দুটি প্রশ্নেরই কোনো উত্তর আমার জানা নেই। প্রথমত, কীভাবে গান লিখতে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমার জানা থাকতো, তাহলে আমি প্রতিদিনই একটা করে ভালো গান লিখতাম। (যদিও ভালো গান কথাটি আপেক্ষিক) মার্কেটে রিলিজ হতো। প্রতিটি গানই জনপ্রিয় হতো। আমি হতাম দেশের সবচেয়ে বড় গীতিকার। কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব? কেউ কি ইচ্ছে করলেই ভালো গান লিখতে পারে? কারো কি ক্ষমতা আছে নিজের লেখা জনপ্রিয় করার? না পাঠক, নেই। মানুষ শুধু চেষ্টা করতে পারে। দু’একটি চেষ্টা সফল হয়। বাকীগুলো হয় না। এখানে আমি দুটি শব্দের জটিলতা তৈরী করে ফেলেছি। ভালোগান আর জনপ্রিয়গান। সঙ্গীত শিল্পী ‘জয় ’ একদিন একটা দারুন কথা বলেছিলো। ওর যুক্তিটা ছিলো এমন, কিছু গান হয় জনপ্রিয় আর কিছু গান জনপরিচিত। বর্তমান মিডিয়ার যুগে অনেক অনেক প্রমোশন করে একটি গানকে জনপরিচিত করা সম্ভব।কিন্তু জনপ্রিয় করা সম্ভব নয়। কারণ একটা গান জনপ্রিয় হয়, জনপ্রিয় করা যায় না। আশা করি উদাহরণটা আমাকে আর ভেঙে দিতে হবে না। আপনারা বুঝতেই পারছেন, আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি।
আমি আবার প্রসঙ্গ থেকে সরে গেছি। বলছিলাম ভালোগান আর জনপ্রিয়গান। ভালোগানের কোনো সজ্ঞা আমার জানা নেই। মুর্খের মতো চারপাশের মানুষদের বিশ্বাস করতে দেখেছি যে গানটা জনপ্রিয় হয়েছে, সেটা ভালো গান, যেটা হয়নি সেটা ভালো গান না। এ বিষয়ে আমি কথা বলতে গেলে প্রথমেই মানুষ আমাকে প্রশ্ন করে, “রূপবানে নাচে কমোর দুলিয়া” নিয়ে। কিংবা ডিস্কোবান্দর নিয়ে। কিন্তু পাঠক বিশ্বাস করুন আমি যতোগুলো গান লিখেছি তার ভেতর এমন গানের সংখ্যা সবমিলিয়ে ৩টি বা ৪টি। বাকী প্রায় ২৫০টি গান আমি লিখেছি। এই প্রায় ২৫০টি গানে কোনো একটি গানের কোনো একটা লাইন নিয়ে, বা কোনো একটি শব্দ নিয়ে কেউ কোনোদিন আমাকে ভুল ধরেনি। তার মানে ওইগুলোর মধ্যে কোনো ভুলছিলো না? অবশ্যই আছে। অধিকাংশ মানুষ ওই গানগুলো শোনেন নি। তারা আমাকে চেনে “রূপবান নাচে কোমর দুলাইয়া”-এর গীতিকার হিসেবে। “ডিস্কোবান্দরের” গীতিকার হিসাবে। এই দুটি গান নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। মজার ব্যাপার এই গান দুটির মধ্যে ব্যাকরণগত কোনো ভুল নেই। নেই কোনো অশ্লীল শব্দ। বা শ্লীলতা বির্বজিত কোনো ইঙ্গিত। মানুষ সমালোচনা করে তার কারণ, এই গানগুলো গত ১০ বছরের সব থেকে জনপ্রিয়গান। জনপরিচিত না। এবার নিশ্চয় পাঠক আমার আলোচনায় ভালো গান আর জনপ্রিয় গানের তুলনা বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে বাকী থাকার কথা না।
এবার আসি গান আর গানের কথা প্রসঙ্গে। এতোক্ষণ আমি “গান লেখা” বা “লিখেছি” যে দুটি শব্দ ব্যাবহার করেছি তা ভুল। গান লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি গানের সুর, তাল, লয় সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি যা লিখি তা হলো গানের কথা। ইংরেজিতে যাকে বলে “লিরিক”। বাংলায় “গীতিকবিতা”। গান সেই ব্যাক্তি লেখেন যিনি একটা গানের চিন্তা করেন। কথা লেখেন। সুর করেন। মিউজিক করেন। এবং গানটা নিজের গলায় গেয়ে রেকর্ড করেন। ইংরেজিতে তাকে বলা হয় “সংরাইটার”।
যে দু’টি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম তার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আসি। সুযোগ দেওয়া। পৃথিবীতে কেউ প্রতিভা নিয়ে এসেছে, কিন্তু কোনোদিন সুযোগ পায়নি বলে প্রতিভার বিকাশ হয়নি এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না। প্রতিভা যার আছে, সে বিকশিত হবে। হতে বাধ্য। তবে এমনও হতে পারে, শিল্পীর মৃত্যুর পর তার প্রতিভার মোড়ক মানুষ উন্মোচিত হয়েছে । মূল্যায়ন হয়েছে । (আমাদের দেশে বেশিরভাগ সময় যা হয়।) যখনই হোক না কেনো, হবে। প্রথম কথা যে কাজটা করতে চাচ্ছি ওই কাজটা আমি পারি কি না। যদি আমি গানের কথা লিখতে পারি, তাহলে সুরকার আমাকে খুঁজে বের করবে। আমার সুরকার খুঁজার দরকার নেই। আমার যতটুকু একজন সুরকারকে দরকার, একজন সুরকারের আমাকে দরকার তার চেয়ে বেশি। প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো শেখা। শেখার আগ্রহ। এমন অনেক মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, যাদের ১৪শ’ ২ হাজার এমন কি ৩ হাজার গীতিকবিতা লেখা আছে। সে শুধু চাচ্ছে আমার মাধ্যমে কোনো একজন সুরকারের সামনে যেতে। শুধু যেতে পারলেই তার বিশ্বাস সে একজন প্রতিষ্ঠিত গীতিকার হয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। কিন্তু এমন মানুষের কাছ থেকে বাঁচার জন্য আমি তাকে প্রশ্ন করি, “আপনি কার কার কবিতা পড়েছেন? উত্তরে বলে সবার। আমি যদি প্রশ্ন করি নাম বলেন দু’একজনের, উত্তরে বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আর.....আর.....এই তো। আমার আবার প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথের “বাঁশি”কবিতা পড়েছেন? উত্তর না। আমি যদি বলি, শঙ্খ ঘোষের নাম শুনেছেন? উত্তর না। যদি বলি জয় গোস্বামীর নাম শুনেছেন? উত্তর না। তাহলে পাঠক আপনি বলুন, যে রবী ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতা পড়েনি, যে শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি, যে জয় গোস্বামীর কবিতা পড়েনি সে যদি ৩ হাজার নয় ১০ হাজার গান ও লিখে থাকেন, আপনি কি মনে করেন তার গীতিকবিতা হয়েছে? আমি মনে করি না। নজরুলের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না। আমারও নেই। তাই বলে আমি কাজী নজরুল ইসলাম নই। নজরুল যে পরিমাণ শিক্ষা দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে তারচেয়ে বেশি শিক্ষা নিয়ে গেছেন। আমি কতোটুকু নিতে পারছি। দেয়ার প্রসঙ্গ পরে।
এবার আসি গীতিকবিতার ভাষা প্রসঙ্গে। আমি মনে করি গানের ভাষা হওয়া উচিত আাধুনিক সাহিত্য। সাহিত্য প্রতিদিনই আধুনিক হচ্ছে। গীতিকবিতাও প্রতিদিন আধুনিক হওয়া উচিত। তবে আমি সব সময় চিন্তা করি যে গানের কথা বসাচ্ছি এই গানটা কে বা কারা শুনবে? টার্গেট শ্রোতা কারা? যখন আমি বাপ্পা ভাই এর জন্য একটা গান লিখছি তখন বাপ্পা মজুমদারের ভক্তদের রুচি ও চিন্তার অব¯স্থান জেনে গীতিকবিতা লেখার চেষ্টা করি। যখন “আর্টসেল” বা “পাওয়ার সার্চ”- এর জন্য একটা গীতিকবিতা লিখি তখন আর্টসেলের শ্রোতাদের বয়স, রুটি, চিন্তা জেনে লেখার চেষ্টা করি। একই রকম ভাবে, মিলা, কণা, বা মাইলস, অর্থহীনের লিরিক লেখার সময় শ্রোতাদের স্তর নিয়ে চিন্তা করে লেখার চেষ্টা করি। কিš' যে আধুনিকতার কথা বলছিলাম তা যেন সব লিরিকে বজায় থাকে, তার চেষ্টায় কখনো ত্রুটি করি না। সবশেষ একটা বিষয়ে বলতে চাই তা হলো, “সহজ” আর “সস্তা”। দুটি আলাদা শব্দ। গানের ভাষা অবশ্যই সহজ হতে হবে। অনেক গভীর একটা কথা সহজ ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা যার আছে সেই শিল্পী। অনুভূতি সবার আছে। অনুভূতি প্রকাশ করার ক্ষমতা যার আছে, সেই শিল্পী। কিš' অনুভূতির সহজ প্রকাশ করতে গিয়ে মানুষ সস্তা প্রকাশ ভঙ্গি দেখিয়ে বসে। যেটা ভুল। “আমি তোমাকেই বলে দেবো, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেটে গেছি বিরান পথে”-এর চেয়ে সহজ বাক্য হতে পারে কি? কিš' এই সহজ বাক্যের মধ্যে যে গাঢ় অনুভূতির বর্ণণা আছে, তার বিশ্লেষণ করা কঠিন। একই ভাবে যদি বলি “তুমি নেই, আমি একা, হেটে চলেছি, একাকী এই পথে”। এই লাইনের ভেতরে কি কোনো গাঢ় অনুভূতির বর্ণণা নেই? হয়তো আছে, কিš' প্রথম লাইনটার মধ্যে যে প্রাণটা আছে সেই প্রাণটা পরের লাইনগুলোতে নেই। তাই পরের লাইনগুলো সস্তা। নিম্নমানের। আর সঞ্জীব চৌধুরীর তোমাকেই বলে দেবো, কালজয়ী একটা গীতিকবিতা। পার্থক্য এখানেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





