জীবন বহতা নদী। বয়ে চলে আপন বেগে, আপন পথে। কে রাখে তার গন্তব্যের খবর? বাঁধ তাকে আরো উন্মত্ত করে, শৃঙ্খল ভেঙ্গে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় লোভাতুর ক’রে তোলে। পরিচয়ের পর থেকেই পরী আর আকাশের জীবন অনেক বেশী শৃঙ্খলিত যেনো। দুজনেই সচেতন এই ভাবনায় যে, ওদের ভালোবাসা কাল্পনিক জগতেই চিরতরে বন্দী। জীবনের এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে গেলে ভালোবাসা প্রকাশ আর বিকাশের অনেক কিছুই জলাঞ্জলি দিয়ে, ক্ষুদ্র পরিসরে একটুখানি ভালোবাসা শুধু নেড়েচেড়ে দেখা যায় হয়তো, তার পরিপূর্ণ রস আস্বাদন রয়ে যায় নাগালের বাইরে। সবকিছু মেনে নিয়ে ওই গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো পরী আর আকাশ। কথা ছিলো ২০২৫ এ দেখা হবে ওদের। সেই কাল্পনিক দেখা হওয়া নিয়ে কত পরিকল্পনা আর স্বপ্ন ওদের। একবার সব দ্বিধা ঝেড়ে আকাশ দেখা করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলো। সায় মেলেনি পরীর। পরীর সেই দৃঢ় ‘না’ শব্দটা এখনো আকাশের কানে বাজে। প্রতিজ্ঞা করেছিলো আর কখনো নিজে থেকে দেখা করতে চাইবে না। সেই থেকে মনের মাঝে ২০২৫ এর স্বপ্নটাই লালন করেছে শুধু।
দু’দিনের ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় আকাশ। টুকটাক কাজ আর পুরনো প্রিয় জায়গাগুলো একটু ঘুরেফিরে দেখা। পরী ব্যস্ত আর বন্দী অফিসের চার দেয়ালে। মাঝে মাঝে কথা হচ্ছে। হঠাৎ পরীর এস এম এস... ‘দেখা করতে ইচ্ছে করছে’। উত্তরে আকাশ লেখে... ‘আমাদের সারা জীবন ই পড়ে আছে দেখা করার জন্য। খুব ইচ্ছে হলে দেখা করা যায়। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য বের হতে পারলে একসাথে লাঞ্চ করা যেতে পারে’। আকাশের নির্লিপ্ততায় থমকে যায় পরী। ভাবনার ঝড় চলে মনের মাঝে। অপ্রস্তুত ও হয় একটু। থমকে থাকে নিজের মাঝে অনেকক্ষণ। তারপর আবার এস এম এস... ‘ছুটি নিয়েছি। ৩ টায় বের হতে পারবো। কিন্তু আমাদের ২০২৫ এর কি হবে? শেষ মুহুর্তে না করলে রাগ কোরো না প্লিজ’। শেষের কথায় একটু ব্যথিত হয় আকাশ। জবাবে লেখে... ‘ভালো ক’রে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাও’। আজ নিয়তি যেনো ক্ষণে মেঘে ঢাকা আকাশ, ক্ষণে রৌদ্রজ্জ্বল। ছোট্ট ছেলের বালির ঘর তৈরী শেষ হওয়ার প্রাক্কালে ধৈর্য হারিয়ে সব ছড়িয়ে এলোমেলো ক’রে দেবার মতো যেনো। আকাশ ও আনমনে ভাবে... ২০২৫ এর কি হবে তাহলে? কতোদিনের কতো স্বপ্ন ২০২৫ কে ঘিরে...। এটাও বোঝে, দু’জনেই দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। সিদ্ধান্তহীনতায় জর্জরিত পরী ফোন করে। শুধায়... ‘কি করবো?’। আকাশ বলে... ‘আর কোন ভাবনা চিন্তা নয়। ভবিতব্য পড়ে থাক অনিশ্চয়তার আস্তাকুঁড়ে। Let’s meet’।
সময় আর স্থান ঠিক ক’রে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দু’জন। পরী হাতের কাজ শেষ করতে আর আকাশ স্থবির আর যান্ত্রিক ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরীর কাছে পৌঁছার সংগ্রামে। কেমন এক অজানা অস্থিরতা পেয়ে ব’সে পরীকে। এই প্রথম এভাবে আজানা কারো সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। অনেকদিনের পরিচিত হলেও ফোনে একটা মানুষকে আর কতোটুকুই বা জানা যায়? সংশয়ে আর অনিশ্চয়তায় ওর হাত পা অবশ হয়ে আসতে থাকে। মনে হয় ফোন করে আকাশকে আসতে নিষেধ করে দেয়। আকাশ ও ভাবনার খেই হারিয়ে শূন্য মনে অপেক্ষা করে প্রথম দেখার ক্ষণটির জন্য।
অবশেষে এলো সেই অভূতপূর্ব ক্ষণ। কতোদূর থেকে দু’টো মানুষ হঠাৎ যেনো খুব কাছে, অভাবনীয় যেনো সেই কাছে আসা, যোজন যোজন দূরত্ব পেরিয়ে হঠাৎই যেনো সব স্পর্শের নাগালে। ভাবনাটা বড় বেশী এলোমেলো ক’রে দেয় আকাশকে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়, এ যেনো এক অজানা পৃথিবী, আশেপাশে সব অচেনা দৃশ্যপট, শুধু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপ রূপ মানবীটাই বড় বেশী চেনা চেনা।
নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের এক গুচ্ছ গাঢ় লাল গোলাপ পরীর দিকে এগিয়ে দেয় আকাশ। নেয় বটে, সাথে অনুযোগ... ‘কি প্রয়োজন ছিলো? এখন আমি হাতে গোলাপ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবো নাকি’? ওর হাত থেকে গোলাপগুলো নিয়ে আকাশ বলে... ‘প্রথম দেখার সময় আমার যে লাল গোলাপ আনার কথা, তা আমি ভুলি কি করে’? খানিক পাশাপাশি হেঁটে রিকশা নিলো ওরা। আকাশ জানে, রিকশায় ডান পাশে বসা পছন্দ পরীর। তাই ডান পাশটা ছেড়ে বামেই ব’সে ও। রিকশা চলে ধীর গতিতে। দু’জন পাশাপাশি, চুপচাপ, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো দু’একটা কথা। পরী একটু জড়োসড়ো। রিকশা ছেড়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওরা। নিরিবিলি, ছিমছাম। হঠাৎ নির্জনতায় এসে পরীর আড়ষ্ঠতা কাটতে থাকে ধীরে ধীরে। শুধু আকাশ সরাসরি ওর দিকে তাকালেই লাজুক হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর ওকে বাদ দিয়ে আশেপাশের অন্য সব কিছু দেখার পরামর্শ দেয়। কিন্তু আকাশের যে শুধু ওকেই দেখার তৃষ্ণা।
ক্ষুধা নেই কারোই। তবুও একটুখানি খাবার ভাগাভাগি করে খোঁটাখুঁটি, তারপর চা। শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আবার রিকশা। তারপর লেক আর পার্কের বেঞ্চি। সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে পরী। সময় যেনো ছুটতে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মত। খুব নতুন কোন কথা নয়, তবে অনুভূতিটা নতুন। অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছুঁয়ে থাকে আকাশকে। মনে হয় এই মুহুর্তে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব কল কব্জাগুলো বিকল হয়ে স্থবির করে দেয়না কেনো সবকিছু। ভালোলাগার মাঝেও অন্যরকম এক বিষাদ ওকে ভর করে। মাঝে মাঝে অজান্তেই আনমনা হয়ে ভাবে, কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে ভালোলাগা ক্ষণ গুলো। স্বপ্নের মত মুহুর্তগুলো আর কখনো কি ফিরে আসবে? জানে না আকাশ। পরীর টুকরো কথা মৃদু সুগন্ধের মত ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ক্রমেই বিষাদে ডুবে যেতে থাকে আকাশ।
বেয়াড়া ঘড়ির কাঁটাটাকে তীব্র দৃষ্টিতে ভস্ম করার ব্যর্থ চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ায় আকাশ। পরীও পিছু নেয়। আবার খানিকক্ষণের রিকশা। দু’জনের ভিন্ন পথ। চোখে প্রশ্ন নিয়ে পরী ওর পথের গাড়ীতে তুলে দিতে বলে আকাশকে। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত একসাথে থাকার লোভ আকাশের। তাই ওসব বাদ দিয়ে ট্যাক্সিক্যাব এ উঠে বসে। দু’জনেই অনুভব করে বিদায়ের ক্ষণ আসন্ন। নিজের বাম হাতটা আলগোছে পরীর দিকে এগিয়ে আকাশ তাকায় পরীর দিকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় পরী। প্রথমে দু’টো, পরে চারটে হাত আঁকড়ে রাখে একে অন্যকে। একটু ঘন হয়ে বসে আকাশ। পরীর ডান কানে আলতো ক’রে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস ক’রে বলে, ‘অনেক ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাকে পরী’। একটু কেঁপে ওঠে পরী। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করে কি?
রাতের আঁধার তার নিজ রূপে বিন্যস্ত হতে শুরূ করেছে। বাম হাতটা পরীর ঘাড়ের পিছনে রেখে আলগোছে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আকাশ। দু’জনের দু’টো গাল ছুঁয়ে থাকে পরষ্পর। পরীর শরীর আর চুলের মৃদু সুগন্ধ জড়িয়ে ধরে আকাশকে। অদ্ভুত মাদকতায় বুঁদ হয়ে আধা জড়াজড়ি করে গালে গাল চেপে বসে থাকে নিশ্চুপ দু’টো মানুষ। গন্তব্য এসে যায়। শেষ মুহুর্তে কিছুই বলার থাকেনা কারোই। পরীকে ছেড়ে বহুদূরের নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় আকাশ। ছুঁয়ে থাকে শুধু পরীর সুগন্ধ আর স্পর্শ। আনমনা মন ভেবেই চলে এ ছিলো নিছক অলীক এক স্বপ্ন।
The Introduction
More about Pori & Akash

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




