কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসটি বঙ্কিমচন্দ্রের কিছুটা রাজনৈতিক উপন্যাস, সেই সাথে এটি অন্যতম রোমান্টিক উপন্যাস। এই উপন্যাস লেখা হয় ১৮৬৬ সালে একই বছরে এটি প্রকাশিত হয়। এর নারী চরিত্র দু'টোর প্রধান দুটো হলঃ মতিবিবি এবং কপালকুণ্ডলা অন্যতম।
কপালকুণ্ডলাঃ
কপালকুণ্ডলা সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানা যায় নবকুমারের দৃষ্টিতে-
''ফিরিয়ামাত্র দেখিলেন, অপূর্ব মূর্ত্তি! সেই গম্ভীরনাদি বারিধিতীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব রমণীমূর্ত্তি! কেশভার - অবেণী সম্বন্ধ, সংসর্পিত, রাশীকৃত, আগুণফলম্বিত কেশভার; তদশ্রে দেহরত্ন; যেন চিত্রপটের উপর চিত্র দেখা যাইতেছে। অলকাবলীর প্রাচূর্যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হইতেছিল না - তথাপি মেঘবিচ্ছেদ নিঃসৃত চন্দ্ররশ্মির ন্যায় প্রতীত হইতেছিল। বিশাল লোচনে কটাক্ষ অতি স্থির অতি স্নিগ্ধা, অতি গম্বীর অথচ জ্যোতির্ম্ময়; সে কটাক্ষ, এই সাগর হৃদয়ে ক্রীড়াশীল চন্দ্রকিরণ লেখার ন্যায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল দীপ্তি পাইতেছিল। কেশরাশিতে স্কন্ধদেশ ও বাহুযুগল আচ্ছন্ন করিয়াছিল। স্কন্ধদেশ একেবারে অদৃশ্য; বাহুযুগলের বিমলাশ্রী কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল। রমণীদেহ একেবারে নিরাবরণ। মূর্ত্তি মধ্যে সে একটি মোহিনী শক্তি ছিল, তাহা বর্ণিতে পারা যায় না। অর্দ্ধচন্দ্র নিঃসৃত কৌমুদিবণ; ঘণকৃষ্ণ চিকুরজাল; পরষ্পরের সান্নিধ্যে কি বর্ণ, - - ইত্যাদি ইত্যাদি.......''
উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই যে, নবকুমারের দৃষ্টি চমকিত লোকের দৃষ্টির ন্যায়, রমণীর দৃষ্টিতে সে লক্ষণ কিছুমাত্র নেই, কিন্তু তাহাতে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ হইতেছিল। অনন্ত সমুদ্রের জনহীন তীরে, এইরূপে বহুক্ষণ দুইজনে চাহিয়া রহিলেন। অনেক্ষণ পরে তরুণীর কণ্ঠস্বর শুনা গেল। তিনি অতি মৃদুস্বরে কহিলেন,
'' পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?''
নবকুমার এই উক্তি শুনে তার বাক রহিত হয়েছিল। কুপালকুণ্ডলাকে দেখা যায় নবকুমারকে কপালিকের হাত থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় রত। তাকে এখানে একজন পরোপকারী হিসেবে দেখা যায়। আর মুখে তাই বারে বারে শুনা যায়-
'' পলায়ন কর; আমার পশ্চাৎ আইস, পথ দেখাইয়া দিতেছি। ''
কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে দেবতার সেবক অধিকারীর কাছে রেখে আসে। কিন্তু অধিকারী শকুন্তলাকে নবকুমারের সাথে বিয়ে দেয়।
কপালকুণ্ডলা ধার্মিক হিসেবে দেখা যায় যেমন, যাত্রাকালে কপালকুণ্ডলা কালী প্রণামার্থে গেলেন। ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া পুষ্পপাত্র হইতে একটি অভিন্ন বিল্ব পত্র প্রতিমার পদোপরি স্থাপন করিয়া তৎপতি নিরীক্ষণ করিয়া রহিলেন। পত্রটি পড়িয়া গেল। সে ভীত হয়ে অধিকারীকে জানালে অধিকারী বলে সে,
''এখন নরুপায়। এখন পতিমাত্র তোমার ধর্ম। পতি শ্মশানে গেলে তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে যাইতে হইবে। অতএব নিঃশব্দে চল।''
কপালকুণ্ডলাকে দেখা যায় অত্যন্ত পতিভক্ত আর বিশ্বাসী হিসেবে এবং সেই সাথে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না। এর প্রমাণ দেখা যায় কপালকুণ্ডলা যখন ননদিনীর জন্য ঔষধ অনুসন্ধানে যাচ্ছিল তখন রাত বলে নবকুমার তার সাথে যেতে চায়। তখন কপালকুণ্ডলা অত্যন্ত গর্বিত বচনে বললেন যে,
'' আইস আসি অবিম্বাসিনী কি, না, স্বচক্ষে দেখিয়া যাও।''
তার দৃঢ় স্বাধীন চিত্ত্বের প্রকাশ দেখা যায় যখন ভাবে যে,
'' বোধ করি সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে অথবা '' যদি জানিতাম যে স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসিত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।''
সে মনের দিক থেকে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল।তাকে অত্যন্ত অভিমানী আর স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন দেখা যায় কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের শেষে যখন সে বলে,
'' যাহা জিজ্ঞাসা করিলে বলিব। আজি যাহাকে দেখিয়াছ, - সে পদ্মাবতী। আমি অবিশ্বাসিনী নই। এ কথা স্বরূপ বলিলাম। কিন্তু আর আমি গৃহে যাইব না। ভবানীর চরণে দেহ বিসর্জন করিতে আসিয়াছি- নিশ্চিত তাহা করিব। তুমি গৃহে যাও। আমি মরিব। আমার জন্য রোদন করিও না।''
অনেকটা সীতার মত যখন রাম তাকে অবিশ্বাস করে নয় জনগণের দাবীর মুখে বনবাসে দিয়েছিল। তখন সে তাঁর কার্য সম্পাদন করে তার রামের কাছে আর ফিরে যায় যায়নি। সে এত কষ্ট পেয়েছিল, সে মৃত্তিকা দেবীকে ডেকে বলেছিল যথা সম্ভব দেবী বসুধাকে ডেকেছিল তাকে গ্রহণ করার জন্য। তখন দেবী একটি সোনার সিংহাসন নিয়ে মাটি দু'ভাগ করে পৃথিবীতে উঠেছিল এবং সীতেকে নিয়ে আবার মাটির নিচে চলে যায়। হয়ত রাম তার ভুল বুঝতে পেরেছিল কিনা জানি না কিন্তু নবকুমারকে দেখা যায় সে তার ভুল বুঝতে পেরেছিল তাই সেও আর উঠল না।
মতিবিবিঃ
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্থান জুড়ে আছে মতিবিবি চরিত্রটি। অত্যন্ত কূটিল কৌশলী একটি চরিত্র। মতিবিবির আসল নাম পাওয়া যায় পদ্মাবতী। সে নবকুমারের প্রথম পক্ষের স্ত্রী। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে মুসলমান হতে হয় পরিবারের সাথে। ফলে সে হিন্দুরীতি অনুযায়ী জাতিভ্রষ্টা হয়ে যায় তার পরিবার সহ। ফলে সে আর তার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারেনি। তার মুসলিম নাম লুৎফুন্নেসা।
উপন্যাসে তার আবির্ভাব হয় ডাকাত কর্তৃক তার শিবিকা অফরণ ও সে একা অন্ধকারে একাকী তখন নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়।
উপন্যাসে তাঁকে বলা হয় শ্যামা সুন্দরী হিসেবে। বর্ননাটা অনেকটা ''সুন্দরীর বয়ঃক্রমসপ্তবিংশতি বৎসর ভাদ্র মাসের ভরা নদী। ভাদ্র মাসে নদী জলের ন্যায়, ইহারা পাশাপাশি টলটল করিতেছিল-উছলিয়া নড়িতেছিল। বর্ণাপেক্ষা, নয়নাপেক্ষা, সর্বাপেক্ষা সেই সৌন্দর্যের পরিপল্লব মুগ্ধকর। পূর্ণ যৌবনভরে সর্ব্বশরীর সতত ঈষচ্চঞ্চল; বিনা বায়ুতে শরতের নদী যেমন ঈষচ্ছঞ্চল, তেমনি চঞ্চর্ল, সে চাঞ্চল্য মুহুর্মুহুঃ নূতন নূতন শোভা বিকাশের কারণ। নবকুমার নিমেষশূণ্যচক্ষে সেই নতুন নতুন শোভা দেখিতেছিলেন।
এভাবেই তাকে অসামান্য সুন্দরী হিসেবে দেখা যায়। তাঁকে দেখা যায় বিবেক হিসেবে, যখন সে কপলাকুণ্ডকে দেখে তাঁর গয়না গুলো উপহার দিচ্ছিলেন। তাঁর মুখেই প্রসংশা দেখা যায়-
'' আপনি সত্যিই বলিয়াছিলেন। এ ফুল রাজ্যোদ্যানেও ফুটেনা পরিতাপ এই সে, রাজধানীতে এ রূপরাশি দেখাইতে পারিলাম না। এসকল অলঙ্কার এই অঙ্গের উপযুক্ত- এই জন্য পরাইলাম।''
বঙ্কিমের ভাষায় সে ছিল দুর্দ্দমবেগবতী। যা তার ভাল লাগত তাই করত, আগু পিছু ভেবে করত না।
তাঁকে দেখা যায় নিজেকে বিতরণে সিদ্ধহস্ত। সবাইকে সে তার রূপ থোড়া থোড়া বিতরণ করত। সে যুবরাজ সেলিমের যেমন প্রেয়সী তেমনি অনেক ওমরাহেরও প্রেয়সী।
মতিবিবি কূটনীতিতেও দক্ষ। ইতিহাসের রাজপুতপতি রাজা মানসিংসের ভগিনী সেলিমের প্রধানা মহিষী ছিলেন এটা অনেকেরই জানা। সেলিম কেমন রমণীমোহন ছিলেন তাও নিশ্চয় কারো অজানা নয়। এখন আসি মতিবিবিতে। তাকে দেখা যায় কূটচাল চালাতে দক্ষ হিসেবে।
সেলিমের প্রধানা মহিষীর পুত্র ছিল খসরু। মতিবিবি সেলিমের মহিষীর মনে ঢুকিয়ে দিল তার পুত্র খসরুও তো সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হতে পারে। মতিবিবিকে বলতে শুনা যায়,
''যুবরাজপুত্র খসরুকে সিংহাসন দান করুন।''
মতিবিবি মেহেরুন্নিসার প্রতি যুবরাজ পত্নীর হৃদয়শেলেক কাজে লাগিয়েছিল। যদিও মতিবিবি যা লুৎফুন্নেসারও তেমনি।
মতিবিবিকে প্রবল প্রতিশোধ পরায়নও হিসেবেও দেখা যায়। এসবের উদ্দেশ্য হিসেবে বঙ্কিম, সেলিম যে মতিবিবিকে উপেক্ষা করে মেহেরুন্নেসার জন্য এত ব্যস্ত এটাকে উদ্দেশ্য হিসেবে দেখিয়েছেন মতিবিবি বেগমকে বলতে দেখা যায় যেহেতু তাঁর পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র নীতির মতো কূটনীতিতে সিদ্ধহস্ত ছিল, সে বলল,
''মোঘলের সম্রাজ্য রাজপুতের বাহুবলে স্থাপিত রহিয়াছে। সেই রাজপুতজাতির চূড়া রাজা মানসিংহ, তিনি খসরুর মাতুল, আর মুসলমানদিগের প্রধান খাঁ আজিম; তিনি প্রধান রাজমন্ত্রী, তিনি খসরুর শ্বশুর; ইহারা দইজনে উদ্যোগী হইলে, কে ইহাদিগের অনুবর্ত্তী না হইবে? আর কাহার বলেই বা যুবরাজ সিংহাসন গ্রহণ করিবেন? রাজা মানসিংহকেও কার্য্যে ব্রত করা, আপনার ভার। খাঁ আজিমও অন্যান্য মহম্মদীয় ওমরাহগণকে লিপ্ত করা আমার ভার। আপনার আশীর্বাদে কৃতকার্য্য হইব, কিন্তু এক আশঙ্কা, পাছে সিংহাসন আরোহন করিয়া খসরু এ দুশ্চরিত্রাকে পুরবহিষ্কৃত করিয়া দেন।''
এভাবেই সে কূটচাল চালিয়েছিল। মতিবিবি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। তার বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর ফলে তার পরিকল্পনাগুলো ভেস্তে যায়। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সকলের সাথে ব্যাপক সদ্ভাব রাখে।
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




