somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কর্ণেল তাহের আজো প্রাসঙ্গিক ১: কর্ণেল তাহেরের পিপলস আর্মি

০৬ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের পদ থেকে তাহেরকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পুরো বিগ্রেডের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলে- তাহের 'পিপলস আর্মি'র মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কুমিল্লা বিগ্রেডের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জিয়া- তাকে মেজর জেনারেল ও উপ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয় ঢাকায়। জিয়া চলে গেলে তাহের পুরো বিগ্রেডের দায়িত্ব নেন এবং খোল নালচে পালটে ফেলেন বিগ্রেডের।

পুরো বিগ্রেডকে ফল ইন করে তিনি বলেন: "ক্যান্টনমেন্টে বসে শুধু পিটি, প্যারেড আর ভলিবল, ফুটবল খেললে চলবে না, মানুষের ভেতরে গিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে"।

তিনি দায়িত্ব ভাগ করে দেন। বিগ্রেডের এডুকেশন কোরকে নির্দেশ দেন গ্রামে গিয়ে প্রাইমারী স্কুল আর বয়স্ক শিক্ষার অনানুষ্ঠানিক স্কুল খুলতে। মেডিকেল কোরকে তিনি বলেন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান দিতে। উৎসাহে সৈনিকরা মিলে সব নেমে পড়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের গ্রামে।

অন্য সিপাইদের তাহের লাগিয়ে দেন ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের পতিত জমিগুলোতে চাষ করতে। কাছেই কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বোর্ড। সেখান থেকে চাষাবাদ বিষয়ে নানা বই জোগাড় করা হয়। তাহের সব অফিসারদেরও বাধ্য করেন সকালে ক্ষেতে কাজ করতে।তারা সবাই তখন কৃষক। লাঙ্গল কোদাল নিয়ে অন্যদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েন এক পাহীন বিগ্রেড কমাণ্ডার তাহেরও। ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশে লাগানো হয় প্রচুর আনারস, লেবু গাছ, সেই সংগে শাল আর সেগুন গাছ। সবার মধ্যেই বেশ একটা উদ্দীপনা দেখা দেয়। ময়নামতি পাহাড়ি ঢালুতে আড়াই লাখ আনারস আবাদ করেন বিগ্রেড সৈনিকরা, আনারস বিক্রি করে ক্যান্টনমেন্টের আয়ও হয় প্রচুর। তাহের তার বিগ্রেডের প্রতীক করেন লাঙ্গল।

তাহের বলেন, "যুদ্ধের সময় অফিসার, সিপাইরা কি দুর্দান্তভাবে মিশে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে। আর যুদ্ধের পর তারা যেন হয়ে গেছে দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। আমি এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে চাই"।

আশেপাশের গ্রামে যেসব মেয়েরা যুদ্ধের সময় ধর্ষিতা হয়েছেন, যাদের স্বামী মারা গেছেন তাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টের বাইরে তাঁবু টেনে থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছিল। তাদের সেলাই শেখানো হয়। শেখানো হয় নানা কুটির শিল্প। ঐ মেয়েদের বানানো কাপড় এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়েই উদ্বোধন হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাশের খাদি দোকানগুলো, যা আজো দাঁড়িয়ে আছে।

তাহের সিপাই আর অফিসারদের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবারও নানা উদ্যোগ নেন। অফিসারদের নিজস্ব ক্লাব থাকলেও সিপাইদের বিনোদনের কোন ব্যবস্থা ছিল না তখন। তাহের সিপাই আর অফিসারদের পরিবার মিলে যৌথ পিকনিকের ব্যবস্থা করেন। সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমনটি আর ঘটেনি কখনো। সিপাইদের স্ত্রীদের জন্য করা হয় ক্লাবের ব্যবস্থা। সেখানে সিপাইদের স্ত্রীদের পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেন তাহের ও অন্যান্য অফিসারদের স্ত্রীরা। সিপাই, অফিসার মিলে আয়োজন করেন বিচিত্রা অনুষ্ঠান।

অফিসারদের নিয়ে বসেন তাহের। তাদের বলেন, "আমাদের আর্মির হিস্ট্রিকে তোমাদের ক্রিটিক্যালি দেখতে হবে। পাকিস্তান আর্মি যাদের নিয়ে তৈরী হয়েছিল এরা তো সব ব্রিটিশ আর্মিরই লোকজন। ব্রিটিশদের চাকরি করতো পরে পাকিস্তান হওয়াতে তারাই হয়েছে পাকিস্তান আর্মি। ব্রিটিশ আর্মিতে যে ইণ্ডিয়ানরা চাকরি করত, হোয়াট ওয়াজ দেয়ার রোল? ওরা ছিল একটা ভাড়াটে বাহিনী। লোকাল আপরাইজিংগুলোকে ঠেকানোর জন্য এই আর্মিকে ব্যবহার করা হতো। ঐ বাহিনীকে তারা লেলিয়ে দিয়েছিল সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে, টিপু সুলতান- বাহাদুর শাহ জাফরের বিরুদ্ধে। ইণ্ডিয়ার সোলজার, অফিসার দেশের মানুষের বিদ্রোহগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এরা ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের তাবেদার, ঠেঙ্গার বাহিনী। পাকিস্তান আর্মি তো ঐ ধরণের ব্রিটিশ ভাড়াটে বাহিনীরই কন্টিনিউশন। তাদের মাইণ্ড সেটটাও তো তাই, শুধু কারো না কারো তাবেদারি করা আর ঠেঙ্গানো।

কিন্তু আমরা বাংলাদেশ আর্মি তো গড়ে তুলেছি একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা কেন ঐ লেগাসি ক্যারি করব? আর্মি এদেশের মানুষ দিয়েই তৈরি কিন্তু এই অর্গানাইজেশনটাকে সমাজের সবরকম কাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা আছে সবসময়। আর্মির লোকের সাথে সাধারণ মানুষের মেলামেশার কোন সুযোগ নেই। এতে করে একটা এলিটিস্ট মানসিকতা তৈরি হয়। যেন আর্মির কাজ হচ্ছে দেশের মানুষের উপর খবরদারি করা। এটা একটা তাবেদার আর্মির এজেণ্ডা হতে পারে। বাংলাদেশ আর্মির মাইন্ড সেটটা এমন হবে কেন- যার জন্ম হয়েছে একটা জনযুদ্ধের মধ্যে।
আমাদের আর্মিকে হতে হবে পিপলস আর্মি"।


তাহেরের আশা ছিল- তার এই মডেল পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিগ্রেডগুলোতেও অনুসরণ করা হবে। কিন্তু সেটা হয় না। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। মানতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগই করেন।

তথ্যসূত্রঃ
"ক্রাচের কর্ণেল"- শাহাদুজ্জামান
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৫
৩৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×