কুরুবালকদিগের বাল্যক্রীড়াঃ
একদিন নগরের বাইরে কুরুপুত্ররা ক্রীড়া করছিল। এক গোটা লৌহভাঁটা(গোলক বিশেষ) মাটিতে ফেলে হাতের দন্ড বা ডান্ডা দিয়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দৈব নির্দেশে লৌহভাঁটা জলশূণ্য কূপের মধ্যে পড়ে গেল। সকল কুমার সেটি কূপ থেকে তোলার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কৃতকার্য হল না। সকলে হতাশ হয়ে ভাবতে বসল। লজ্জিত হয়ে মলিন বদনে তারা বসে রইল।
এমন সময় দ্রোণ সে স্থান দিয়ে গমন করছিলেন। শুক্ল বস্ত্র, শুক্ল বেশ, কাঁধে উত্তরীয়, শ্যামল দেহবর্ণ, গতি মত্ত হস্তীর মত। শিশুদের বিরস বদন দেখে তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
তার প্রশ্ন শুনে সকল কুমার নিজেদের ক্ষত্রকুলে জন্মের জন্য ধিক্কার দিতে লাগলো। নিজেদের প্রাণ, অধ্যায়ণ –সকল বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। কারণ তারা একটি ভাঁটাকে উদ্ধার করার শক্তি রাখে না। অথচ সকলে উপর থেকে লৌহভাঁটা দেখতে পাচ্ছে।
এত শুনে দ্রোণ হেসে বলেন, কূপ থেকে তিনি ভাঁটা উদ্ধার করে দিতে পারেন একটি ঈষীকা অর্থাৎ কাশতৃণের সাহায্যে। তার পরিবর্তে তাকে তুষ্ট করতে হবে। ভোজ্য পেলেই তিনি তুষ্ট হন। তিনি সকলকে একসাথে এ ব্যাপারে অঙ্গীকার করতে বললেন।
এত শুনে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন ঈষীকার সাহায্যে ভাঁটা তুলে দিলে তাকে কি দ্রব্য ভোজনে দিলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন। কৃপাচার্যের কাছে আশ্রিত দ্রোণ যে কোন ভোজ্যেই আনন্দিত। তিনি বালকদের স্থির থাকতে বললেন।
নিজ অঙ্গুরী বা আংটি তিনি কূপে নিক্ষেপ করলেন এবং ভাঁটা ও ঐ অঙ্গুরী কয়েকটি কাশতৃণের সাহায্যে উদ্ধারের অঙ্গীকার করলেন। এত বলে তিনি একটি ঈষীকা আনলেন। মন্ত্র পড়ে দ্রোণ ঈশীকা ছুড়লেন। মন্ত্র তেজে ঈষীকা লৌহভাঁটা ভেদ করল। একের পর এক ঈশীকার উপর ঈশীকা ছুড়তে লাগলেন দ্রোণ। কাশতৃণের উপর কাশতৃণ যুক্ত হয়ে হয়ে দীর্ঘাকার হল। শেষ ঈশীকা ধরে টান দিয়ে দ্রোণ লৌহভাঁটা উপরে টেনে ওঠালেন।
সকলে তা দেখে অবাক হল। দ্রোণ এরপর ধনুর্বাণ নিয়ে মন্ত্র পড়ে বাণ মারলেন এবং শরসহ অঙ্গুরী উপরে উঠে এল।
এই দুষ্কর কর্মটি দেখেও সকলে চমৎকৃত হল। সকলে দ্বিজকে কোথা থেকে এসেছেন, তার গৃহ কোথায় এ সকল প্রশ্ন করতে লাগলো। সকলে তার কর্মে অভিভূত হয়ে তার সকল আজ্ঞা পালনে সম্মত হল। তাদের বচনে দ্রোণ সন্তুষ্ট হলেন এবং নির্দেশ দিলেন ভীষ্মকে গিয়ে তার আগমনের সমাচার জানানোর জন্য। ভীষ্মকে তার বর্ণনা দিলেই তিনি তাকে চিনতে পারবেন এবং যথার্থ সন্মান জানাবেন।
এত শুনে সকল কুমার দ্রুত ভীষ্মের কাছে গমন করে এক শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণের অদ্ভূত কর্মের বিবরণ জানাল। সকল ঘটনা শুনে ভীষ্ম বুঝলেন এ দ্রোণাচার্য ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। এতদিনে কুরুবংশের যোগ্য গুরু মিললো ভেবে তিনি সন্তুষ্ট হলেন।
দ্রোণাচার্য
দ্রোণের কাছে ভীষ্ম দ্রুত উপস্থিত হলেন, তাকে প্রণাম জানালেন।
দ্রোণ ভীষ্মকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গন করলেন। ভীষ্ম তাঁর সম্পর্কে আরো যানতে চাইলে দ্রোণ আত্ম বিবরণ দিলেন।
তপোবনে বহু কষ্টে তিনি তপস্যা করেন। ফলমূলাহার করেন, জটাবল্ক পরিধান করেন। এভাবে বহুদিন তপস্যা চলে। এসময় তার পিতৃবাক্য স্মরণে আসে। বংশহেতু পিতৃ আজ্ঞানুসারে গৌতমী কৃপের ভগ্নী কৃপীকে বিবাহ করেন। তার গর্ভে একপুত্র জন্মায়। দেবতারা তার নাম রাখেন অশ্বত্থামা। পুত্র শিষ্যদের সাথে ক্রীড়া করে। একদিন হঠাৎ পুত্র পিতার কাছে এসে কাঁদে গরুর দুধ পান করার বায়না করল। পুত্রের তৃষ্ণা নিবৃত্তে দ্রোণ বহুস্থান ভ্রমণ করলেন যদি কোন সত্যশীল ব্যক্তি গবীদান করে। কিন্তু কেউ গবীদান করল না। গরু না পেয়ে তিনি গৃহে ফিরলেন। দেখলেন বালকের দল পিটলী জল পাত্রে ভরে এনেছে। সকলে তা দুধ বলে অশ্বত্থামাকে দিল এবং সে আনন্দিত মনে তা পান করল। অশ্বত্থামার বোকামিতে সকল বালক আনন্দ করতে লাগল। তাদের সাথে পুত্রও নাচতে লাগল দুগ্ধপান করেছে ভেবে। তা দেখে বালকরা বলাবলি করতে লাগলো যার পুত্র দুধ ভেবে চাল গোলা জল পান করে সেই দ্রোণকে শত শত ধিক্কার। সকলে দ্রোণকে উপহাস করতে থাকল। অভিমানী পুত্র পুনরায় পিতার কাছে এসে দুগ্ধপানের আকুতি জানাল। পুত্র বাক্যে তার চিত্তে অনুতাপ হল। জননীও বিলাপ করতে লাগলেন। দ্রোণ আপন জপ-তপ সব কিছুকে ধিক্কার জানালেন। পৃথিবীতে গৃহবাসী ধনহীন সকলকেই ধিক্কার। এত ভেবে তিনি বাল্য সখা দ্রুপদের কাছে যাবেন স্থির করেন। পূর্ব প্রেমের কথা ভেবে তিনি পাঞ্চালে উপস্থিত হলেন। কিন্তু দরিদ্র বলে নৃপ তাকে চিনতে চাইলেন না। নিষ্ঠুর বচনে তাকে আঘাত করলেন। তার সকল বাক্য দ্রোণের মর্মভেদ করল। সে কারণে তিনি প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেন। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে তিনি হস্তিনানগরে উপস্থিত হলেন।
ভীষ্ম তার আগমনকে নিজের বড় ভাগ্যই মনে করলেন। ভীষ্ম কৌরব ও পান্ডব বালকদের শিক্ষার ভার দ্রোণের হাতে তুলে দিতে চাইলেন। দ্রোণ কৃপা করে তার পৌত্রদের শিক্ষাদান করুন এ অনুরোধ ভীষ্ম জানালেন। দ্রোণকে বহু ভাবে পূজা করলেন। থাকার জন্য সুরত্নময় গৃহদান করলেন।
....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ৫৩
Click This Link
আলোচিত ব্লগ
আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(
আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।
ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )
যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন
কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন
একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।
এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।
ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন