somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

দীপু সিদ্দিক
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। সাগর মহাসাগর পেরিয়ে অনেক দুরে এসে শত জটিল গবেষণা করলেও জন্মস্থানের সাথে নিয়তই নাড়ির টান অনুভব করে যাই। আর বাংলাভাষা যে মস্তিস্কের অনেকটা স্থান জুড়ে আছে, তা সহজেই অনুমেয়।

ভালবাসার গল্প (মধ্যাংশ)

৩১ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিতুমীর কলেজে পড়াশুনাটা আমার ভালই চলছিলো। বাড়ি থেকে আসা নগদ টাকা আর অবসর সময়ে দু’একটা টিউশানি মিলিয়ে ভালই কাটছিলো আমার ছাত্র জীবন। নিয়মিত পড়াশুনা আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা। ক্রমাগত মফস্বলের চেয়ে ঢাকার জীবনকে ভাল লাগতে শুরু করল।
নুড়িকে চিঠি লিখতাম নিয়মিত। সপ্তাহে অন্তত একটা। চিঠি পাঠাতাম ওর কাছের বান্ধবি সোনালী’র ঠিকানায়। নুড়ি না বলে ওকে নাম দিয়েছিলাম ‘পদ্ম’। ছোটন না লিখে ও আমাকে লিখত ‘টগর’ বলে। প্রেমপত্রের সাংকেতিক ভাষা। সহজে ধরা পড়ার ভয় থাকে না। হা! হা!
ডাকপিয়ন ভদ্রলোক আলী আহমেদ। দু মাসের মধ্যেই আমার খুব পরিচিত ও আপনজনের মত হয়ে গেলো। প্রতি সপ্তাহে দেখা হতো ওনার সাথে। পঞ্চাশোর্ধ শুকনা মানুষটা আমাকে দেখে প্রতি সপ্তাহেই স্মীত হেসে বলত ‘ছোটন, দেখো বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে’। ব্যাস্ত সময়ের মধ্যেও মাঝে মাঝেই আমার সাথে খানিক বসত। টুকটাক গল্প করতাম আমরা। আমার বাড়ির গল্প। রাজশাহীতে পড়ুয়া ওনার বড় ছেলের গল্প।
প্রতি মাসেই মা আমাকে চিঠি লিখত। আপুও লিখত মাঝে মাঝে। তবে বেশিরভাগ সময়েই দেখতাম নুড়ির চিঠি। সেই গুটি গুটি হাতের লেখায় যত্নকরে লেখা আমার নাম ঠিকানা। সবার চিঠিতেই যেন বিষয়বস্তুর খুব একটা পার্থক্য থাকতো না। নিত্যদিনের আবেগ, উপদেশ আর খবরাখবর। ‘শরীরের দিকে যত্ন নিও!’ ‘খাওয়া দাওয়ার কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো?’ ‘প্রতিদিন একটা করে মুরগীর ডিম খেও!’ ‘আমাদের পাড়ার দর্জি হারুন চাচা পরশু মারা গেছেন। মাত্র ৪২ বছর বয়স। এলাকার সবার মন খারাপ।‘ ‘তোমার বন্ধু তারেকের অসুখ কি সেরে উঠেছে?’ ‘অপরিচিত লোকদের সাথে তেমন মিশতে যেও না!’ ‘গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে একটা দু:স্বপ্ন দেখেছি, খুব সাবধানে থেকো!
কিন্তু তার পরেও কেন যেন নুড়ির চিঠিগুলোকে অন্য চিঠিগুলোর তুলনায় বড় আপন আপন মনে হত। দুপুরের প্রচণ্ড গরমের পরে পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় বন্ধুরা মিলে রামপুরার দিকে ঘুরতে যেতাম। খোলা মাঠে হাটতে হাটতে নুড়ির কথা, নুড়ির চিঠির কথা ভাবতে ভালো লাগত।
পড়াশুনা শেষে নুড়িকে নিয়ে ঢাকায় সংসার পাতার পরিকল্পণা করা ছিলো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। এমনকি ‘এই বাসা ভাড়া দেওয়া হইবে’ সাইনবোর্ড লাগানো বাড়ির মালিকদের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে কথাও বলতাম মাঝে মাঝে।
তিতুমীর কলেজে আমার কাছের বন্ধুরা সবাই নুড়িকে চিনত। সময়ে অসময়ে মেয়েদের প্রসঙ্গ আসলে নুড়ির কথা তুলতাম বলেই হোক, অথবা চেনা অচেনা মেয়েদের সাথে নুড়ির তুলনা করতাম বলেই হোক, ওরা নুড়িকে ভাল করেই চিনত। সবাই এমনই জানত যে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বছর ঘুরতেই আমি ওকে ঢাকা নিয়ে আসছি।
এর মাঝে আপুর বিয়ে হয়ে গেলো। দুলাভাই ঢাকায় ব্যাবসা করেন। বেশ সম্ভ্রান্ত আর বনেদি ঘরের ছেলে। বিয়ের পর আপু ঢাকায় চলে আসায় বাড়িতে মা একা হয়ে গেলো। সংসারের কাজে সাহায্যের জন্য ঘন ঘন বাড়িতে যেতে হতো আমার।
নুড়ির সাথেও ঘন ঘন দেখা হতে লাগল। মফস্বলের বন্ধুদের সাথে আমরা বিকেলে একসাথে আড্ডা দিতাম। ফুচকা খেতাম। হাজার রকমের হাসি ঠাট্টা আর গল্প করতো সবাই। আর আমি ক্ষণে ক্ষণে নুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতাম। ওকে দেখে প্রতিবারই মুগ্ধ হতাম। নুড়িকে নিয়ে নিকট ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলোর পরিকল্পণা করতে আমি তখন খুবই উৎসাহী ছিলাম।
মাকে নুড়ির কথা বলতে প্রথমে মা রাজি হলো না। মন খারাপ করল। নুড়ির মত একটা সাদাসিধে মেয়ে কিছুতেই মায়ের মন ভরাতে পারছিলো না। মা তার ঢাকায় পড়ুয়া রাজপুত্রের জন্য অনেক সুন্দরি রাজকন্যা ধরে আনার স্বপ্ন কিছুতেই ভাঙ্গতে রাজি নয়।
মায়ের হাত ধরে হেসে বললাম ‘নুড়ি’ই আমার অনেক সুন্দরি রাজকন্যা মা। আমি জানি, নুড়িকে নিয়ে আমি অনেক সুখে থাকব।‘
মা আমার দিকে মমতা নিয়ে তাকালো এবং রাজি হয়ে গেলো। বলল ‘কালকে নুড়িকে আমাদের বাড়িতে একবার আসতে বলতো। আমি ভালমন্দ কিছু রান্না করি।‘ বলেই মা আমাদের কাজের ছেলে হাসানকে ডাকল আর পাকের ঘরে বুয়াকে নিয়ে জিনিসপত্রের ফর্দ তৈরি করতে লেগে গেল।
নুড়ি চিঠিতে লিখেছিলো ‘মায়ের জন্য চিন্তা করো না। আমি মাঝে মাঝেই মায়ের কাছে যাই। উনি খুব ভাল আছেন। খুব খুশির একটা খবর আছে। মা আমাকে বলেছেন- শিঘ্রই আমাদের বাড়িতে লোক পাঠাবেন। বাবা-মাকে দাওয়াত দিবেন। বিয়ের জন্য তৈরি হও’।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। নুড়িকে বিয়ে করার জন্য আমার আর তৈরি হওয়া হয় নি।
গল্পটা খুব একটা বড় নয়। মাসখানেক নুড়ির কোন চিঠি আসছিলো না। একদিন হঠাৎ-ই নুড়ির বেয়ারিং চিঠি। ‘বাবা আমাকে বিয়ে দেবার আয়োজন করেছেন। তাড়াতারি বাড়ি আসো। হয় জলদি আমাকে বিয়ে করার ব্যাবস্থা কর, না হয় এই বিয়ে বন্ধ কর। আমি এখন মরে যাবার অবস্থায় আছি।‘
আপু-দুলাভাই নুড়িদের বাড়িতে গেলো। মা নুড়ির বাবা মা’কে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে আনলো। কথা বললো। সমাজে আমি একজন সাধারণ ছাত্র, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা নাই। সমাজে পারিবারিক মর্যদা থাকলেও এরকম একটা ছেলের আশায় নিজেদের আদরের মেয়ের ভবিষ্যত অনিশ্চিত করতে কে’ই বা চায়। সরকারি কর্মকর্তার মত একজন যোগ্য পাত্রকে ওরা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
নুড়ির বিয়ে হয়ে যায় আমার বি.এ. পড়ার মাঝামাঝি সময়েই।
আমার সামনে ও কোন কান্নাকাটি করেনি। আমাকে চিঠি লিখে কোনো আবেগী কথাও লেখেনি। সত্যি বলতে কি, এর পর ও আমাকে আর কোন চিঠীই লেখেনি। নুড়ি আমাকে গোপনে বিয়ে করার প্রস্তাবও দেয়নি। অথবা আত্মহত্যারও কোন চেষ্টা করেনি।
মা বলেছিলো বিয়ের দুইদিন আগে নুড়ি আমাদের বাড়িতে এসেছিলো। দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি মায়ের সাথে বসেছিলো। মা নাকি ওকে অনেক কথা বলেছিলো, এ কথা ও কথা জানতে চেয়েছিল, শান্তনা দিয়েছিলো। ও তেমন কোন উত্তর দেয়নি, অনুরোধ করেনি অথবা কাঁদেনি। চুপকরে মায়ের পাশে বসেছিলো আর ক্ষণে ক্ষণে মায়ের মুখ দেখছিলো। (চলবে)



প্রথমাংশ-এর লিংক: Click This Link
শেষাংশ-এর লিংক: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:২৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×