বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব আবির্ভূত হন একজন স্বৈরাচারি ফ্যাসীবাদী নেতা রূপে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়,শুধু সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নেতা যিনি একদলীয় শাসনের ঘোষণা দেন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুযারিতে মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে দেশার সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করা হয়। দেশে কি গণতন্ত্র চর্চা বাড়াবে, গণতন্ত্র মৃত্যুবরণ করেছিল দলটির নিজের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের কোন নেতাই সেদিন শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈরাচারি রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। নেতা ও কর্মীগণ পরিণত হয়েছিল বিবেকহীন চাটুকারে। মুজিব পরিণত হয় বাংলাদেশের হিটলারে। সেদিন একমাত্র জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন -এ দুই ব্যক্তি তার একদলীয় বাকশালী নীতির বিরোধীতা করে পদত্যাগ করেছিলেন। লক্ষণীয় হল, এ দু’জনের কেউই আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন না।
দেখা যাক, মুজিব সম্বন্ধে এ নিয়ে তার অতি কাছের লোকেরা কি বলেন।
“১১ই জানুয়ারি (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। রিসিভার তুলিয়া একটি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। কন্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন হইতে বন্ধূ; ..টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন, “শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি এবং প্রস্তাবও করিয়াছি। কারণ তিনি যে কোন পদেই বহাল থাকুন না কেন, তাঁহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ শাহেবের মানসিক গড়ন তুমিও জান; আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ্। অতএব ক্ষণিকের ভূল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারী কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনে পরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মান্ত্রিক নাম-মাত্র দায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসনে পরিণত করিবেন। এই দিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তোমার মত কি?” তদুত্তরে তাঁহাকে বলি, “তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবের শুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা, ক্ষমতার লোভ তাঁহার সহজাত।” তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম, মৌলিক প্রশ্নে তোমার আমার মধ্যে মতভেদ হইবে না।” -(অলি আহাদ)। উল্লেখ্য, জনাব অলি আহাদ ছিলেন পঞ্চাশের দশকে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।
দেখা যাক, কীরূপ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিবের নিজের ধারণা। একাত্তরে ৯ মাস যুদ্ধচলা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের মুজিব নগর সরকার ছিল ভারতের আশ্রীত সরকার। এমন সরকারের কোন মেরুদন্ড থাকে না। জনাব তাজউদ্দিন ও তার মন্ত্রীদের প্রতিদিনের থাকা, খাওয়া-দাওয়া ও ভরন-পোষনের সমুদয় ব্যয় বহন করত দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী সরকার। খাঁচার পাখির নিজে শিকার ধরার সামর্থ থাকে না, মনিব যা দেয় তাই খেতে হয়। মনিব মন জোগাতে তখন তার শেখানো বুলিও তখন গাইতে হয়। তাজউদ্দিন সরকারের অবস্থাও তাই ছিল। ফলে তাকে দিয়ে ভারত সরকারও খুশী মত চুক্তিও সই করিয়ে নেয়। কোন স্বাধীন দেশ এমন চুক্তি কখনও স্বাক্ষর করে না। তাজউদ্দিনের স্বাক্ষরিত তাই ৭ দফা চুক্তিনামাটি হল নিম্নরূপঃ
১। ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হইবে। গুরুত্বের দিক হইতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী হইতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হইবে। (পরবর্তীকালে এই চুক্তির আলোকে রক্ষী বাহিনী গড়া হয়)।
২। ভারত হইতে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিতে হইবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তাহা করিতে হইবে।
৩। ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করিতে হইবে।
৪। বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।
৫। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হইতে হইবে।
৬। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাইবে না।
৭।ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যে কান সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিবে।
উপরে বর্ণিত চুক্তিগুলিতে মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তাজউদ্দিনের বদলে যখন শেখ মুজিব ক্ষমতা হাতে নিন তখনও কি ভারতের প্রতি এ নতজানু নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল? আসেনি। তাজউদ্দিন যে দাসখতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেগুলো শেখ মুজিবও মেনে নেন। "১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সাল বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তিতে সেগুলি সন্নিবেশিত করা হয়।" -(অলি আহাদ)
বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সেদিন বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিল "তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি" রূপে। মুজির আমলের এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। আগামী হাজার হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে এ বদনামের বোঝা ও কলংক বইতে হবে। ভারত শুরু থেকেই চাচ্ছিল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল বিলুপ্ত করা যদি সম্ভব না হয়, অন্ততঃ অর্থনৈতিক সীমান্ত লোপ পাক। যাতে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে অবাধে প্রবেশাধিকার পায়। আর এ লক্ষ্যে ভারতকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবের ফেরে আসার তিন মাসের মধ্যে ভারত তার থেকে সে অধিকার আদায় করে নেয়। ভারত ১৯৭২ সালের ২৭ই মার্চ মুজিব সরকারের সাথে সীমান্তের ২০ মাইল অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে। আর এ চুক্তি মোতাবেক ভারতীয় পণ্যের জন্য সমগ্র সীমান্ত খুলে দেন। ফলে ভারত অনায়াসেই পায় বৃহৎ বাজার। ভারত পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রতিবেশী ছিল। কিন্তু অখন্ড পাকিস্তান তার ২৩ বছরে একটি দিনের জন্যও ভারতীয় পণ্যের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়নি। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে বরং সীমান্ত পাহারা দিয়েছে যাতে নিজ দেশের পণ্য বিদেশী হামলার মুখে না পড়ে। ফলে সে আমলে ভারতের চেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়েছে শিল্পোন্নায়ন। বেড়েছিল কুঠির শিল্প। ব্যাপক ভাবে বেড়েছিল তাঁতশিল্প। অথচ মুজিব সে নিরাপত্তা দিতে পারেনি দেশের সে ক্ষুদ্র শিল্পকে। ফলে দ্রুত ধ্বস নেমেছে দেশের অর্থনীতি। দেশের কলকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে কুটির শিল্প। শুধু ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার করে দেওয়ার লক্ষ্যে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন বেকার হয়েছে। নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আর এতে প্রাণ হারিয়েছে বহু লক্ষ। মুজিব শুধু নিজের গদীর স্বার্থে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এমন ভয়ানক মৃত্যু ও বিপদ ডেকে আনে।
১৯৭১-এর যুদ্ধে বিজয়ে ভারতের প্রভূত রাজনৈতিক ও সামরিক সুবিধা হয়েছিল। ভারত তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দীকে দ্বিখন্ডিত করে নিজে দক্ষিণ এশিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দি হয়েছে সেটি সত্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় লাভটি হয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বাজার লাভটি ছিল তার সবচেয়ে বড় বিজয়। এটি ছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের সম্মিলিত আভ্যন্তরীন বাজারের চেয়েও বিশাল। এক কালে এ বাজার দখলের জন্যই ইংরেজেরা হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এ দেশটিতে ছুটে এসেছিল। তবে ভারত শুধু বাজার দখল করেই ক্ষান্ত দেয়নি। বাংলাদেশের পণ্য যাতে নিজ দেশে এবং বহিঃবিশ্বে ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা না করতে পারে তারও পাকা ব্যবস্থা করেছিল। ইংরেজেরা তাদের পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা নির্মূল করতে বাংলাদেশের মসলিন শিল্পের তাঁতীদের হাত কেটেছিল। সে অভিন্ন লক্ষে ভারত বাংলাদেশের তাঁতীদেরই শুধু নয়, পুরা শিল্পকেই ধ্বংস করেছিল।
শেখ মুজিব দেশের সমস্ত শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন, সেগুলিকে কেড়ে নিয়েছিলেন তাদের আসল মালিকদের থেকে। এবং তুলে দিয়েছিলেন তার অযোগ্য ক্যাডারদের হাতে। আর এ ক্যাডারগণ যে শুধু শিল্প-পরিচালনায় অযোগ্য ছিল তাই নয়,সীমাহীন দুর্নীতি পরায়নও ছিল।
সে অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও শিল্পধ্বংসের কিছু উদাহরণ দেওয়া যাকঃ “আদমজী জুট মিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। পাটজাত দ্রব্যে বিদেশে রফতানি করে এ মিলটি শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা আয় করেছে। ভারতের পাটকলগুলির সামর্থ ছিল না তার সাথে প্রতিযোগিতার। অথচ মুজিব সরকার এত বড় একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে লোকশানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। শেখ মুজিব এ মিলের দায়িত্বে বসিয়েছিলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। উৎপাদন বাড়ানোর চেয়ে এ মিলের মূল কাজ হয় আওয়ামী কর্মীদের এ মিলে চাকুরি দিয়ে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা। ১৯৭৪ সালের ২২ই মার্চ ইত্তেফাক এ মর্মে খবর ছেপেছিল যে পাট শিল্পে ২৫ হাজার বাড়তি ও ভূয়া শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৬ শত ভূয়া কর্মকর্তা রয়েছে।” - (মুনির উদ্দীন আহমদ, ১৯৮০)। কথা হল, একটি মাত্র মিলে যদি ২৫ হাজার ভূয়া শ্রমিক দেখিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডার পালনের ব্যবস্থা করা হয় তবে সে কারখানা যত লাভজনকই হোক তা কি টিকে থাকতে পারে? যেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি কাঁচাপাট ও পাটশিল্পজাত পণ্য রফতানী আয়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল (রফতানীপ্রসূত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা তিরানব্বই ভাগই অর্জিত হত এ শিল্প থেকে), সেখানে মুজিব কোন ব্যবস্থাই নেইনি এ শিল্লকে ধংসের হাত থেকে।
মুজিবের হাতে অর্থনীতির বিনাশের যে কাজ শুরু হয়েছিল, সেটি শুধু পাটশিল্পে সীমাবদ্ধ থাকে নি। ধ্বংস নেমে আসে চা এবং চামড়া শিল্পেও। শিল্পের এ দুটি খাতও ছিল বিদেশের বাজারে ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দিতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের কোন ইচ্ছাই ছিল না ভারতের সাথে কোন রূপ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় নামার,ফলে একাত্তরের পূর্বে বিদেশে বাংলাদেশের চা ও চামড়ার যে বাজার ছিল ভারত তা অতি সহজেই দখলে নিয়ে নেয়। মুজিবামলে দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি ঘটে তার বিবরণ জনাব অলি আহাদ দিয়েছেন এভাবেঃ
“(পাকিস্তান আমলের) এক টাকার গামছার দাম হয় সাত টাকা।পাঁচ টাকার শাড়ীর দাম হয় পঁয়ত্রিশ টাকা। তিন টাকার লুংগি পনের টাকা বা কুড়ি টাকায়, দশ আনা বা বার আনা সেরের চাউল হয় দশ টাকায়। আট আনা সেরের আটা ছয়-সাত টাকা। দুই আনা সেরের কাঁচা মরিচ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। তিন-চার টাকা সেরের শুকনা মরিচ আশি-নব্বই টাকা।আট আনা সেরের লবন চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তৈল তিরিশ-চল্লিশ টাকা। সাত টাকা সেরের নারিকেল তৈল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। সাত টাকার লাঙ্গল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।”
মুজিবামলে বাংলাদেশে যে ভয়ানক দূর্ভিক্ষ নেমে আসে তাতে মৃত্যু হয় বহু লক্ষ মানুষের। ১৯৭০ সালের নভেম্বরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস যত (প্রায় দশ লক্ষ) মানুষ মারা গিয়েছিল এ সংখ্যা ছিল তার চেয়েও বেশী। সে ভয়াভহ দুর্ভিক্ষর নেমে এসেছিল মূলতঃ দুটি কারণে। প্রথমতঃ শেখ মুজিব সরকারের সীমাহীন দূর্নীতি ও অযোগ্যতা, দ্বিতীয়তঃ ভারতের সীমাহীন শোষণ। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের লক্ষ্যে ভারত আরেকটি বৃহত প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশের ক্যারেন্সি নোট ছাপানোর মধ্য দিয়ে। মুজিব ভারতকে যে পরিমাণ নোট ছাপতে বলেছিল তার চেয়ে বহু শত কোটি টাকার বেশী নোট ছেপে বাংলাদেশী টাকার চরম অবমূল্যায়ন ঘটায়। ভারত যে অতিরিক্ত নোট ছেপে বাংলাদেশী অর্থনীতির সর্বনাশ করছে সেটি অন্যরা বুঝলেও সেটি শেখ মুজিব বুঝেছিল অনেক দেরীতে। ফলে ভারতীয়রা বাড়তি সময় পায় আরো বেশী বেশী নোট ছেপে বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রায় অর্জিত সোনা-রোপা ও বিদেশী যন্ত্রাংশ এবং সেই সাথে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত খাদ্যশস্য সহ বিভিন্ন পন্য কিনে ভারতে পাচারের। আর এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের অতি সুস্পষ্ট দুবৃর্ত্তী। ভারতের এ অপরাধের কারণেই বাংলাদেশে নেমে আসে দূর্ভিক্ষ এবং তাতে মৃত্যু ঘটে লক্ষ লক্ষ মানুষের। আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিব সবসমই নিজেদের ব্যর্থতাকে অন্যদের ঘাড়ে চাপাতে অভ্যস্থ। শিল্পের এ দূর্গতির জন্যও তারা একাত্তরের যুদ্ধকে দায়ী করে। কিন্তু সেটি সঠিক ছিল না। এ ব্যাপারে ১৯৮০ সালে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল,
“একাত্তরের যুদ্ধের বছর নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তেমন কোন শিল্প প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। আসলে যুদ্ধটা একটা অজুহাত মাত্র। তাছাড়া জাতিসংঘের ত্রাণ কমিটির এক হিসাব থেকেও জানা যায়,বাংলাদেশের যুদ্ধজনিত সমস্ত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বাংলাদেশে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল তেরগুণ বেশী।”-(ইত্তেফাক সেপ্টম্বর ৩,১৯৮০)।
শেখ মুজিব যে শুধু গণতন্ত্র হত্যা করেছেন,দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছেন বা জাতিকে ভারতের গোলাম বানিয়েছেন তা নয়, তার চেয়েও বড় ক্ষতি করেছেন জাতির মেরুদন্ড ধ্বসিয়ে দিয়ে। একাত্তারের যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয়নি। কিন্তু লেখাপড়া না হলে কি হবে শেখ মুজিব ছাত্রদের কোন পরীক্ষা না নিয়েই পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেন। ফলে যুদ্ধকালীন নয় মাসে ছাত্রদের যা শেখা উচিত সেটা শেখা ও শেখানোর আর কোন সুযোগই থাকল না। এমনকি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা না নিয়ে পাসের ব্যবস্থা করা হয়। সেসময় বহু কলেজের প্রিন্সিপাল পদে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা ছারাই বসানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের এবং প্রচুর সার্টিফিকেট বিতরণ হয়, কোন জ্ঞান বিতরণ ছাড়াই। তার আমলে পরীক্ষার হলে ব্যাপক ভাবে নকল শুরু হয়। নকল সরবরাহকারিরা তখন বই নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে হাজির হত। শিক্ষাক্ষেত্রে যে সীমাহীন অরাজকতা, দূর্নীতি ও শিক্ষাদানে চরম অবব্যবস্থা তিনি সৃষ্টি করেছিলিন সেটি বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সাংঘাতিক খবর ছড়িয়ে পড়িছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ফল দাঁড়ালো, বাংলাদেশী ডিগ্রি বিদেশে মূল্য হারালো, এবং এভাবে ইজ্জত হারালো শিক্ষিতরা। ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোর স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়। শেখ মুজিব এভাবে কালিমা লেপন করলেন, বাংলাদেশী শিক্ষিতদের মুখে। মুজিবামলে ট্রান্সপ্যারেনসী ইন্টারন্যাশনাল জন্ম নেয়নি। সেটির জন্ম হলে দূর্নীতি পরিমাপের সে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশ যে সে আমলেও বিশাল ব্যবধানে বিশ্বে প্রথম হত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে কি? বাংলাদেশ পরবর্তীতে যে ভাবে দূর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম (উল্লেখ্য বাংলাদেশ এ পর্যন্ত 5 বার দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে যার মধ্যে শেখ হাসিনার 96-এ ক্ষমতা যাওয়ার শেষের 2 বছর এবং জোট সরকারের প্রথম 3 বছর) হয়েছে তার বিশাল চর্চা তো শুরু হয়েছিল মুজিব আমল থেকেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




