ভারতীয়দের যে বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো - বছরে যে কোন একটি সময় ১০-১২দিনের জন্য কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়া। ঠিক করলাম পূজোর ছুটিটা কাজে লাগাবো। বিশাখাপত্তনম, যা ভাইজাগ নামেই সর্বাধিক পরিচিত, ভারতীয়দের অন্যতম একটি ট্যুরিস্ট স্পট। রামকৃষ্ণ ও ঋষিকোন্ডা দুটি বিচ রয়েছে এ শহরে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এ শহরের উপকন্ঠে ভারতের অন্যতম পোতাশ্রয়। পূজা শুরুর একসপ্তাহ আগে ভাইজাগ আর জগদ্দলপুর দেখবো বলে অন্ধ্রপ্রদেশ আর ছত্রিশগড় এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পুরো দুদিনের রেল যাত্রা। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ইড্লি আর ধোসায় ব্রেকফাস্ট সেরে যাত্রাপথের অপূর্ব সৌন্দর্য ঠিক উপভোগ করতে পারলাম না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার ব্রডগেজ লাইনে চলতে চলতে ৪৮টি ট্যানেল পার হওয়ার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা যতটা রোমাঞ্চকর হবার কথা ছিল ঠিক ততটা হয়নি। মনে হচ্ছিল কখন যে যাত্রা শেষ হবে। আসলে সংসারের নিয়ম বোধকরি এমনই। নিজের মন দিয়েই আমরা বিশ্বসংসারকে বিচার করে যাই। একই সৃষ্টি তাই কারো চোখে সুন্দর আর কারো চোখে কদাকার। আর তাই কোন মহত্তের যারা বিরূপ সমালোচক তারা বুঝি কোন না কোন ভাবে ক্ষুধার্ত। শেষ পর্যন্ত জগদ্দলপুর হোটেলে লাগেজপত্র রেখে প্রায় আধঘন্টা হেঁটে খুঁজে বের করলাম বাঙালি খাবার। অবাক করার বিষয় হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে তখন জগদম্ভা পূজা হচ্ছে। আর এটি দূর্গাপূজারই একটি সংস্করণ। এ অঞ্চলটি বাস্তার নামে পরিচিত ছিল। পরদিন তিরতগড় আর চিত্রকূট জলপ্রপাত দেখে আমরা বিমোহিত। তিরতগড়-এর মুগ্ধতা এতোটাই আমার আড়াই বছরে ছেলে ১০০ ফুট উঁচু প্রপাতের পাদদেশে যেতে প্রায় ৬০০ টি সিঁড়ি ভেঙ্গে পায়ে হেঁটে উঠা-নামা করেছে। আর চিত্রকূট জলপ্রপাত ভারতের নায়াগ্রা হিসেবেই বেশী পরিচিত। বালাজি মন্দির আর দন্তেশ্বরী মন্দির ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিশেষ আকর্ষণ। জগদ্দলপুর হতে আরাকু ভ্যালী হয়ে ভাইজাগ যাবার পথে বোরা গুহা দেখার কথা মনে থাকবে আমৃত্যু। গুহার উপরের অংশে প্রাকৃতিকভাবে তৈরী শিবলিঙ্গটি দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ নেই। এই গুহাটির ঠিক উপর দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন। আমার মতো সাধারণের লেখায় এর সুনিপুন বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। ভাইজাগ পৌঁছে রামকৃষ্ণ আর ঋষিকোন্ডা বিচ দেখে মনে হল কক্সবাজারকে আমরা মেলে ধরতে পারলাম না। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখলে কেউ আর ভাইজাগ যাবে না অন্ততঃ বঙ্গোপসাগরের জলে পা ভিজাতে। কিন্তু তারপরও মানুষ ভাইজাগ যাবে একটি পরিচ্ছন্ন দেখার আকাঙ্খায়, সিমাচলম মন্দিরে নরসিংহরূপী বালাজী নামক দেবতার দর্শনে। থাক, সে গল্প অন্য কোথাও করা যাবে।
ষষ্ঠিপূজোর শেষরাতে হাওড়ায় নেমে ট্যাক্সি করে ফিরতে ফিরতে কলকাতাকে অপরিচিত মনে হল। অদ্ভুত সব মঞ্চ আর আলোকসজ্জায় এ এক অন্য কলকাতা। কত রকমের থিম আর কনসেপ্ট যে মানুষের বাইশ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে লুকায়িত তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ভগবান মানুষকে সীমাহীন ধৈর্য ধরার ক্ষমতা দিয়ে যদি না পাঠাতেন তাহলে কি দীর্ঘ দু-ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করতো একটি মাত্র মন্ডপ দেখার জন্য। তাইতো সল্টলেকের হ্যারিপটারের থিম নিয়ে পূজমন্ডপ দেখার জন্য ছেলেকে কোলে নিয়ে ভীড় ঠেলে হাঁটতে পেরেছি দু’কিলোমিটার। দক্ষিণ কলকাতার বড়িশা ক্লাবের সিরামিকের তৈরী প্রতিমা আর কলকাতার দাদা সৌরভের বাড়ীর পূজো দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই দু’ধরণের। বেলঘরিয়া, রাণীপার্ক, অভি আর দেবাদের সাথে ঢাক-শঙ্খধ্বনি, আরতি উপভোগের মুহূর্তগুলো যদি আবার ফিরে আসতো! পশ্চিম বঙ্গের মানুষের কৃপণতার বিভিন্ন কাহিনী এখনো এদেশের মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু মায়ের পুজায় সবকিছু উজাড় করে দেয়ার জন্যই কি এ কৃপণতা!

হিন্দু শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামের ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ
‘‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।’’
‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। আবার শ্রীশ্রীচন্ডী অনুসারে এই দেবী ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমুর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্নিলিত শক্তির প্রতিমুর্তি। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা একসময় এ বাঙলার মানুষের মনের মন্ডপেও আসতো ঢাক-শঙ্খের ধ্বনিতে। কিন্তু কালের বিবর্তনে কেন যেন পুজা উৎসবের চেয়ে উপলক্ষই হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের হতো আর রাষ্ট্রধর্ম মানবধর্ম হতো তবে বোধকরি বাঙালির উৎসবের দিন আরো বেড়েই যেতো।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ২:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




