somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৭ই নভেম্বর আসলে 'জয় বাংলা' হারিয়ে গিয়েছিল....

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, সোমবার (৪ নভেম্বর) কি যেন একটা ছুটি আছে না? তিনি উত্তর দিলেন, সঠিক জানি না, তবে ৭ নভেম্বর বোধহয় একটা ছুটি আছে। আমার পাল্টা প্রশ্ন- কিসের ছুটি?? বলেই মনে হল ওহ্ ৭ই নভেম্বর!!! না এখন আর ছুটি নেই- তাকে আশ্বস্ত করলাম। মনে পড়ল সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের দিন। আর এই দিনটি সরকারি ছুটি থাকত, পালন করা হয় সংহতি দিবস হিসেবে। এই সংহতি নাকি সিপাহী আর জনতার।

“শহীদ (!) রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নাকি সেদিন সিপাহী-জনতা পাল্টা অভ্যুত্থান করে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিলেন।” প্রতিটি তথাকথিত সিপাহী-জনতার সংহতি দিবসে শুনতে শুনতে মনের গহীনে প্রথিত হয়ে গিয়েছিল। একবারও ভাবি নাই কোন্‌ সিপাহী- কোন্‌ জনতার সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিল?? মনে যে আসতো না সেরকমটিও নয়- তবে উত্তরতো সবখানেই একই রকম- খালেদ মোশারফ নামের একজন ভারতীয় চর নাকি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন! সত্যি সেলুকাস্! একটি সদ্য স্বাধীনদেশের একটি প্রজন্ম কতটা মিথ্যার আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছিল- আজ বুঝতে পারছি- যার খেসারত আমরা এখনো দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র আর তার নাগরিকরা।

যেদেশে জলপাই রঙের পোষাক পরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হবার পর অফিসার-সৈনিক নির্বিশেষে বলে উঠে- ব্লাডি সিভিলিয়ান! সেই দেশে জনতা-সিপাহী মিলন হয় কি করে! তাহলে জনতা নামধারী ওরা কারা? আব্দুল জলিল-শাহজাহান সিরাজ-আসম আব্দুর রবের জাসদ! হ্যাঁ জাসদের সাথে আরো অনেকে যুক্ত হয়েছিল। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এ মাঠে নেমেছিল বামপন্থী অন্যান্য কিছু দলও। হায়দার আকবর খান রনো যেমনটি শতাব্দী পেরিয়ে-তে লিখেছেন ,‘রাতের মধ্যে আমি কাজী জাফর ও মেননের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই অভ্যুত্থানে আমাদের অংশ নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? কারা করছে তাও জানি না। যাই হোক,আমরা ভোর থেকে রাস্তায় থাকবো। সকাল থেকেই আমাদের সকল শক্তিকে সমবেত করে ঢাকার রাস্তায় থাকতে হবে। পরদিন সকাল ৯টার মধ্যে টঙ্গী থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক মিলের ট্রাক দখল করে ঢাকায় উপস্থিত হল। ..... পরদিন যখন অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা ও তরুণ ছাত্ররা নানা ধরণের বিপ্লবী শ্লোগান দিচ্ছে,তখন জুম্মার নামাজের পর একদল লোক খন্দকার মুশতাকের ছবি নিয়ে বের হয়েছিল। এত দ্রুত মুশতাকের ছবি এলো কোথা থেকে? তাহলে আগের রাতেই মুশতাকের ছবি ছাপানোর বা জোগাড় করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল?” তাহলে এরা কারা?? এরা কোন জনতা?? জামায়াতসহ পাকিস্তানপন্থী দলগুলো তখন নিষিদ্ধ ছিল- নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সেদিন রাস্তায় নামার চেয়ে বড় সুযোগ আর কি হতে পারে? সুতরাং সিপাহী-জনতার কথিত বিপ্লবের দিনে পাকিস্তানপন্থী একটি জনগোষ্ঠিও ছিল জনতার কাতারে।

জাসদ দাবি করে আসছিল ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনী নামক তাদেরই সশস্ত্র শাখা। এই সেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, যাদের হাত ধরে সমাজ বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন কর্ণেল তাহের। মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সক্রিয় হওয়া শুরু হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে একের পর এক সেনা ক্যু সংঘটিত হতে থাকে। ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার পর ১৫ই আগস্টের কুশীলবরা যখন ব্যাংককের পথে সেই সময় ও সুযোগটাকে কাজে লাগাতে শুরু করে তৎকালীন আন্ডারগ্রাউন্ডের দল জাসদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অন্তরালে সুযোগটা নিয়েছিল একটি স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী গোষ্ঠী। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটি করেছিলেন খালেদ মোশারফ। সঙ্গে মূল ব্যক্তি ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের প্রধান সাফায়াত জামিল। তবে মাঠ পর্যায়ের সব কাজ করেছিলেন মূলতঃ মেজর হাফিজ, মেজর গাফফার, মেজর ইকবাল, স্কোয়াডন লিডার লিয়াকত এবং মেজর নাসির উদ্দিন। এই মেজর নাসির উদ্দিনের গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বইটি পড়লে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। খালেদ মোশারফের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের দূরত্ব কেন হলো, কেনইবা কর্নেল নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে খালেদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। অথচ এই অভ্যুত্থানটি সফল হলে আজ বাংলাদেশের চেহারা অন্যরতম হতো! কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই অভ্যুত্থানেও তাহেরের সম্মতি ছিল। তাহলে তিনিই কেন আবার ৭ই নভেম্বরে পাল্টা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিলেন? তার মানে অন্তরালে কেউ তাদেরকে ব্যবহার করেছিলেন! যেমনটা মেজর ডালিম লিখেছেন, ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা দুইটি বিচ্ছিন্ন নয়। ঘটনা দুইটি একই সূত্রে বাঁধা। একই চেতনায় উদ্ভুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল এই দুইটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান। ১৫ই আগষ্ট অগ্রণীর ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ আর ৭ই নভেম্বর একই দায়িত্ব যৌথভাবে পালন করেছিল সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধিনস্থ গণবাহিনী। এই দুইটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চেতনা ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেতনা, ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার চেতনা, স্বৈরশাসন ও একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার চেতনা- এক কথায় বলতে গেলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। লরেন্স লিফশুলৎজ অসমাপ্ত বিপ্লব-এ যেমনটি লিখেছেন- ৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এবিএম মহমুদের বাসায় শুরু হয় জাসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসুদ, কাজী আরেফ প্রমুখ। আরো ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখ।
এই নায়েক সুবেদার মাহবুবর রহমান ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সভাপতি- যে কিনা রাতে প্রথম গুলি ছুঁড়ে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা করেছিল; তারই লেখা বই সৈনিকের হাতে কলম। বইটি পড়ে আপনার মনে হবে সুবেদার মাহবুব অত্যন্ত সাহসী। কিন্তু বিপ্লব! মাহবুবকে কখনোই আপনার বিপ্লবী মনে হবে না মনে হবে পথভ্রষ্ট, বিপথগামী, আর বড় ধরণের ভারত বিদ্বেষী। সুবেদার মাহবুব কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন- যুদ্ধ করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাথে। পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষের দিনগুলোর বর্ণনায় তিনি লিখেছেন- টাঙ্গাইলে ফেরার পর কাদের সিদ্দিকী সবাইকে নির্দেশ দিলেন সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিতে। হঠাৎ করে কাদেরের এই নির্দেশ শুনে ছেলেদের মধ্যে একটা বিদ্রোহের সূচনা হল। সবাই স্থির করল,কেহই অস্ত্র জমা দিবে না। প্রয়োজনে আমরা কাদের সিদ্দিকীকে শেষ করে দিব। কি ভয়াবহ চিন্তা-চেতনা! সেই অস্ত্র গোপনে দিয়ে দেওয়া হল ভাসানী ন্যাপের মুসাকে। রাতের বেলা ৩০/৪০টা গরুর গাড়ি ভর্তি করে অস্ত্র সরিয়ে ফেলা হল। দেখে দেখে ভাল ভাল অস্ত্র সরায়ে ফেলা হল। আর বাকি ছেলেদের বললাম তোমরা ইচ্ছা করলে যার যার মত অস্ত্র নিয়ে যেতে পার। ভবিষ্যতে কাজের জন্য। অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দেওয়া হল। সারারাত্রি যে যা পারল অস্ত্র নিয়ে গোপন করল। এরপর সুবেদার মাহবুব চলে যায় রক্ষী বাহিনীতে, যদিও পরে আবার সামরিক বাহিনীতে ফিরে আসে। বিপ্লবী নামধারী এই মাহবুব কতটা বিপথগামী হলে লিখতে পারে যে, টাঙ্গাইলে কাদের ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগৃহীত গোপন অস্ত্র দিয়ে গঠিত একটি ডাকাত বাহিনীর সাথে দেখা করার জন্য সে ঢাকা ক্যান্টনমন্টে থেকে টাঙ্গাইলে গিয়ে দেখে ঐ বাহিনীর অধিকাংশ ছেলে তার পরিচিত। সে তাকে তাদের দলে নেবার জন্য আহবান জানায়! এই মহান বিপ্লবী সুবেদার মাহবুব তাহেরের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিল। পুরস্কার হিসেবে অন্যান্য খুনীদের মতোই বাংলাদেশ মিশনে চাকরি পেয়েছিলো। এখন তিনি সপরিবারে জার্মানিতে আছেন।
মূলত তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব ছিল হত্যা উৎসব। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেছেন, এই সময়ে সেনাবাহিনীতে অফিসারের সংখ্যা ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের বাংলাদেশঃ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১ বইয়ে হত্যার অনেক বিবরণ পাওয়া যাবে। মে.জে. মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর লেখা এক জেনারেলের নিরব সাক্ষ্যঃ স্বাধীনতার প্রথম দশক বইতে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- আজও ভাবলে গা শিউরে ওঠে যে,ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত, তাহলে সারা দেশে সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে একটা নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেনী সংগ্রাম শুরু হয়ে যেত। সৈনিকদের সেদিনের শ্লোগানই ছিল- সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই,অফিসারদের রক্ত চাই। তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ে লে. ক. এম এ হামিদের বর্ণনা অনুযায়ী-
৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাত ১২ টায় বঙ্গভবনে সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ, কর্নেল হুদা ও হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখান থেকে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যেতে সিদ্ধান্ত নেন। পথে ফাতেমা নার্সিং হোমের কাচে তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে তিনি হুদা ও হায়দারসহ পায়ে হেটেই ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে পৌছেন। উক্ত ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিস। খালেদের আগমনের খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি টেলিফোনে টু ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদের উপস্থিতির কথা জানান। তখন ভোর প্রায় চারটা। জিয়ার সাথে ফোনে তার কিছু কথা হয়। এরপর তিনি মেজর জলিলকে ফোন দিতে বলেন। জিয়ার সাথে মেজর জলিলের কথা হয়। ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে এসে পড়ে। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিসের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। আফিসার মেসে বসে খালেদ-হায়দার-হুদা সকালের নাস্তা করছিলেন। হুদা ভীত হয়ে পড়লেও খালেদ ছিলেন ধীর,স্থির,শান্ত। হায়দার নির্ভীক নির্বিকারভাবে পরাটা মাংস খাচ্ছিলেন। এমন সময় মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল-আমরা তোমার বিচার চাই!খালেদ শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন,ঠিক আছে,তোমরা আমার বিচার করো। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার করে বললো-আমরা এখানেই তোমার বিচার করবো। খালেদ ধীর স্থির। বললেন, ঠিক আছে,তোমরা আমার বিচার করো। খালেদ দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন। ট্যারর-র-র-র! একটি ব্রাস ফায়ার। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার খালেদ মোশাররফ যার ললাটে ছিল বীরযোদ্ধার জয়টিকা,মাথায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তমের শিরোপা আর মাথার বাম পাশে ছিলো পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলার গভীর ক্ষতচিহ্ন। কামরার ভেতরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন আগরতলা ষড়যন্ত্রমামলার অন্যতম আসামী,মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার বীর বিক্রম কর্নেল নাজমুল হুদা। কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে যান কিন্তু সৈনিকদের হাতে বারান্দায় ধরা পড়েন । উত্তেজিত সৈনিকদের হাতে তিনি নির্দয়ভাবে লাঞ্চিত হন। তাকে সিপাহীরা কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
তার মানে জলিলের সাথে জিয়ার এসব হত্যার বিষয়েই আলোচনা হয়েছিল! মানে দাঁড়ালো কেবল সিপাহী না, সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশেই এসব হত্যাকান্ড হয়েছিল। বিপ্লবী সৈনিকরা তালিকা তৈরি করে অফিসার হত্যা করছিল। রশীদ-ফারুকদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুগত অসহায় সৈনিকগন আর পাকিস্তান-ফেরত কোনঠাসা হয়ে থাকা সৈনিকরাও সেদিন সক্রিয় হয়ে যোগ দেয় হত্যা-উৎসবে।
তাহেরের বিপ্লবের একটা বড় উপজীব্য ছিল ভারত বিরোধিতা। কর্নেল তাহের তার জবানবন্দীতেও বলেছেন, তেসরা নভেম্বরের পর কি ভয়ার্ত নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এ জাতির জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল তা সবারই জানা।……এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে,খালেদ মোশাররফের পেছনে ভারতীয়দের হাত রয়েছে। বলেছি বলছি বলবো বইতে যেমন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তাকে মুক্ত করার পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে লিখেছেন, তারা (সৈনিকরা) তখন মহাউল্লাশে বলতে থাকল,স্যার বাড়ি যাবেন পরে,আগে রেডিওতে চলেন। গভর্ণমেন্ট গঠন করবেন। মোশতাক সাহেব আবার প্রেসিডেন্ট হবেন। আপনারা বড় মন্ত্রী হবেন। তারপর বাড়ি যাবেন। আপনারা জেলে ছিলেন। জানেন না বাইরে সিপাহী আর জনতা এক হয়ে বিপ্লব করেছি। ভারতের দালালদের খতম করে দেওয়া হয়েছে। তারা মোশতাক সাহেব ও জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতাচ্যূত করে বন্দী করেছিল। আমরা তাদের মুক্ত করে এনেছি। মোশতাক সাহেব রেডিও অফিসে রয়েছেন। এখুনি নতুন সরকারের ঘোষণা দেওয়া হবে।
জাসদ চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন। কেননা ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ তারা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ ও সর্বহারা শ্রেনী কর্তৃক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেও আদর্শিক-তাত্ত্বিক অস্বচ্ছতা ছিল স্পষ্ট। জাসদের আত্মসমালোচনামূলক দলিলে যেমনটি শাজাহান সিরাজ উল্লেখ করেছেন, বস্তুত ১৭ মার্চ ১৯৭৪-এ আমরা কী করতে চেয়েছিলাম? তখনকার সাহিত্যগুলো খুঁজে দেখলে মূলত একটি জবাব বেরিয়ে আসবে। চেয়েছিলাম গণ-আন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে। শাহাজাহান সিরাজ ১৯৮০ সালে একটি রাজনৈতিক রিপোর্টে এও উল্লেখ করেছিলেন, ১৭ মার্চের ঘটনার পর জনগণ ও আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয় যোগসূত্রহীনতা। বস্তুত ১৭ মার্চের পর আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। .......... বস্তুত ৭ নভেম্বর আমরা কী করতে চেয়েছিলাম তা জনগন জানতো না। সত্য বলতে কী অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমাদেরও তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাইতো পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ না-কি করে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে একটা সরকার গঠন করা যায়, সেটাই জনাব খানের (সিরাজুল আলম খান)আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়ে। তাঁর মনোযোগ নিয়োজিত হয় একটা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি [জাসদের রাজনীতি, নজরুল ইসলাম]। জাসদ নেতা মাহবুবুর রব সাদী বলেছেন ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী দ্বারা আমরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তির অর্ন্তদেশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমরা অবশ্যই বিপ্লবী কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারতাম। কিন্তু ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে অবশ্যই বিপ্লবী কৃতিত্ব তো দূরের কথা, বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে আমাদেরকে নৈরাশ্যবাদী অপকীর্তির জন্য দায়ী থাকতে হবে।[
আসলে ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের যে ক্ষতিটি হয়ে গিয়েছিল তা শাহ মোয়াজ্জেমের ভাষায়ই বললেই বেশী ফুঁটে উঠবে- ......... নাজিমউদ্দিন রোডের বাড়িগুলোর দোতলা থেকে,ছাদ থেকে আমাদের ট্রাক লক্ষ্য করে ফুল ছুঁড়ছে,মালা ছুঁড়ে মারছে। হাততালি দিচ্ছে। চারদিকে সিপাহী-জনতা জিন্দাবাদ,বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ‘নারায়ে তকবির-আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি আবার ফিরে এসেছে। জয় বাংলা ধ্বনি তিরোহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×