বরকত সাহেবের দশাসই স্বাস্থ্য আর ভরাট গলা শুনে তাকে খুব কঠিন ধরনের মানুষ মনে করলে আদতে নিপাট বিনয়ী মানুষটার প্রতি সেটা একেবারে অন্যায্য হয়ে যায়। কিন্তু তাও প্রথম দেখায় প্রায় সবাই তাকে সেই কঠিন মানুষই মনে করে, এমনকি তার সহকর্মিরাও তাই ভেবেছিলো। এখন সবাই জানে এই দায়ভারযুক্ত মানুষটা কতটা নিরীহ। তার পরিবার, সংসার সম্বন্ধে কেউই প্রায় তেমন কিছুই জানে না, ইদানিং আগ্রহও নেই। এমন নির্বিষ, গোবেচারার জীবন সম্বন্ধে আসলে কারোরই তেমন উৎসাহ থাকার কথা না।
আপাতঃ উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন, অফিসের কাজে মনোযোগী মানুষটাকে তার সুপারভাইজার আমির আলি প্রথমে গোঁয়ার মনে করে একটু সমীহ করার কথা ভাবলেও অল্পতে তুষ্ট মানুষটাকে এখন বেতনের বেশী মাঝে মাঝে একটু পিঠ চাপড়ে দেয়াকেই অনেক বেশী দিচ্ছেন বলেই মনে করেন। সে জন্য প্রায়ই আরেকটু বেশী কাজও আজকাল বরকত সাহেবকে দিতে তার ভালোই লাগে, আর বরকত সাহেবকেও সেগুলো বিনয়ের সাথেই করতে দেখা যায়। ভদ্রতা করে সামনে হয়তো ঠোঁটের কোনায় একটু টিট্কারীর হাসি দিয়ে ছেঁড়ে দিলেও আড়ালে বরকত সাহেবকে নিয়ে মস্করা করতে একটুও ছাড়েন না আমির সাহেব।
সেইদিন কি হলো, অফিস শেষে বরকত সাহেব যথারীতি সব আলমারী তালা মেরে চেক করেই বরাবরের মতো সবার পরে বেড়িয়ে পরলেন। এই আলমারীগুলোর মধ্যে অফিসের ষ্টেশনারী আইটেম, মানে কলম, কাগজ, প্রিন্টারের কালি ইত্যাদি সব থাকে। ইস্যু হয় মুলতঃ আমির সাহেবের দ্বারাই, হিসাবও তার কাছেই থাকে। বরকত সাহেব অবশ্য এগুলোর হিসাবপত্রে বিনয়ের সাথেই স্বাক্ষর করেন। সুপারভাইজরের নিজের করা এসব কাগজে সন্দেহের অবকাশ করার সাহস নাই বরকত সাহেবের। আলমারীর আরেকটা সেট চাবি অবশ্য আমির সাহের কাছেও আছে।
তো সেইদিন যেটা হলো। বরকত সাহেব বাহিরে বেড়িয়ে দেখেন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এরকম কোন বিপদে যদি বাসা ফিরতে সমস্যা হয় সেটা ভেবে ভাঁজ করা একটা ছাতা তিনি অফিসেই ড্রয়ারে রাখেন। এখান থেকে আজিমপুর কম দূর না। আর বাসায় ফিরতে দেরি করলে মা-ছাড়া কন্যাদুটো কিরকম টুলটুল করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেটাই তার চোখে ভাসে। বড়টা অবশ্য একটু আধটু সংসারধর্ম শিখছে, কিন্তু ছোটটা একেবারেই কাদা। সংসারধর্ম শিখে বাবার মা, ছোট বোনের মা হতে গিয়েও সন্ধ্যার পরে বাচ্চাটা আর পারে না, চোখ শুকিয়ে আসতে থাকে, ঘুমের মাঝে এখনও চমকে উঠে বাবার বুকের কাছে জামা খামচে ধরে।
তাড়াহুড়ো করে ছাতা নিতে তিনি অফিসে আবার ফিরে আসেন। অফিসে নিজেদের কক্ষের তালা খুলতে গিয়ে খোলা তালা দেখে তিনি একটু অবাক হন। ভিতরে আলো জ্বলছে। অথচ তার পরিস্কার মনে আছে তিনি নিজ হাতে আলো নিভিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে গিয়েছিলেন। একটু অবাকভাবেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আরো অবাক হয়ে যান। ষ্টেশনারীর একটা আলমারী খোলা, কতগুলো ভি-৫, ৭ কলমের প্যাকেট আর প্রিন্টারের একটা টোনার বের করে টেবিলের উপর রাখা, আমির সাহেব দ্রুত তখন আরেকটি টোনার তার ব্যাগে ভরছেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমির সাহেব হঠাৎ তাকে দেখে একটু চমকে উঠেন। তারপর দ্রুত সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠেন, "এখানে কি মিয়া? অফিসের পরে এখানে কি করেন? আপনি না চইল্যা গেছিলেন? আবার ফেরত আসছেন কি উদ্দেশ্যে?"
থতমত খেয়ে যান বরকত সাহেব। আমির সাহেব তার আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখন এখানে অফিসের পরে কি করছেন, এই কথাটা তার মাথায় আসে না। বরং খিঁচুনি শুনে তার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অস্ফুটে দুঃখিত জাতীয় একটা শব্দমতন করে তাড়াহুড়ো করে নিজের ড্রয়ারের তালা খুলতে গিয়ে ভুল করতে থাকেন। এরপরে কি করবেন তিনি না বুঝে একটু বোকার মতো জানতে চান স্যার চলে গেলে তাকে আবার তালা মারতে হবে কিনা। ততক্ষণে সব ব্যাগে ভরে কাঁধে ব্যাগ নিতে নিতে আমির সাহেব আবার খেঁকিয়ে উঠেন তার কথা শুনে। আলো নিভিয়ে তালা মারতে বলে তিনি কিছুটা দ্রুতই অফিস ছেড়ে যেতে থাকেন।
ব্যাপারটা কি হলো বুঝতে বুঝতেই বরকত সাহেব আবার আলো নিভিয়ে দিয়ে তালা মেরে বের হয়ে পরেন। পথে দারোয়ান দাঁত গুলো বের করে বরকত সাহেবকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে যাওয়ার পরে আবার অফিসে আসা নিয়ে একটা বেশ রসাত্নক একটা মন্তব্যও করে বসে হয়তো।
পরদিন অফিসে এসে পরিবেশটা কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগে বরকত সাহেবের। কারো সাথে কথা না বলে নিজ চেয়ারে যথারীতি বসে পরেন তিনি। কালকের ব্যাপারটা মাথা থেকে যায়নি এখনো তার। নিজ সুপারভাইজরের চুরি হাতেনাতে দেখে ফেলে আসলে তার কি করা উচিত তাই ভাবছিলেন। এই কোম্পানীটাকে খুব ভালো না বাসলেও চাকুরীটাকে খুব ভালোবাসেন তিনি। চাকুরীটা খুব দরকার তার। অনেক ঘাট ঘুরে অবশেষে এখানে এই চাকুরীটা তিনি বছরখানেক আগে পান। তারপর থেকে নিজের মত খুব পরিশ্রম আর সততা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। টেবিলের সামনে ছায়া দেখে চিন্তিতভাবেই চোখ তুলে তাকান তিনি। পিয়ন দাঁড়িয়ে, "স্যার রুমে ডাকছে।" -বলেই চলে যায় সে।
এখন কি করবেন বরকত সাহেব। স্যারের সামনে চোখ তুলে তাকাতেও পারবেন কিনা...। কাল সন্ধ্যার ব্যাপারটা মাথায় চেপে বসে আছে।
চিন্তিতমুখে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেন বরকত সাহেব। ফ্লোর ম্যানেজার স্যারও দেখি রুমে। তাকে দেকেই খ্যাঁ খ্যাঁ করে উঠেন আমির সাহেব। "এই যে দেখেন..., আসছে।" কেন আসছেন তিনি ভুলে যেতে থাকেন বরকত সাহেব। "কইছিলাম না অফিসে যখন কেউ থাকে না, তখনো সে অফিসে বইস্যা থাকে। সবগুলা আলমারীর চাবী কিন্তু তার কাছে...। ক্যামনে কারে বিশ্বাস করবেন স্যার।" -ফ্লোর ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন আমির সাহেব। কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন বরকত সাহেব। তখনও বলে যাচ্ছেন আমির সাহেব, "কাম কি বাপ তোর অফিসের পরে থাকার? তুই চইল্যা যাচ্ছিস যা। আবার ফেরত আসিস ক্যান? সবাই তো জানে তুই গেছস্ গা, কিন্তু তারপরে আবার অফিসে আইস্যা কি আকাম করছ্ মাইনষে ক্যামনে বুঝবো?" ঘটনার প্যাঁচে হকচকিয়ে যাচ্ছেন বরকত সাহেব। কে অফিসের পরে এসে কি আকাম করেছে, কি হচ্ছে বুঝতে তার সময় লাগছে। কিছু একটা বলতে মুখ খুলতে চায় বরকত সাহেব। ফ্লোর ম্যানেজার হাত তুলে দুজনকেই থামিয়ে দেন। গম্ভীর গলায় বরকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, "কাল অফিসের পরে চলে গিয়ে আবার ফেরত এসেছিলেন? ...কেন?" কথা বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে আমির সাহেবের কথায় থেমে যান আবার। "আমি কিন্তু স্যার সরাসরি কিছু বলতেছি না। ...তবে আমার কিন্তু আগে থেকেই একটু সন্দেহ হইতো" -তার দিকে তাকিয়ে বাঁকাভাবেই বলে উঠেন আমির সাহেব। কথা বলার সময় তার ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের ক্রুর হাসিটা দেখেন বরকত সাহেব, তারপর তার চোখের দিকে তাকাতে এবার আর ভাষা পড়তে ভুল হয় না তার। সেখানে তর্জনী উঠিয়ে রেখেছেন আমির সাহেব, পরিস্কার হুমকিটা পড়তে আর একটুও দেরী হয় না বরকত সাহেবের। মাথা এতক্ষনে পরিস্কার হয় তার। পকেটে হাত দিয়ে ফ্লোর ম্যানেজার বলেন "যাক, ব্যাপারটা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলেন। প্রথমবার জন্য আর কিছু বলছি না। আপনারা দেখেন। আপোষ করে নিন।" "আমার কাছে মাফ চাইতে হবে স্যার। ব্যাপারটা আমি ভালোভাবে নিতে পারি নাই" খিঁচিয়ে উঠেন আমির সাহেব।
কি থেকে কি হচ্ছে, কেন কিভাবে কি হলো কিছু বুঝতে পারছেন না বরকত সাহেব। মাথা আবার ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে আর নতুন করে যুদ্ধ করার শক্তি নাই তার। "কি হলো? মাফ চান।" ফ্লোর ম্যানেজারের ধমকে আতংকিত হয়ে আবার ভাবতে থাকেন বরকত সাহেব, ...চাকুরীটা খুব দরকার তার, ...আর নতুন করে যুদ্ধ করার শক্তি নেই। আমির সাহেবের দিকে তাকিয়ে কি করবেন তিনি বুঝতে পারছিলেন না, আপোষ দরকার, ...হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে তার পা চেপে ধরেন বরকত সাহেব। আমির সাহেবও একটু হকচকিয়ে গিয়ে সামলে নেন, এতটা আশা করেন নাই তিনি। তবু যাক ভালোই হলো। ঠোঁটে একটা আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটতে গিয়েই গিলে ফেলে বলে উঠেন তিনি "থাক স্যার, আমার আর কোন অভিযোগ নাই। আমি ওনার দ্বায়িত্বে আছি তো, টেক কেয়ার করতে পারবো। এরপর কিছু হইলে..." কথার মাঝে হুমকির রেশটা শেষ না করেই বরকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন "থাউক থাউক, উঠো...। এরপর যেভাবে বলি সেইভাবেই চলবা, বুঝছো?"
বুঝেন বরকত সাহেব। বুঝেই উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন। দশাসই, তার থেকে লম্বা মানুষটাকে এভাবে তার সামনে মাথা নিচু করে করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আত্মপ্রসাদের অনুভুতিটা খুব চাপা দিতে পারেন না আমির সাহেব, "যাও মিয়া, কাজ করো। পরে আমার সাথে কথা বইলো।"
চুরি ধরে ফেলে চোর সেজে মাথা নীচু করে বেড়িয়ে এসে আস্তে করে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে নিজ টেবিলের দিকে ফিরে আসেন বরকত সাহেব। পিঠের উপরে আজমল সাহেবের হাতটা অনুভব করে করে তাকান তার দিকে। "সবকিছু দেখতে হয় না ভাইসাহেব। চাকরী করতেছেন, যে বেতন পাইতেছেন -তার বেশী দেখতে যান কেন? যুগ পাল্টেছে, নিয়ম পাল্টেছে, ...তাল মিলায় যান। চুপ থাকেন। ঠিকাছে...?" কিছুটা উপদেশ আর স্নেহের সাথেই বলেন এই কোম্পানীতে অনেকদিন চাকুরী করা প্রায়-বৃদ্ধ মানুষটি। মাথা নাড়েন বরকত সাহেব, ঠিকাছে... জ্বী, সব ঠিক আছে।
আমির সাহেব ভালোই বুঝান বরকত সাহেবকে। বরকত সাহেবও ভালোই বুঝে নেন। বুঝে নেন, নাকি মেনে নেন -তা কে জানে। তবে আমির সাহেবের এখন একটু সুবিধাই হয়েছে। মাঝে মাঝে তিনি বরকত সাহেবকে ডেকে ঠোঁটের কোনা দিয়ে হেসে তার জানা কোন কাজের অজুহাত দিয়ে বলেন, "আজ কিন্তু আমাকে একটু বেশী সময় অফিসে থাকতে হবে। আপনি চলে যেতে পারেন।" ঐ দিন গুলো বরকত সাহেব না বোঝার ভান করে তাড়াহুড়ো করে বরং একটু আগেই অফিস থেকে বেড়িয়ে যান। বের হওয়ার সময় ঐ দিন গুলোয় দারোয়ানের কেলানো হাসি মাখা উপদেশও শুনতে হয় মাঝে মাঝে "সেই তো বুঝলেন স্যার। ...কিন্তু একটু দেরীতে। হুদাই এত কাম দেখায়া লাভ কি!"
বুঝেছেন বরকত সাহেব। এখনো মাঝে মাঝে বাহিরে এসে ছাতাটার দরকার মনে পড়ে। কিন্তু ভিজে ভিজেই মাথা নীচু হাঁটতে থাকেন। আর ফিরে যান না অফিসে। ত্রস্তে হাটতে হাটতে অন্যমনস্ক হয়ে বিড়বিড় করেন, তার এই চাকুরীটা খুব দরকার, ... খুব দরকার, ...নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার আর শক্তি নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪১