somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েটি- কাফি কামাল (মৌলিক গল্প)- দ্বিতীয় অংশ

০৮ ই মে, ২০১৩ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুরের আগেই চম্পাকলিতে নিজ দলের নেতা মজুমদারের দুঃসংবাদটি সুসংবাদ হিসেবে আসে সিকদারের কাছে। কবির মজুমদারকে বদলি করা হয়েছে ময়মনসিংহ। একই সঙ্গে সিকদারের জন্য বরাদ্দ হয়েছে তার সাত নম্বর কক্ষটিই। নিজের জন্য একটি আলাদা কক্ষ পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেও সহযোদ্ধার বদলিতে সে আনন্দে কিছুটা হলেও মাটি হলো। দুপুরে কবির মজুমদার যখন চেহারা অন্ধকার করে নিজের কাপড় চোপড় ব্যাগে ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে সান্ত্বনা জানিয়েছেন সবাই মিলে। কিছুক্ষণের মধ্যে খান সাহেব ও সিকদারের সহায়তাকারী দুই ‘ফালতু’ এসে হাজির। খান সাহেবকে পায়ে ধরে সালাম করল তার ফালতু হালিম। ছিল ফার্মগেটের পান দোকানি। মাদকদ্রব্য মামলায় পাঁচ বছরের জেল খাটছে। ফালতু পেয়েই সিকদার জোর গলায় নির্দেশ দিল। যাও কক্ষটি একটু পরিষ্কার করে দাও। দেখো, কোন প্রয়োজন হলে বলবা। কিন্তু আমার কাজে কোন ফাঁকিবাজি চলবে না। ঠিকমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করলে খবর আছে কিন্তু, বুঝলে। ফালতু ছেলেটি মাথা ঝাঁকিয়ে কাজে লেগে গেল।
সমাজের উঁচুস্তরের বলেই তারা ভিআইপি বন্দি। ব্যক্তিজীবনে ছোটখাটো কাজ করতে অভ্যস্ত নন। তাদের কারো কারো বাড়িতে কাজের লোকই আছে অন্তত ডজনখানেক। কেউ পাহারা দেয়, কেউ পরিচ্ছন্ন রাখে, কেউ বাগান করে, কেউ কাপড় কাচে আর কেউ রান্না করে। অফিস ও ব্যবসায়িক কাজের জন্য তো আলাদা লোক আছেই। লোকে বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বড় লোকরা কারাগারে গেলেও ঠাটবাট রেখে চলে। সে জন্যই ক্ষমতায় থাকতেই রাজনীতিক ও সরকারের বড় পদের লোকজন নিজেদের সুবিধা করে নিয়েছে ডিভিশনের নামে। যারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ডিভিশনের আওতায় পড়েন না তারাও সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদায় আদায় করেন বিশেষ ব্যবস্থা। নিদেনপক্ষে হাসপাতাল তো আছেই। আর সাধারণ বন্দিরা থাকে ওয়ার্ডে। এককক্ষে চল্লিশ-পঞ্চাশজন। রাতে ঘুমোতে হয় ইলিশ ফাইলে। এক হাতের কম জায়গায় এক কাত হয়ে। গোসলের পানি মেলে না। দরজাবিহীন বাথরুমের গন্ধ ও সিগারেটের ধোঁয়ায় ফুসফুসে ভরে। পোকা খাওয়া তরকারি ও পাথর মেশানো ভাত, তাও ঠিকমতো মেলে না। আর ভিআইপি বন্দিরা ভাল খান, ভালভাবে ঘুমান, টেলিভিশন দেখেন আর তাদের আরাম-আয়েশে নিয়োজিত ফালতুদের কাজের নির্দেশ দেন। একটু এদিক-ওদিক হলেই বকাঝকা করেন। ফালতুরাই তাদের ঘর-মেঝে-বাথরুম পরিষ্কার করে দেয়। কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেয়। ব্যক্তিগত ফরমায়েশ মতো কাজ করে।
চম্পাকলিতে বাসিন্দাদের সবাই গোসল শেষে নামাজ পড়েই দুপুরের আহার সারেন। একসঙ্গে বারান্দায় স্থাপিত ডাইনিং টেবিলে। দুপুরে খেতে খেতে প্রতিপক্ষ দলের নেতা বদরুল চৌধুরী খান সাহেবকে উদ্দেশে বলে বলল, খান ভাই চম্পাকলি অনেক ভাল। কেন যে ভিআইপিরা হাসপাতালে যেতে চায়। হাসপাতালের বদ্ধ পরিবেশ, একই বেডে দিনরাত শুয়ে-বসে কাটানো অসহ্য। যে ক’দিন হাসপাতালে ছিলাম দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চম্পাকলিতে মনে হলো যেন নিজের ঘরেই ফিরে এসেছি। একটি কক্ষে নিজের মতো করে সাজিয়ে বসবাস করছি, তাই নিজের বাড়িই তো বটে। খান সাহেব শুনলেন, কোন মন্তব্য করলেন না।
চা খেতে খেতেই হঠাৎ চোখ পড়ল খান সাহেবের। কারাগারের বহিঃপ্রাচীরের বাইরে রাস্তার উল্টো পাশের একটি ভবনের চার তলার বারান্দায়। বছর দশেকের ছোট্ট একটি মেয়ে। মেয়েটি বারান্দার গ্রিল পরিষ্কার করছে। খুবই যত্ন করে। দেখে মনে হচ্ছে, ধুলোবালি মুছতে গিয়ে যেন আবার গ্রিলের না রঙ চটে যায়। চম্পাকলির বারান্দা থেকে যতটুকু দেখা যায়, তার গায়ের রঙ ফর্সাই মনে হয়। গ্রিল পরিষ্কারে ব্যস্ত ছোট ছোট হাত দুটোও দেখা যায় বেশ ফর্সা। অবিকল সুনয়নার মতো। খান সাহেব একমনে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের পলক পড়ে না। তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সুনয়নার মুখচ্ছবি। তার ঘরের কাজ করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সকালবেলার গরম কফি ও বাবার ঘর গুছিয়ে রাখার কাজটি সে করে মনোযোগ দিয়ে। তাই হৃদয়জুড়ে তিন ছেলের চেয়ে একমাত্র মেয়ে সুনয়নার অস্তিত্বই প্রবল। সর্বশেষ আমেরিকা সফরে তিনি স্ত্রী-কন্যা ও ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। সবাই যখন নিজের পছন্দের শপিং নিয়ে ব্যস্ত তখন সুনয়না বাবার পছন্দের জিনিসগুলোই সংগ্রহ করে নিয়েছে। খান সাহেব তো আমেরিকা গিয়েও ব্যস্ত ছিলেন দলের প্রবাস শাখার লোকজন নিয়ে। সংবর্ধনা, কমিটি পুনর্র্গঠন, বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময়, নানা অনুষ্ঠানে গলাবাজি করতে করতেই সময় কেটে গেছে। পরিবারের সঙ্গে দুদণ্ড ঘুরে বেড়ানোর ফুরসৎ মেলেনি। কিন্তু দেশে ফিরে দেখলেন তার পছন্দের স্যুট, পছন্দের ব্রান্ডের আইপড, ঘড়ি, কলম সবকিছু সাজানো তার ঘরে। তাই বারবার সুনয়নার কথা মনে পড়ছে। দেশে যেভাবে স্বামীর অপরাধে স্ত্রী ও বাবার অপরাধে সন্তানদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, না জানি সুনয়নার কপালে কি আছে।
গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল খান সাহেবের। আশপাশের কক্ষ থেকে কান্নার শব্দ আসছে। তিনি কান পাতলেন। কান্নায় কণ্ঠস্বর ভাঙলেও তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন কাঁদছেন দবির ভূঁইয়া। আল্লাহর কাছে মদত চেয়ে কাঁদছেন। বেচারা সত্যিই ভেঙে পড়েছে। প্রায় খাবার টেবিলে বা বারান্দায় মনমরা হয়ে থাকেন। কথাবার্তা বলেন কম। মাঝে মধ্যে কক্ষ থেকেই বের হন না। ভেঙে পড়ারই কথা। সরকারে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সরল টাইপের মানুষ। তার দপ্তর নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিনি পত্রিকার বিরুদ্ধে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। পরে ওই পত্রিকায় দুর্নীতির যোগসাজশে তার সঙ্গে স্ত্রী-কন্যার নামও জুড়ে সত্য-মিথ্যার মিশেলে ধারাবাহিক প্রতিবেদন চেপেছিল। সে মামলা এখনও প্রেস কাউন্সিলে। রহস্যময় সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্বিতীয় দিনই গ্রেপ্তার হন দবির। সপ্তাহ না ঘুরতেই আটক করা হয় তার কন্যাকে। মেয়েটি এখন কারাগারে। স্ত্রী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই তার নিজের জন্য যত না দুঃখ তার চেয়ে বেশি মেয়ের জন্য। কারাগারে বসে যেদিন টেলিভিশনে মেয়ের গ্রেপ্তারের ছবি দেখেছিলেন সেদিন সারাক্ষণই কান্নাকাটি করেছেন। দু’দিন পানি ছাড়া তেমন কিছুই খাননি। পরে সহবন্দিদের সান্ত্বনা ও সাহসে কিছুটা সামলে উঠেছেন। চম্পাকলিতে আসার পর থেকেই খান সাহেবকে নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখতে হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণেই নিজের কষ্ট লুকিয়ে অন্যদের সান্ত্বনা দিতে হয়। খান সাহেব অনেক পোড় খাওয়া মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ব্যবসায়ীদের কারাবন্দি রেখে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রাখা সম্ভব হবে না। নিজেদের ব্যর্থতার ভারেই ডুববেন বর্তমানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। সেটা কেবল সময়ের ব্যাপার।
সকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ঠিক নয়টায় সবাই মিলে নাস্তা করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে চম্পাকলিতে। নাস্তার পর বারান্দায় বসে চা খাওয়ার সময় বাইরে রাস্তার অপর পাড়ের ভবনটির দিকে দৃষ্টি যেতো। ঘুরেফিরে সেই চারতলার বারান্দায়। অন্য ফ্লোরের বারান্দাগুলোতে মাঝে-মধ্যে কোন গৃহকর্ত্রী বা বাচ্চাদের দেখা যায়। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্তের। চারতলার বারান্দায় প্রতিদিন সকালে সে একই দৃশ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ হয় খান সাহেবের। ঠিক তার চা খাওয়ার সময়ে। মেয়েটি প্রতিদিন একইভাবে গ্রিল পরিষ্কার করে। গ্রিলের নিচের অর্ধেক অংশ মুছতে মুছতে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যায়। তারপর গ্রিলের নিচের দেয়ালে উঠে বা উঁচু হয়ে গ্রিল ধরে উপরের অংশ মুছতে মুছতে অপরপ্রান্তে যায়। বাড়িটি রাস্তার পাশে। প্রতিদিন ধুলোবালি ও ময়লা জমা স্বাভাবিক। কিন্তু ছয়তলা বাড়ির অন্য কোন তলার বারান্দার এরকম রুটিন মেনে গ্রিল পরিষ্কার করতে দেখা যায় না। খান সাহেব ভাবেন, ওই বাড়ির গৃহিণী মনে হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অতি তৎপর। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে গৃহিণী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় এত তৎপর সে কখনো বারান্দায় আসে না। বাড়ির গৃহিণীকে বারান্দায় এসে মেয়েটিকে কাজে তদারক করতে চোখে পড়েনি তার।
সেদিন সকালে চা খেতে খেতে চারতলার বারান্দার দিকে তাকিয়েছিলেন খান সাহেব। মেয়েটির নিপুণ হাতের পরিচ্ছন্নতা কর্ম দেখতে দেখতে মুগ্ধতায় ডুবে যান তিনি। চোখে ভাসছে সকালে গরম কফির মগ হাতে সুনয়নার হাসিমাখা মুখ। আগের দিন তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন পারিবারিক আইনজীবী। তিনিই জানিয়েছেন সুনয়নাকে নিয়ে তার স্ত্রী জান্নাতুন্নেছা চট্টগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বড় ছেলে গোপনে পাড়ি জমিয়েছেন থাইল্যান্ডে। মেজ ছেলে লুকিয়ে পালিয়ে এখনও ব্যবসার দেখভাল করছেন। ছোট ছেলেটি তো এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকে পড়াশোনা আর গানবাজনা নিয়ে। গানবাজনার কারণেই সে কিছুটা নিরাপদ বৈকি। এমন সময় সিকদারের ডাকে খান সাহেবের ঘোর কাটে। খান ভাই কি দেখছেন এমন মনোযোগ দিয়ে? খান সাহেব কোন শব্দ উচ্চারণ না করেই মেয়েটির দিকে ইশারা করে। সিকদার সেদিকে তাকায় বটে, তবে তেমন কিছুই খেয়াল করতে পারে না। ফের প্রশ্ন করে, কই ভাই কি দেখালেন? খান সাহেব ছোট্ট করে বলে, ওই দেখেন চারতলার বারান্দায়। এবার সিকদারের চোখ পড়ে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না বারান্দায় গ্রিল পরিষ্কাররত একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখার কি আছে। তাই একটু দুষ্টুমির হাসিমাখা ঠোঁটে প্রশ্ন করে, ভাই বুঝলাম না। এবার একটু বিরক্ত হয়েই খান সাহেব বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে বুঝি চোখের মাথা খেয়েছেন। দেখতে পাচ্ছেন না মেয়েটি কেমন যত্ন করে গ্রিল পরিষ্কার করছে। প্রতিদিনই তাকে দেখি এ সময় রুটিন মেনে গ্রিল পরিষ্কার করছে। আমি মেয়েটির কাজের প্রতি একাগ্রতা ও আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বুঝলেন। তার চেয়েও বড় কথা, মেয়েটিকে দেখে আমার সুনয়নার কথা মনে পড়ে। সিকদার কিছুটা লজ্জা পেলেন।
প্রতিদিন সকালে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে বা পত্রিকা পাঠ, কোন কোন সংবাদের পর্যালোচনাই পরিণত হয়েছে রুটিনে। গল্পের লতা ছড়িয়ে যায় কারাগার থেকে বঙ্গভবন। নিজেদের হতাশা থেকে পরিবারের দুর্দশা। রাজপথে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কথার ফুলঝুরিতে। গল্প করতে করতে কখনও বিষন্নতা ও হতাশায় নুইয়ে পড়েন চম্পাকলির বাসিন্দারা। কখনও সুদিনের আশায় বুক বাঁধেন। এভাবেই পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবশূন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবর্জিত জীবনে দিন কেটে যায়। চম্পাকলির কয়েকজন মিলে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন পরিবেশ। হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা, রাগ ও অনুরাগ নাড়া দেয় তাদের অস্তিত্বকে। বিশেষ করে খান সাহেব ও সিকদার। দুজনের প্রত্যাহিক গল্পের মোড়ে-বাঁকে থাকে চারতলার বারান্দার ছোট্ট মেয়েটি। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ যখন অন্যদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে তখন এমন একটি ফুটফুটে মেয়ের কষ্টকর জীবন তাদের বেদনার্ত করে। যে বয়সে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে বা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ফুটফুটে ছোট মেয়েটি অন্যের বাড়িতে কাজ করছে। নিশ্চয়ই পেটের দায়ে। বারান্দার গ্রিল পরিষ্কার করেই হয়তো তাকে যেতে হবে বাথরুমে। কাচতে হবে বাড়ির সবার ময়লা কাপড়-চোপড়। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে পরিষ্কার করতে হবে বাসি বাসন-কোসন। মাঝে-মধ্যে বেলা বাড়ার পর বারান্দায় গেলে খান সাহেবদের চোখে পড়ে মেয়েটি গ্রিল ঘেঁষে লাগানো দড়িতে কাপড় শুকোতে দিচ্ছে। বন্দি জীবনে নিজেদের বুকে অনেক ব্যথা। তার সঙ্গে সংযোজন হতো প্রতিটি সকালে সেই মেয়েটির জীবনগাথা। মেয়েটি হয়তো দুটো খেতে পেরে এই রুটিন কাজকে স্বাভাবিক মনে করে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাইরে যতই প্রশংসা ঝরুক, ভেতরের আর্থ-সামাজিক কারণেই এমন অবস্থা তা বুঝতে তাদের কষ্ট হয় না। এটা উন্নত কোনো দেশ হলে তার প্রতি সকালে গ্রিল পরিস্কার নয়, বরং স্কুলে থাকার কথা ছিল। ধৈর্যবান এ মেয়েটির মধ্যেও হয়তো লুকিয়ে আছে অনেক মেধা। যা হোক, বন্দি অবস্থায় বাইরের জীবন সম্পর্কে তারা অজ্ঞাত।
টেলিভিশন অন করলে যত না দেশের পরিস্থিতি বুঝা যায় তার চেয়ে বেশি শোনা যায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কথার ফুলঝুরি। দেখা যায় দুর্নীতির তালিকার কার নাম যোগ হলো, কে গ্রেপ্তার হলো, কে কত সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে তার খতিয়ান। যাদের খতিয়ান প্রকাশ হচ্ছে তাদের অনেকেই তো চম্পাকলি ও কর্ণফুলীর বাসিন্দা। সবাই জানে কি রকম সত্য-মিথ্যার মিশেলে ফুলানো হচ্ছে প্রচারের বেলুন। এমন দুঃসহ জীবনে চম্পাকলির বারান্দা থেকে বিপরীত দিকের বিল্ডিংগুলোতে অবস্থানরত মুক্ত মানুষের ছোটখাটো ঘটনাগুলোই তাদের চোখে পড়ে। তারা দেখে মাঝে মধ্যে কারাগারে হাঁটতে বের হলে ওইসব বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে কেউ কেউ কৌতূহলি দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। কেউ কেউ আবার আঙুল দিয়ে তাদের দেখাচ্ছে। কিন্তু বিপরীত দিকের বিল্ডিংগুলোর কর্মকাণ্ডের মধ্যে সেই ছোট্ট কাজের মেয়েটির প্রতিদিনকার কাজ খান সাহেবদের মনে রেখাপাত করেছে। প্রতিদিনই সকালে বারান্দায় বসে তাদের চারটি বয়সী চোখ খুঁজে ফেরে ছোট্ট মেয়েটিকে। দেখা পেলে মুগ্ধতায় ডুবে।
মেয়েটিকে প্রথম খেয়াল করেছিলেন খান সাহেব। কিন্তু তিনি খেয়াল করলেন তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন সিকদার। সেদিন সিকদারের ফালতু ছেলেটিই নাকি টয়লেট সেরেছে তার কক্ষে। প্রচুর পানি ঢেলে ভালো করে পরিস্কারও করেছে। কিন্তু তা দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন সিকদার। অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করেন ফালতু ছেলেটিকে। সেখানেই শেষ নয়, সহকারী জেল সুপারের কাছে অভিযোগ করে তাকে বিদায় করেছেন। দু’দিনের মাথায় আরেকটি ফালতু বরাদ্দ জুটেছে। এই দু’দিন বড্ড অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন সিকদার। তখনই বারান্দায় বসে আগের ফালতু ও জেল সুপারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে কথাটি বলেন তিনি। খান ভাই, ইশ যদি ওই মেয়েটিকে পেতাম। খান সাহেব কিছু বুঝতে পারেননি। তাই অবাক হয়ে জানতে চান কোন মেয়েটি। সিকদার বলেন, ফালতুগুলো এক একটা বদমাশের হাড্ডি। কিছুই পরিষ্কার করে না ঠিকমতো। ওই যে চারতলার বারান্দার মেয়েটি। তার মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মনোযোগী একটি মেয়ে আমার দরকার। বিষয়টি বুঝতে পেরে শব্দ করেই হাসেন খান সাহেব। দম নিয়ে বলেন, সিকদার সাহেব এটা বাড়ি না, কারাগার। এবারও খানিকটা লজ্জা পান সিকদার।
সিকদার মেয়েটির কথা তুলেছিলেন নিজের শুচিবায়ুগ্রস্ততার কারণে। কিন্তু তারা সমাজের উঁচুতলার মানুষ, বয়সী রাজনীতিক। ভাল হোক আর মন্দ হোক তাদের কথাবার্তায় দেশ ও দেশের জনগণই ঘুরপাক খায়। তারা মেয়েটির কাজের শুধু নয়, সৌন্দর্যেও মুগ্ধ। তাই তার ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের চিন্তাও এ বন্দি জীবনে দুই সাবেক মন্ত্রীর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে। খান সাহেব বলেন, সিকদার সাহেব একটি বিষয় খেয়াল করেছেন। সিকদার জানতে চান, কি বিষয় ভাই? খান সাহেব আলোচনার সূত্রপাত করেন। আমাদের দেশে প্রতিদিনই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয় কিশোরী গৃহকর্মীরা। বিশেষ করে সুন্দর কিশোরী হলে গৃহকর্তা বা তার যুবক সন্তানদের হাতে সম্ভ্রম হারান। পত্রিকায় ফলাও করে সে কাহিনী প্রকাশিত হয়। খুব খারাপ লাগে। দেখেন, চারতলার বারান্দার ওই মেয়েটি এখনও ছোট। একবার ভাবুন তো, যখন সে যৌবনে পদার্পণ করবে তখন তার কী হাল হবে। গরিব মেয়েটির ফর্সা রঙ হয়তো তার জীবনে বয়ে আনতে পারে দুঃস্বপ্ন। বন্দি জীবনে কারাগারে এপার থেকে মেয়েটির জন্য কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে। জানেন, এই মেয়েটিকে দেখে প্রতিটি সকালে আমার মেয়ের মুখ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। এবার সিকদার একটু রেগে যান। রাগের কণ্ঠে বলেন, খান ভাই আমাদের সরকার তো বহু আইন করেছে। কিন্তু তার ইতিবাচক প্রতিফলন নেই কেন বলেন তো! খান সাহেব বয়সী মানুষ। অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন। তিনি একটু সময় নিয়ে বলেন, আমার তো মনে হয় রিপুর তাড়নাও পুরুষের দুর্বল মানসিকতা। কিন্তু এটা ঠিক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় নারীর অধিকার সুরক্ষায় আমরা অনেক সফল। খান সাহেব নিজেদের সরকারের সাফল্যে ভুলতে চান অন্তর্গত বেদনা।
রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। কালবৈশাখীর হঠাৎ বৃষ্টি। বাসিন্দাদের মতো চম্পাকলির শরীরও বয়সী, ঘুণে ধরা। ছাদ ও দেয়ালের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ও জরাজীর্ণ। প্রায় চুনা খসে পড়ে। রাতে বৃষ্টির সময় প্রতিটি কক্ষেই ছাদ থেকে পানি পড়েছে। অনেকের ঘুম ভেঙেছে ছাদ ছুইয়ে ঝরা বৃষ্টির পানিতে। খান সাহেবের কক্ষে কয়েক জায়গায় পানি পড়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত চম্পাকলির চৌকাটি চালু করেছিলেন রহস্য সরকারের প্রথম থাবার শিকার এ ভবনের ভিআইপি কারাবন্দিরা। সে কয়দিন খাবার এসেছিল পাশের এরশাদনগর থেকে। যার পোশাকী নাম কর্ণফুলী। বাসিন্দাদের দাবিতে টিন দিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ চৌকাটি নির্মাণ করে দিলেও ভবন সংস্কার অসম্ভব। তাই ভাগ্যকে মেনে নিয়ে, কারা কর্তৃপক্ষ ও রহস্য সরকারকে গালমন্দ করেই কাটল বাসিন্দাদের রাত। সকালে যথারীতি নাস্তার পর চায়ের কাপ ও পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন খান সাহেব। তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন উল্টোপাশের চারতলার বারান্দায় উঁকি-ঝুঁকি মারছেন একজন পুলিশ। তিনি দূরে বসা সিকদারকে ডাক দিলেন। সিকদার দেখেন দেখেন ওই বাড়ির বারান্দায় দেখি পুলিশ। বন্দি জীবন তাই পুলিশের কথা শুনেই কৌতূহল নিয়ে সেদিকে তাকায় সিকদার। তাই তো!
বয়সী দুই বন্দির উপচেপড়া কৌতূহলে জল ঢেলে দিলেন চম্পাকলির তরুণ বাসিন্দা আহমদ উল্লাহ। উত্তরাধিকার সূত্রে একবার এমপি হয়েছিলেন। একবারেই কেল্লা ফতে। আলোচনার তুঙ্গে থেকেই সোজা বেগমবাজারে। তো আহমদ একটি দৈনিকের পেছনের পৃষ্ঠা দেখিয়ে বললেন, দেখেন আঙ্কেল। আমরা না হয় খারাপ ছিলাম, এখন দেশপ্রেমিকদের সময়ে আইনশৃঙ্খলার কি অবস্থা! খান সাহেব বারান্দা থেকে পত্রিকার দিকে চোখ ফেরালেন। তিন কলামে বড় শিরোনাম- ‘পুরান ঢাকায় গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার কিশোরী গৃহকর্মী’। ক্লিকারে লেখা- ‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালে’। খান সাহেব এ ধরনের সংবাদগুলো কখনও খুব একটা পড়েন না। কিন্তু আজ তিনি এড়াতে পারলেন না। কৌতূহলি মনে চোখ বুলালেন সে সংবাদে। পুরান ঢাকার উর্দু রোডের ঘটনা। তিনি পড়ে দেখলেন রোডের নাম, বাড়ির বর্ণনা, ফ্লোরের বারান্দা ও পুলিশের উঁকিঝুঁকি সবই মিলে যাচ্ছে। সংবাদ ও খান সাহেবের মুখের বেদনাব্যক্ত অভিব্যক্তি দেখে সিকদার বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কি সে মেয়েটি? খান সাহেব নিরুত্তর। সিকদার দেখলেন বয়োবৃদ্ধ মানুষটির দু’গাল বেয়ে নেমে আসছে দুই ফোঁটা অশ্রু।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×