আর্জেন্টিনা তাঁর নিজের সন্তান মহান বিপ্লবী কমরেড আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। কমরেড চে'র জন্মদিন উপলক্ষ্যে অনুরাগীদের উদ্যোগে দশ ফুট উঁচু একটি ব্রৌঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে জন্মস্থান সান্তা ফে অঞ্চলের বন্দর-নগরী রোসারিওতে। কমরেড চে'র ভাস্কর্য স্থাপন উপলক্ষ্যে হাজার-হাজার মানুষ রোসারিওতে সমবেত হয় বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালের ১৪ জুন রোসরিওতে জন্ম নিয়েছিলেন কিউবার বিপ্লবের অন্যতম নায়ক কমরেড চে।
জানা গেছে, ১৩ জুন থেকেই চে'র জন্মদিনের উৎসব শুরু হয়েছে রোসারিওতে। দিনটি উপলক্ষ্যে কমরেড চে'কে নিয়ে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র্রও মুক্তি দেয়া হয়। জন্মদিনের উৎসবে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমরেড চে গুয়েভারার চার সন্তান। হাজির ছিলেন আর্জেন্টিনাতে নিযুক্ত কিউবার রাষ্ট্রদূত আরামিস ফুয়েন্তেস। ১৪ জুন ভাস্কর আন্দ্রেস সেরনেরি নির্মিত পূর্ণ-অবয়ব ভাস্কর্যটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
কমরেড চে গুয়েভারা লাতিন আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন আর্জেন্টেনীয় ছিলেন এবং তাঁর আদর্শের মধ্যে আমরা আজকের সময়ে প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।' কমরেড চে গুয়েভারা বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবীর অন্যতম আইকন।
১৯৭০ বা ১৯৮০ এর দশকের সামরিক একনায়কত্বের দিনগুলোতে, আর্জেন্টিনার মাটিতে চে-চর্চা এক-প্রকার নিষিদ্ধই ছিলো। আর স্থাপত্য প্রতিষ্ঠা করে কমরেড চে'র প্রতি সম্মাননা জানানোর ব্যাপারটি দেশের মানুষের কাছে ছিলো প্রাসঙ্গিক। এ-প্রসঙ্গে একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে আর্জেন্টিনার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও চে বিশেষজ্ঞ মারিও ও'ডনেল বলেছেন, 'একনায়কত্বকের আমলে কারও কাছে চে'র ফটৌ বা বই পাওয়া যাওয়াটা মৃতুদন্ড পাবার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো।' চে গুয়েভারার ব্যক্তিক্রমধর্মীতা উল্লেখ-কালে তিনি বলেন, 'কেনেডী বা মাও'র মতো অনেক ব্যক্তিত্বই আছেন লাইব্রেরী-জুড়ে। আর চে আছেন রাজপথে।' বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে নির্বাচন-ভিত্তিক গণতন্ত্রে উত্তরণের পর থেকে আর্জেন্টিনার নতুন প্রজন্মের কাছে ধীরে-ধীরে নতুন রূপে আবির্ভূত হতে থাকেন চে গুয়েভারা। উল্লেখ্য, সামরিক শাসনামলে চে-কে নিষ্ঠুর-হিংস্র এক ব্যক্তি হিসাবে চিত্রিত করা হতো রাষ্ট্রীয়ভাবে।
আর্জেন্টিনা ছাড়াও বিশ্বের নানা স্থান থেকে চে গুয়েভারার জন্মদিন পালিত হয়েছে। কিউবার রাজধানী হাভানাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হয়েছে চে'র প্রতি। কার্ল মার্কস থিয়েটারে আয়োজিত চে'র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কার্লোস লাগে । ক্যাস্ত্রো ও লেইজ উভয়েই কিউবার বিপ্লবে চে গুয়েভারার অবদানের কথা শ্রদ্ধা-সহ হাজির করেন। বলিভিয়াতে চে'র হত্যাকান্ডস্থল লা হিগুয়ারাতেও লোকজন গভীর শ্রদ্ধার সাথে এই বিপ্লবীর আশিতম জন্মদিন পালন করেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, রোসারিওতে শৈশব কাটানোর পরে পরিবারের সাথে কর্দোভা শহরে চলে গিয়েছিলেন বিপ্লবী জীবনে 'চে' হিসাবে খ্যাত হওয়া আর্নেস্তো গুয়েভারা। ১৯৪৮ সালে বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন তিনি। ১৯৫১ সালে ছাত্রাবস্থাতেই বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদোকে সাথে নিয়ে মটর সাইকেল-যোগে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। ফিরে এসে মেডিক্যাল ডিগ্রী সমাপ্ত করে ১৯৫৩ সালের সাত জুলাইতে আবারও মহাদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন চে। গুয়াতেমালাতে বামপন্থী সরকারের সাথে কিছুদিন কাটান তিনি। এ-সময় আর্নেস্তো গুয়েভারা নামের সাথে 'চে' শব্দটি যুক্ত হয়। সহকর্মীদের সাথে কথাবার্তায় 'ওহে' বা 'বন্ধু' আহবানের সমতূল্য স্প্যানিশ শব্দটি সব-সময় ব্যবহার করার কারণে তার নামের সাথে 'চে' শব্দটি যুক্ত হয়। কিছুদিন পরে জ্যাকৌবো আরবেন্স গুসমানের সরকারের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ চে, ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে মেক্সিকো সিটিতে উপস্থিত হয়ে, আগের বছরে সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া প্রবাসী কিউবান বিপ্লবী দলের সাথে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালের ৮ জানুয়ারীতে বিপ্লবীদের সাথে বিজয়ীর বেশে কিউবার রাজধানী হাভানাতে প্রবেশ করেন চে। ফেব্রুয়ারী মাসে কৃতজ্ঞতার স্মারক-স্বরূপ চে'কে 'জন্মসূত্রে নাগরিক'-এর মর্যাদা দান করে কিউবা। বিপ্লবী সরকারের প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রাখা সত্ত্বেও, ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই কিউবা ত্যাগ করেণ চে। পরে জানা যায় যে, কিউবা ছেড়ে বিপ্লবে সহযোগিতার জন্য আফ্রিকার কঙ্গোতে হাজির হয়েছিলেন চে। সেখান থেকে তিনি বলিভিয়াতে যান বিপ্লব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরাতে সিআইএ এর লোকদের হাতে প্রাণ হারান এ-বিপ্লবী। মারিও তিরান নামের বলিভীয় সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্ট উপরের নির্দেশক্রমে বন্দী চে গুয়েভারার উপরে গুলি চালান। গুলি করার পূর্ব মুহুর্তে সেনারা জানতে চায় চে নিজের অমরত্বের কথা ভাবছেন কি-না। উত্তরে চে বলেন, 'না, আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি।'
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০০৮ সকাল ১১:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





