(আমি আমার ক্যারিয়ারের অর্ধেক সময় গবেষক ও বৈজ্ঞানিক হিসাবে কাজ করে, পরবর্তিতে ইন্ডাস্ট্রি বা কর্পোরেটে যোগদান করি। আমার সেই অভিজ্ঞতা সিরিজ আকারে লিখছি এইখানে। ক্যারিয়ার বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে ইনবক্সে লিখুন)
কিছুদিন আগে শহিদুল আলম কে নিয়ে কি না হৈচৈ হয়ে গেল। সরকারের দৃষ্টিভিঙ্গির বিপরীতে গেলে কি যে পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যেতে হয় তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল এই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম। জেল থেকে ছাড়া পাবার পরে উনি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যেখানে বলেছিলেন, “আসলে জেলখানায় যাবার মাধ্যমে সরকারের প্রকৃত রূপটা তিনি জানতে পেরেছেন”। তিনি একজন একটিভিস্ট এবং অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাকে তিনি তুলে নিয়ে আসেন তার ক্যামেরাতে। সেই ছবিগুলি সত্যিই চিন্তার খোরাক জোগায়। তিনি বাংলাদেশকে জানেন এবং সরকারের বিপরীতে গেলে কি হতে পারে তার সাম্যক জ্ঞান তার অবশ্যই আছে। কিন্তু এসব জানার পরেও যে তিনি এক বিরল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা সমন্ধে বেশ ভালোমতন জানলেন। তিনি বাংলাদেশকে কি চিনতেননা? অবশ্যই চিনতেন। কিন্তু এইবার যে নতুন ভাবে চিনলেন সেটা হল আসল চেনা। এতদিনে চেনার অপূর্ণরূপটা এবার হয়তো পরিপূর্ণ হল। এইবার আমি আগ্রহ করে অপেক্ষা করছি তার ছবি কি ধরনের কথা বলবে? এই অভিজ্ঞতার কি রিফলেক্সন আমরা সেখানে পাব?
আমিও কর্পোরেট সমন্ধে জানতাম। তাদের কর্মপদ্ধতি সমন্ধে মোটামুটি জানতাম। কেননা গবেষনাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন কর্পোরেট ও প্রতিষ্ঠানের সাথে আমাকে যৌথভাবে কাজ করতে হয়েছে। আমেরিকাতে যখন মার্শাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিলাম, তখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করতে হয়েছে খুব কাছ থেকে। সেই কর্মচারীদের দেখেছি তারা কিভাবে কাজ করে। তাদের কর্মপদ্ধতি গুলি খাতায় নোট করে রাখতাম। তার মধ্যে মনে রাখার মতন যে গুণটি আমাকে বেশ ভালো লেগছিল তা হল নোট নেবার দক্ষতা। সেই সময়ে আমি যার সাথে কাজ করতাম, তিনি খুব সুন্দর নোট নিতেন এবং সেই নোট আমাদের সবার সাথে শেয়ার করতেন। মনে করা যাক একদিন একটি মিটিং হল, তারপরেই আমরা সেই মিটিং এ কি নিয়ে আলোচনা করলাম কি কি সমস্যা এখন আমরা মুখোমুখি এবং কি করতে চাই। এইসব পূঙ্খানুরূপ তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। মিটিং এর পরেই তিনি তা ইমেইলে সেই প্রোজেক্টের সাতে সংশ্লিস্ট সবাইকে ইমেইলে পাঠিয়ে দিতেন। এত সুন্দর করে সারমর্ম করার কৌশল টি তার কাছেই শিখেছিলাম। দেখলাম কর্পোরেটের মধ্যে কোন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান টিমের সবার সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে কোন প্রোজেক্টকে গতিশীল রাখে। অর্থাত সে যদি সেই কর্পোরেটের কাজ বাদ দিয়ে অন্য কোথায় যোদ দেয়, কিংবা অসুস্থ হয় পড়ে তারপরেও সেই প্রোজেক্টটি আটকে থাকবেনা। তার নোটগুলির মধ্যে সবই সে সুন্দর করে লিপিব্ধ করে রাখে।
অপরদিকে গবেষনাগারে নিজের অভিজ্ঞতা অনেকটা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা বেশী। কিছু সহকর্মী কিংবা বসকে রিপোর্ট করার কালচার রয়েছে। কিংবা গবেষনাপ্রবন্ধে তার বিস্তারিত শেয়ার করে। কিন্তু তারপরেও কিছু কিছু গোপন know how গবেষকরা করো সাথে শেয়ার করেনা। সেটা অনেক টা তারই লব্ধ জ্ঞান হিসাবে সে রক্ষা করে রাখে। অনেকে একে গুপ্ত জ্ঞান হিসাবেই রক্ষা করে।
একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি তখন মাইক্রোফ্লুইডিক ডিভাইস নিয়ে কাজ করছিলাম। কাচের ভিতরে খুব ছোট ছোট চ্যানেল তৈরী করে সেখানে বিভিন্ন রাসয়নিক বিক্রিয়া করা হয়। খুব ছোট ছোট চেম্বারে অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলা সম্ভব এই প্রক্রিয়াতে। আমি যখন মার্শাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা করছিলাম সেই সময়ে আমি আমার আরেকটি সহকর্মী যিনি সেই প্রোজেক্টের সাথে সংযুক্ত ছিলেন তার কাছে গেলাম কাজটি শিখতে। তিনি আমাকে বিস্তারিত শেখাবার জন্য একজন পিএইচডি এর ছাত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি সবই দেখালেন কিভাবে কাচের মধ্যে চা্নেল তৈরী করতে হয়। এর পরে কাচের দু্টি পাতকে সংযুক্ত করতে হয়। এই সংযুক্ত করার প্রক্রিয়াতে একটি বিশেষ তাপমাত্রায় কাচটিকে হিটারে গরম করা হয়। কিন্তু তিনি অন্যঘরে নিয়ে যেয়ে কাজটি সারলেন, এবং আমার আগোচরে করলেন। সেটি শেখালেন না। আমি আশাহত হয়ে ফিরে এলাম। তার গবেষনাপ্রবন্ধগুলি সব খুচিয়ে খুচিয়ে পড়লাম, কিন্তু কোথাও তিনি সেই তাপমাত্রার কথা লিখেননি। এই গোপন জ্ঞান তিনি কাউকে দেননি। আমি আমার বসকে ব্যাপারটি বললেন। তিনি্ও এব্যাপারে সাহায্য করতে পারলেন না। পরে আশাহত হয়ে নিজেই একটু এদিক সেদিক তাপমাত্রা চেষ্টা করে সমাধান করতে পেরেছিলাম।
অপরদিকে কর্পোরেটে তার বিপরীতধর্মী সংস্কৃতি কাজ করে। এইখানে গুপ্ত জ্ঞান বলে কোন কথা নয়। এইখানে সবাই মিলে কিভাবে একত্রে কাজটি সমাধান করা যায় তার দিকে জোর থাকে বেশী। এইখানে ব্যক্তি এর থেকে প্রতিষ্ঠান বা সেই প্রজেক্টটি গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা যাক একটি ইভেন্টে কোন্ একটি কর্পোরেট এর পক্ষ থেকে একটি টিম যোগদান করে। তখন সেই ইভেন্টে কে কে আসলো, তাদের সাথে পরবর্তিতে সেলস টিমের লোকজন যোগাযোগ করার জন্য সবই সেই লোকজনের তালিকা সেই কর্পোরেটের মধ্যে শেয়ার করে। তবে হ্যা, এইখানে খেয়াল রাখা হয় যে সে প্রতিষ্ঠানের বাহিরে সেই তথ্যটি অন্য কোথাও যেন না যায়।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শাহিদল ইসলাম যেভাবে নতুন করে সরকারকে চেনা শুরু করল, তেমনি ভাবে কর্পোরেটে আসার পরে তা আবার নতুন করে চেনা শুরু করলাম। বাহির থেকে যা জানতাম তা হাতেনাতে নিজের মতন করে জানার সুযোগ হল। জীবনের প্রতিটি বাকে বাকে যেমন ভাবে জীবনকে আমরা নতুন ভাবে চিনি, তেমনিভাবে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে কাজ করার মাধ্যমে আমরা কর্মক্ষেত্রকে নুতন ভাবে চিনে নিই।
(চলবে)
- আগের পর্ব:বৈজ্ঞানিক থেকে কর্পোরেটে - প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৯ সকাল ৮:৩৩