পাকিস্তান নামের যে দেশটি ১৯৭১ সনের আগে ছিল সে দেশে আমরা বৃহত্তম ব-দ্বীপবাসী ছিলাম অনাহুত, অচ্ছুৎ। আমরা ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের ঘেঁটুপুত্র। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের উপর কি ধরনের শোষণ নিপীড়ন যুদ্ধকালীন সময়ে চালিয়েছে তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এ প্রজন্মের অনেকেই যা আমরা জানিনা বা জানার আগ্রহ দেখাইনা তাহল কিসের প্রেক্ষিতে কোন কারনে একটি ৭১ এর জন্ম হয়েছিল। কতদিনের কত নিষ্পেষণ আর বঞ্চনার ফল ছিল ১৯৭১ সে খবর আমাদের অজানা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষগুলো কতটা অসহায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার কাছে, কিভাবে এক একটি যাতনার প্রহর কাটত আমাদের সে খবর কোনোদিন রাখেনি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরাও। তাদেরকে জানতে দেয়া হয়নি প্রকৃত সত্য। সত্য লুকিয়ে মিথ্যে রটানো ছিল সেসময়ের নিত্যদিনের চর্চা। তাই আজও পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে বাঙ্গালিরা বিনা কারনে ইসলাম ধর্মকে ছোট করে পাকিস্তানকে দ্বিধাবিভক্ত করেছে। যে সংগ্রাম আমাদের কাছে মুক্তির সংগ্রাম, বুক ভরে শ্বাস নিতে চাওয়ার জন্যে যে যুদ্ধ তা ওদের কাছে নিছক একটা ‘গণ্ডগোল’ নামে পরিচিত, ইসলাম ধর্ম ও নিজের দেশের সাথে বেঈমানি হিসেবে পরিচিত।
আজকে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র। আমাদের এখন সব আছে। আছে প্রায় অর্ধশত টেলিভিশন চ্যানেল, অসংখ্য অনলাইন ও মূল ধারার পত্রিকা। পিঠের চামড়ায় বড়শি লাগিয়ে চরকিতে চড়িয়ে দেয়া হয় বারো বছরের বালককে, উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন। সেই কীর্তিকলাপ সরাসরি সম্প্রচার করতে মুন্নি সাহা ছুটে যান মাইক হাতে, কোন মন্ত্রীর পেট খারাপ হয়ে বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছেন তার খবর ছাপা হয় পত্রিকার প্রথম পাতায় অথচ পাঁচ বছরের উপজাতি মেয়েকে কোন জানোয়ার ধর্ষণ করে মেরে ফেললে সেই খবরের জায়গা হয়না পত্রিকার এক ইঞ্চি কলামে।
পাহাড়ি এলাকা নিয়ে কথা উঠলেই লোকজন ধুর ধুর শুরু করে, অবজ্ঞায় ভরা বুলি আওড়াতে থাকে ঠিক যেমনটা করতো পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন আমাদেরকে নিয়ে। প্রতিদিন খবরের কাগজে আমরা শত শত খবর পড়ি। হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই এসবের খবরই থাকে তার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে অথচ পাহাড়ি মানুষগুলোর উপর ঘটে যাওয়া এমনই কত শত অন্যায়ের ছিটেফোঁটাও আমাদের সামনে আসে না। কেন? ওরা বুঝি মানুষ না? গেয়ো, জংলি, অশিক্ষিত বলে? যদি একমত হয়ে থাকেন তবে আপনি ঠিক ট্র্যাকে আছেন। বলতে চাইছি পাকিস্তানী রক্ত আপনার শিরায় তার খেল দেখিয়ে চলেছে এখনো। এই পাহাড়ের পাদদেশ থেকে উঠে আসা এমন অনেক মানুষের সাথে আমার নিজের পরিচয় হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাদের যোগ্যতার পাশে আমার আপনার মত অনেকেই নস্যিসম।
ভৌগলিক কারনেই পাহাড়ি অঞ্চল দুর্গম এবং লুকিয়ে থাকার জন্যে আদর্শ জায়গা। আর তাই কালের আবর্তনে আমাদের দেশের দূষিত রক্তের একটা বড় অংশের জমায়েত হয়েছে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন অঞ্চলে। হ্যাঁ, দেশের দাগি পলাতক আসামিদের একটা বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে এই অঞ্চলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির জন্যেও অনেকটা দুষ্কর এই জানোয়ারগুলোকে ওখান থেকে খুঁজে বের করা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে একথা সবারই জানা। পলাতক এই চোর বদমাশ খুনিরা যে ওখানে লুকিয়ে থেকে কোরআন পাঠ করবেনা সেতো সহজেই অনুমেয়। বাস্তবে হচ্ছেও তাই, তারা তাদের সরূপে আবির্ভূত হচ্ছে প্রায়শই। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষিতা হচ্ছে, এসিডদগ্ধ হচ্ছে, জীবন হারাচ্ছে কোন পাহাড়ি মা-বোন! বিচার চাইতে গেলে তাদের ভাগ্য জোটে অবহেলা, গঞ্ছনা ঠিক যেমনটি জুটত একাত্তরের আগে আমাদের ভাগ্যে। ক্ষেত্র বিশেষে তথাকথিত ভদ্রসমাজের মানুষগুলো হয়ে ওঠে আরও বর্বর, আরও পিশাচ। পাহাড়ি নারীদের ব্যবহার করতে চায় গণিমতের মালের মতন।
আমি বলছিনা পাহাড়ের মানুষগুলো সকলে ফেরেশতাতুল্য। তাদের মাঝে হয়তো অনেককে পাওয়া যাবে যারা অনেকটা আগ্রাসী মনোভাবের, অনেক বেশি অসামাজিক আচরণ হয়তো করবে কেউ কেউ কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা এটুকু তাদের ভৌগলিক পরিবেশ, বেড়ে ওঠার ধরন, পর্যাপ্ত শিক্ষা দীক্ষার অভাবের ফসল হিসেবেই আসার কথা। এই কথার দোহাই দিয়ে পাহাড়ি মানুষগুলোকে ইতর বিশেষ বিবেচনা করাটা প্রকৃত অর্থে আমাদের নীচতা এবং দৈন্যই প্রকাশ করে। ঠিক যেমনটা প্রকাশ পেতো আমাদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ব্যবহারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:০৪