শান-িপূর্ণ হরতাল আহ্বান
করা হয়েছিল কিন' বিরোধী রাজনৈতিক কমর্ীদের রাস-ায় বেরুতে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে কেন্দ্রীয় নেতাদের পুলিশ দিয়ে বেদম প্রহার করা হয়েছে। সাংসদদের এভাবে রাস-ায় ফেলে পিটিয়ে লাঠি ভেঙে ফেলার ঘটনাও বাংলাদেশে আর কখনও ঘটেনি। এই হচ্ছে শান-িপূর্ণ আন্দোলনের ফল। তারপর?ঃ তার পরেরটা আমরা দেখেছি। জনগণ আইন হাতে তুলে নিয়েছে।
গত কিছুদিন ধরে বিশেষ করে 28 অক্টোবর সৃষ্ট ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে পত্রপত্রিকার চিঠিপত্র কলামে নানা শ্রেণী-পেশার পাঠক তাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। সব প্রতিক্রিয়ায় একটা বিষয়ে মতৈক্য লক্ষ্য করা গেছে_ তা হল মানুষ হত্যা কিংবা জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কেউই মেনে নিতে পারেনি। আমরাও এ বিষয়ে উলি্লখিত পাঠকদের সহানুভূতির সঙ্গে একমত। কিন' লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, একশ্রেণীর পাঠক এ ঘটনাকে 14 দলীয় জোটের বিপর্যয় হিসেবে দেখতে পেয়েছেন। পিটিয়ে মানুষ হত্যা করার কারণে তাদের এ সরল সমীকরণ। মানুষ হত্যা করা তা পিটিয়েই হোক আর যেভাবেই হোক সমর্থনযোগ্য নয়; কিন' এ ঘটনার জন্য যদি জনগণ 14 দলীয় জোটকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বা প্রত্যাখ্যান করে তবে তার চেয়েও ভয়াবহ দোষে দুষ্ট আমাদের বিগত চারদলীয় জোট সরকার এবং তার চেয়েও মোটা দাগে দায়ী জামায়াতে ইসলামী নামক জোটের শরিক দলটি। কেন_ সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কারণ, গণতন্ত্র বিকাশমান একটা সমাজে যুক্তিই প্রাধান্য পাবে এবং যুক্তিরই জয় হবে এমনটিই আমরা প্রত্যাশা করি।
2001 সালে শুধু আওয়ামী লীগে ভোট দেয়ার কারণে হাজার হাজার সংখ্যালঘুর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে তাদের জোরজবরদস-িমূলক দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের মাঝে এখনও দু'একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ড আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। দেশবাসী অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরির মাথা থেকে ঝুলে পড়া মগজের দৃশ্য এখনও ভুলে যায়নি। শিবির ক্যাডাররা তাকে বাসায় ঢুকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বাঁশখালীতে 11 জন সংখ্যালঘুকে ঘরের মধ্যে আটকিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এগুলো নৃশংসতার কোন পর্যায়ে পড়ে?
জামায়াত-শিবিরের নৃশংসতার কথা পত্রিকার পাতায় এত বেশি এসেছে যে, তার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে তারা রগ কাটা এবং ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আরও নতুন নতুন নির্যাতন কৌশল আবিষ্কার করে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। যা চট্টগ্রাম ও রাজশাহী এলাকার মানুষ সবচেয়ে ভালো জানেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে উৎসুক পাঠকরা দয়া করে জেনে নেবেন কীভাবে তারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কমর্ীদের পিটিয়ে মারা, হাত-পায়ের রগ কাটা, আজীবন পঙ্গু করে দেয়ার কাজটি করেছে। এসব ঘটনার হাজার হাজার রিপোর্ট পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। আমরা বয়সে তরুণ। তবু আমাদের সময়েই আমরা সাক্ষী চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের আট নেতাকে শিবির সন্ত্রাসীরা কীভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে। শিবির ক্যাডার নাছিরের নৃশংসতার ভয়বহতা চট্টগ্রামের মানুষমাত্রই জানেন। সমপ্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক, আওয়ামীপন্থী শিক্ষক অংশের সভাপতি ড. ইউনুসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ গুম করে ড্রেনের ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়। ঘটনার অঙ্গুলি হেলন করা হয় শিবিরের দিকেই। ড. তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তো নির্লজ্জতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাল সরকার, প্রশাসন। এ হত্যাকাণ্ডে সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবির সভাপতি সালেহী সরাসরি যুক্ত এবং তার তত্ত্বাবধানে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পুলিশ তাকে ধরেনি; বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাকে বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষাও দিতে দিয়েছেন। হত্যাকারীর পক্ষে পুরো রাষ্ট্রীয় মদদ! একইভাবে শিবির নেতারা প্রকাশ্যে ড. জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে কেটে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছিল। পাঠক, এই শিবির ড. হুমায়ুন আজাদ, কবি শামসুর রাহমানসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিদেরও একইভাবে হুমকি দিয়েছে। হুমকি দিয়েই তারা থেমে থাকেনি। ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর নৃশংস হামলা হয়েছে। শামসুর রাহমানের বাসায় বোমা হামলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই জামায়াতে ইসলামী। তাদের নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর নেতা। পাকিস-ানের পরাজয় অত্যাসন্ন জেনে এবং নিজেদের পরাজিত দেখে রাগে-ক্ষোভে তারা বাংলার প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করেছিল বলে কথিত আছে। সেসব ঘটনা, সে ইতিহাস কি এত সহজেই ভুলে যাবে বাংলার মানুষ?
উপরোক্ত ঘটনাবলীর আলোকে 28 অক্টোবর এবং তৎপরবতর্ী কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ বিচার করলে বলা যায়, ওটা ছিল ঘৃণিত শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, প্রগতিশীল শক্তি এবং গণতান্ত্রিক শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা সহিংসতা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধু বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে কিছু শিবির কমর্ীকে গণপিটুনির দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি (তাদের দিক থেকে গুলির ঘটনাও ঘটেছে) কিন' সারা বাংলাদেশে যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছে তাকে আমরা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করব? হঁ্যা, সেদিন সারা বাংলাদেশে, প্রতিটি থানায়, পাড়ায়, মহল্লায় বিক্ষুব্ধ জনতা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাকে কি আমরা উলি্লখিত জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ বলব না? কেন সারাদেশের মানুষ এভাবে জেগে উঠবে তার কারণ কি আমরা খুঁজে দেখেছি? কারণ ছিল তাদের অত্যাচার-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমরাও বিনা বিচারে মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে। সে যে মতের বা পথের মানব সন-ানই হোক না কেন। এ ঘটনাকে যদি সেই আঙ্গিকে বিচার করতে হয় তবে একই সরলরেখায় জামায়াত-শিবির কর্তৃক সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড, অপরাধ এবং বিগত পাঁচ বছরে হাজার হাজার রাজনৈতিক কমর্ীর হত্যা, নিপীড়ন, নৃশংসতা এবং তথাকথিত ক্রসফায়ারে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডেরও (সেগুলোও কি বিনা বিচারে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা নয়?) বিচার চাই। আমরাও চাই মানুষের জয় হোক। বিবেকবোধের জয় হোক।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। কিছু মানুষ মনে করে ঘরে বসে থাকলেই বোধহয় সব অর্জন করা সম্ভব। তারা নিজেরা সক্রিয় নাগরিক নন আবার কেউ সক্রিয় হতে চাইলেও তারা তার বিরোধিতা করেন। দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হয় এবং তা সহিংস পথেও গড়ায়। যারা বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে নূ্যনতম খোঁজখবর রাখেন তারা এ সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক সমীকরণটাও বেশ জটিল। এখানে শুধু ভোট প্রদানের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তন করা যায় বলে যারা ভাবছেন তারা ভুল করছেন। এ ধরনের দেশগুলোতে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস নয় বরং প্রশাসনযন্ত্র, সরকারি আমলা, সেনাবাহিনী এ ত্রয়ীর ভূমিকাও অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে জনগণের কর্তব্য শুধু ভোট প্রদানেই সীমাবদ্ধ থাকে না_ ভোট রক্ষাও করতে হয়। সক্রিয় নাগরিকদের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব। আর নিষ্ক্রিয় নাগরিকরা কেবলই সুবিধাভোগী। তাদের ত্যাগ স্বীকারের মাত্রা শূন্য। এ ধরনের নিষ্ক্রিয় নাগরিকের জন্যই পৃথিবীতে যুগে যুগে অত্যাচারী শাসকরা টিকে থাকে। এছাড়া সহিংস আন্দোলন নিয়েও নানা কথা। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কোন ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশেও বিগত পাঁচ বছরে অসংখ্য মানববন্ধন, মানবপ্রাচীর, অনশন কর্মসূচি হয়েছে। ক'টা দাবি আদায় করা গেছে? সংসদে বিরোধী দল বিভিন্ন ইসু্যতে অসংখ্য নোটিশ, মুলতবি প্রস-াব দিয়েছিল; জানা যায়, যার একটি প্রস-াবও গৃহীত হয়নি। শান-িপূর্ণ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল কিন' বিরোধী রাজনৈতিক কমর্ীদের রাস-ায় বেরুতে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে কেন্দ্রীয় নেতাদের পুলিশ দিয়ে বেদম প্রহার করা হয়েছে। সাংসদদের এভাবে রাস-ায় ফেলে পিটিয়ে লাঠি ভেঙে ফেলার ঘটনাও বাংলাদেশে আর কখনও ঘটেনি। এই হচ্ছে শান-িপূর্ণ আন্দোলনের ফল। তারপর?ঃ তার পরেরটা আমরা দেখেছি। জনগণ আইন হাতে তুলে নিয়েছে। কানসাটে বিদু্যতের দাবিতে সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ আন্দোলনে গুলি করে 18 জন নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলা হল (পাঠক কানসাটের সেই অভূতপূর্ব গণজাগরণ সরেজমিন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ এ লেখকদের হয়েছিল)। ফুলবাড়ীতে অস-িত্বের সংগ্রামে লড়াই করা জনগণের ওপরও রাষ্ট্র গুলি চালাল। এভাবে একটা রাষ্ট্রে যখন শান-িপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষাকে স-ব্দ করে দেয়া হয় তখনই মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। হাতে আইন তুলে নেয়। আমরা দেখেছি সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ মানুষ কীভাবে পিটিয়ে ছিনতাইকারীকে মেরে ফেলার পর তাদের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে ফেলল। বিদু্যতের দাবিতে সহিংস জনতা সাংসদকে ধাওয়া করল। বিদু্যৎ অফিস জ্বালিয়ে দিল, পুলিশের গাড়ি এমনকি র্যাবের গাড়িও জ্বালিয়ে দিল। মানুষ যখন বিক্ষুব্ধ হয় তখন সে আইন-কানুন মানে না। কারণ সে মনে করে, এ আইন তাকে নিষ্পেষণ করার জন্য। কোন বন্দুক দিয়ে তাকে আর দাবিয়ে রাখা যায় না। এখানেই জনগণের শক্তি। এটিই ঘটেছিল 28, 29, 30 অক্টোবর এবং পরবতর্ী চারদিনের অবরোধেও। বিক্ষুব্ধ মানুষের রাস-ায় নেমে আসা। এ গণআন্দোলনের ফল ভোগ করবে সমাজের সেই নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীই।
সব ঘটনার পূর্বাপর বিবেচনা করে সবাইকেই এখন দেখতে হবে_ কেন কোনটা ঘটল? দায়ী কে? পরবতর্ী গণআন্দোলন কিংবা নৃশংসতা নাকি মানুষের কণ্ঠ স-ব্দ করে দেয়ার পূর্ববতর্ী প্রচেষ্টা? জনগণের কাছে এবং বিশেষ করে যারা সহসাই অহিংস হয়ে উঠেছেন তাদের কাছে এই জিজ্ঞাসা। সব শেষে আমরাও কিছু সরলীকরণ করতে চাই, দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কিছু ঘটনাকে সাদা চোখে দেখাই যায়, যদিও কোনটি দেশ ও জনগণের স্বার্থ তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। তবে জনগণই সর্বশেষ কথা। যারা সর্বাধিক সক্রিয় জনগণের সমর্থন পাবে, ধরেই নেয়া যায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা বেশি। তারপরও বলছি, অবশ্যই বলছি_ আমরা মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে। মানবতার জয় হোক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



