কিস্তি-৫
জাফর সাহেব যখন বাসায় ফিরলেন তখন রাত ১০টা। এত রাত পর্যন্ত কখনও তিনি বাইরে থাকেন না। ৯টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে প্রতি রাতে এ সময়ে তিনি বিছানায় যান। ১০ মিনিটের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেন। গত ১২ বছরে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। আজই প্রথম। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার আছে জাফর সাহেবের। বেতের তৈরি। অন্য কেউ এই চেয়ারে বসতে পারে না বা বসে না। ছাড়পোকায় কামরায়। তাদের ধারণা বেতের চিপায় চিপায় ছাড়পোকার ফ্যাক্টরি আছে। এ ব্যাপারে জাফর সাহেবকে প্রশ্ন করলে তিনি শুধু হাসেন।
বেশ আয়েশ করে ইজি চেয়ারে বসলেন জাফর সাহেব। গা ছেড়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে আছেন তিনি। কিছু ভাবছেন।
তার প্রথম ভাবনা- আঁকাকে নিয়ে। মেয়েটি বড় অসহায়। অন্ধ মাকে নিয়ে থাকে। চাকরি করে সংসার চালায়। ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া, মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করছে। আবার নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে। কঠিন জীবন। মাথার ওপর ছায়া নেই। তার মনে কষ্ট থাকলেও বোঝার উপায় নেই। ঠোঁটের কোণে সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে।
মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতি। কত সহজে বখাটেদের উৎপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করলো! কি ক্ষুরধার কৌশলে তাকে আপন করে নিল। মেয়েটিকে খুব ভাল লেগেছে জাফর সাহেবের।
কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চাপা গলায় ফুঁপিয়ে কাঁদছে কোন মেয়ে। এমনভাবে কাঁদছে যেন কেউ তার কান্না শুনতে না পায়।
সামি এসে বললো- বাবা, আম্মু ভাত খেতে ডাকছে।
জাফর সাহেব জানতে চাইলেন- কাঁদছে কে সামি?
আপু।
কেন?
আম্মু বকেছে।
কেন, বকেছে কেন?
ফোন নিয়ে।
ও আচ্ছা। নিপুণ ফিরেছে?
হ্যাঁ, বাবা।
আচ্ছা তুই যা।
উঠে দাঁড়ালেন জাফর সাহেব। অহনার রম্নমের সামনে গিয়ে বললেন- ভেতরে আসতে পারি মা?
চোখ মুছে অহনা বললো- এসো বাবা।
জাফর সাহেব ঘরে গেলেন। বাবাকে বসতে বললো অহনা। এ অবস্থায় সকল বাবা-ই মেয়ে কাঁদছে কেন জানতে চাইবে। জাফর সাহেব সে পথে গেলেন না। তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেন- দেখতো মা আমার চোখে কি পড়েছে।
অহনা খুব ভাল করে দেখে বললো- কই, কিছু নাই তো বাবা।
তুই কোন চোখে দেখছস?
কেন, ডান চোখে। তুমি তো ডান চোখই দেখালে।
তাই নাকি। তাহলে বোধহয় বাম চোখে। দেখতো, বাম চোখটা একটু দেখ।
বাম চোখ দেখার জন্য অহনা প্রস্তুতি নিতেই তিনি বললেন- এক কাজ কর মা, তুই চোখে-মুখে একটু ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে আয়। কানতে কানতে চোখ ফুলাইয়া ফালাইছস। এই জন্য চোখে ঝাপসা দেখতাছস।
অহনা বুঝলো বাবার চোখে কিছু পড়েনি। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য বাবা এটি বলছেন। সে বললো- ঠিক আছে, তুমি বসো। আমি মুখ ধুয়ে আসি।
জাফর সাহেব বললেন- আসার পথে তোয়ালে আর একটা শুকনা লুঙ্গি নিয়া আসিস।
জাফর সাহেবের কাপড়-চোপড় ভেজা অহনার সে খেয়াল নেই। সে বললো- তাই তো, তোমার কাপড় ভেজা কেন? কোথায় গেছিলা?
আগে শুকনা কাপড় আন। মেয়েটা এমন করে ধরলো, না করতে পারলাম না। রাজি হয়ে গেলাম।
মেয়ে! রাজি! তুমি এসব কি বলছো বাবা। আমি তো কিছুই বুঝতাছি না।
বুঝবি, সব বুঝবি। আমি তোকে সব বলবো। এমন সুন্দরী মেয়ে। ফুলের মতো নিষ্পাপ। আমি কিন্তু মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়া ফালাইছি।
তোয়ালে আনতে চলে গেল অহনা। দরজার পাশে দাঁড়ানো ছিল সামি। সে সব কথা শুনলো। মাকে গিয়ে বললো- বাবা সুন্দরী একটা মেয়ে দেখে এসেছে। আপুর সঙ্গে কি সব কইতাছে।
ছেলের কথায় তেমন কিছুই বুঝলেন না রাবেয়া খাতুন। তিনি ঘটনা জানার জন্য এ ঘরে এলেন। স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন- কিসের সুন্দরী মেয়ে? কিসের সিদ্ধান্ত?
জাফর সাহেব বললেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত আমার পাক্কা। শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা, একটা লাইন হইয়া গেলেই ওরে আমি বউ কইরা ঘরে আনবো।
কথা শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো রাবেয়া খাতুনের মাথায়। তিনি দৌড়ে অহনার কাছে গেলেন। বললেন- অহনারে সর্বনাশ হইয়া গেছে। তোর বাবার মাথা খারাপ হইয়া গেছে। এই বয়সে সে আবার বিয়া করতে চায়।
এসব তুমি কি বলছো মা? নিশ্চয়ই তুমি ভুল শুনছো।
তোর বাবা-ই তো আমার সামনে কইলো- একটা লাইন হইলেই বউ কইরা ঘরে তুলবো। ও আল্লা! এহন আমার কি হইবো। শেষে কিনা এই বয়সে বিয়া! মান-ইজ্জত গেলরে...। কান্না জুড়ে দিলেন রাবেয়া খাতুন।
চুপ করো তো মা। এই এক স্বভাব তোমার। পুরো ঘটনা না জাইনা, না বুইঝা শুরু করো হৈচৈ।
নিজের কানে শুনলাম! ও আল্লা...
তারপর যথারীতি হুলস্থূল। কপাল চাপড়ে বিলাপ রাবেয়া খাতুনের। মাকে নিবৃত্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা অহনার। চাপা উত্তেজনার পারদ লো-ভোল্টেজের মতো ওঠানামা করছে। ক্ষণে ক্ষণে বিরতি দিয়ে বিজলী চমকে জ্বলে ওঠা।
এতক্ষণে চাপা উত্তেজনা অহনার ভেতরেও- বাবা যদি তেমন কিছু করে থাকে, তবে ভালই করেছে। সে-ও তো মানুষ। রক্ত-মাংসের গড়া। কোনদিন দু’দণ্ড ভাল করে কথা বলেছো কোনদিন?
কি! আমি ভাল করে কথা বলি না?
বুঝ হওয়ার পর থেকে কোনদিন শুনি নি। বুঝবো কেমন করে?
হ, আমি তো খারাপ। ওই রক্ত-ই তো বইছে তোর শরীরে।
গমগম করছে গলা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার একই কথার জাবর কাটা। অহনার বুঝার বাকি নেই- এখন যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। তা নাহলে ভাঙা রেকর্ড বাজতেই থাকবে।
তোয়ালে দিয়ে জাফর সাহেবের মাথা, শরীর ভাল করে মুছে দিলো অহনা। ভেজা শার্ট খুলে শুকনোটা পরিয়ে দিল। বাবাকে বসালো খাটের এক কোণে। বললো- বাবা, তুমি একটু বসো। আমি তোমার খাবার নিয়ে আসি। অলরেডি এক ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে। কাটায় কাটায় দশটার মধ্যে বিছানায় যেতে বলেছে ডাক্তার।
চলে যাচ্ছিল অহনা। হাত ধরে বসালেন জাফর সাহেব। বললেন-
একদিন ব্যতিক্রম করলে কিছু হবে না। তুই একটু বস আমার পাশে। জরুরি কথা আছে।
পিতার পাশে বসলো অহনা। জাফর সাহেব আঁকার ঘটনাটি বিস্তারিত খুলে বললেন মেয়ের কাছে। শেষে এটাও বললেন- নিপুণের একটা চাকরি হলে ছেলের বউ করে আঁকাকে ঘরে আনবেন। সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অহনা বললো- তা কিভাবে সম্ভব বাবা? নিপুণকে ইতালি পাঠাতে...
কথাটি শেষ করলো না অহনা। তার চোখ ছলছল। ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে জাফর সাহেবের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়লো। তিনি বললেন- ওই ইতালিই তো সব খাইলো। যত অশান্তির কারণ তো ওই ইতালি। আমার অসুস্থ হওয়ার কারণ, প্রেসার বাড়ার কারণ, সবই তো ওই ইতালি। ওই ইতালিই তো তোর মুখের হাসি কাইরা নিলো।
জাফর সাহেবের চোখে পানি। তিনি উত্তেজিত। কিছুটা আবেগপ্রবণও।
পিতাকে শান্ত করার জন্য অহনা বললো- বাবা, এটা তোমার ভুল ধারণা। ইতালি আমার মুখের হাসি কাইড়া নিবে কেন বাবা। পড়াশোনা নিয়ে টেনশনে থাকি। তাই...। তাছাড়া মা যা করেছেন- সবার ভাল’র জন্যই করেছেন। তুমি-ই একবার চিন্তা করো বাবা। মাস্টার্স পাস করে ছেলে যদি বেকার থাকে। একটা চাকরির জন্য দিনের পর দিন রাসত্মায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়- তবে কোন মা শানত্ম থাকতে পারেন! নিপুণের সমবয়সীদের বেশ ক’জন চাকরি-বাকরি করছে। বিয়ে করে সংসারও করছে কেউ কেউ। আবার ঠিক উল্টোটাও দেখো- রাজা, শিমুল, রিন্টুরা বখাটেদের সঙ্গে মিশে কেমন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেছে। সেয়ানা ছেলে। মা খুব টেনশনে থাকেন নিপুণকে নিয়ে। সবকিছু দেখে মা ভেবেছেন তবুও যদি ছেলের একটা ব্যবস্থা হয়।
এবার চোখের পানি আটকে রাখতে পারলেন না জাফর সাহেব। তিনি মেয়েকে বুকে টেনে ধরে বললেন- তাই বলে তোকে বিক্রি করে দিয়ে...!
তা কেন বাবা। বিক্রি কেন হবে? এটা তোমার ভুল ধারণা। এখানে না হলেও কোন না কোন ছেলের কাছে তো একদিন আমাকে বিয়ে দিতেই। আমার স্বামী যদি নিপুণের একটা ব্যবস্থা করতে পারে। যদি ইতালি যেতে পারে তবে ওর একটা গতি হয়। তাছাড়া- এই আমি, নিপুণ, সামি আমাদের নিয়ে কি তোমার দুশ্চিনত্মাও কম? মা তো আমার ও নিপুণের ভালটাই চেয়েছেন। ছেলে প্রবাসী- তাতে কি? টাকা-পয়সা আছে। মেয়ে সুখে থাকবে। নিপুণের ভবিষ্যতেরও একটা ব্যবস্থা হবে।
সেলটা বেজে ওঠে অহনার। হাতে নিয়ে একবার নাম্বারটা দেখে টেবিলের ওপর রেখে দেয়। জাফর সাহেব বুঝতে পারেন মেয়ে হয়তো তার সামনে ফোন ধরতে চাইছে না। তিনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান।
অহনা বলে- বসো বাবা, আমি খাবার নিয়ে আসছি। আজ দু’জনে একসঙ্গে খাবো।
জাফর সাহেব মেয়েকে এড়িয়ে যেতে চান। অহনা বুঝতে পেরে বলে- পারভেজ ফোন করেছে বাবা। তুমি বসো অসুবিধা নেই।
তাহলে ধরছিস না কেন?
পরে ধরলেও চলবে।
না, এটা ঠিক নয়। ছেলেটা এত দূর থেকে ফোন করেছে, নিশ্চয়ই জরম্নরি কিছু...।
না, বাবা। ও তো সকাল-দুপুর-রাত- সব সময়ই ফোন করে। ভাল কথা বাবা- তোমাকে একটা খবর জানানো হয়নি।
কিরে মা?
পারভেজ আগামী মাসে ঢাকায় আসছে।
তাই নাকি। খুব ভাল কথা।
সেলটা বেশ ক’বার চিৎকার করে এখন থেমে আছে। একেবারে অলস, নিশ্চুপ।
বুকের ভেতরে একটা পাথরচাপা ছিল অহনার। এখন অনেকটা হালকা লাগছে। কতদিন বাবার সঙ্গে একানেত্ম কথা হয় না; খাওয়া হয় না।
রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় ধোয়া, সংসারের নানা ফিরিসিত্ম। কলুর বলদের মতো নির্দিষ্ট বৃত্তে ঘুরপাক খান মা। কখনও কখনও হাঁপিয়ে ওঠেন। এসব কারণে মেজাজ কিছুটা খিটখিটে থাকে। অন্যদিকে বাবা। তিনি আছেন চাকরি ও সংসার নিয়ে। দু’জনের ব্যস্ততা দু’ রকম।
মাকে খাবার দিতে বলে সামি ও নিপুণকে ডেকে আনে অহনা। তারপর একরকম হুলস্থূল। ঈদের আমেজ। এক সঙ্গে বসে খাবার খায় সকলে। খাওয়ার পর আরও কিছুড়্গণ আড্ডা। নানা গল্প। দাদা-দাদী, নানা-নানীর কথা। মামা বাড়ির কথা। গ্রীষ্মের ছুটিতে সকলের দেশে যাওয়া। সে এক সময় ছিল। এখন অনেক দিন ও রকম হয় না। তা প্রায় বছর দশেক। সামির স্কুল বন্ধ তো নিপুণের কলেজ খোলা। কোনভাবেই কাস মিস করা যায় না অহনার। জীবনটা কেমন যেন যন্ত্রের মতো একঘেয়ে হয়ে গেছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অতি কাছের মানুষগুলো দিনে দিনে বেশ দূরের হয়ে গেছে।
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১