প্রতি গ্রীষ্মের শুরুতে আমাদের উৎসব লেগে যায়। বাড়ীতেই কাঠমিস্ত্রীর কারখানা। গিয়ে নিজেরাই লোহার পাত হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপটা করে শানে ঘষে ঘষে ধারাল চাকু তৈরি করি। প্রায় বিকেলেই আকাশ কালো করে কালবৈশাখী হানা দেয়। আম গাছের নিচে গিয়ে আমরা দশ-বার জন জটলা করি। কে কার চেয়ে বেশী আম কুড়াতে পারে তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়। শাহেদদের কাঁচামিঠা, বড়মিয়া, আমাদের মইষা, বার্লি, এসব গাছের নিচে আমাদের উপভোগ্য প্রিয় বৈশাখ। ঝড় ছাড়া শাহেদ চাকু দিয়ে আম কেটে খায়, আমাকে পেলেই চিকন পাতলা করে আম কেটে দেয়। ওর এই বিষয়গুলো আমি অনেক পছন্দ করি।
আমরা বিকেলে খেলাধুলায় মেতে উঠতাম। আমি ক্রিকেট, শাহেদ ফুটবল। এক্ষেত্রে যে যার পছন্দে অটল্। মাঠের সব ধান কাটা যখন শেষ হয় তখন, ধান গাছের গোড়া থাকে সারাটা মাঠ। সেখানে আমাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ম্যাচগুলো হয়। তবে প্রাকটিসটা বাড়ীর সামনে হাটেখোলাতেই করা হয়। আমি যখন আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল হতে চাই, শাহেদ তখন সালাউদ্দিন বা আরো বড় মাপের কোন ফুটবলার হতে চায়।
একদিনের ঘটনা, কোরবানী ঈদের দুদিন বাদে শাহেদ প্লেট ভর্তি গোশত নিয়ে এসেছে বাইরে আমাদের সুতা রং করা টবের উপর বসে খেতে থাকে। আমি সেখান দিয়ে যবার সময় আমাকে জোর করে ধরে গোশত খাওয়ায়। আমি কিছুটা আপত্তি করি কারণ বাড়ির বাইরে এসে প্লেটে করে খাবার খাওয়াটা অনুমোদিত ছিলনা। যাহোক, গল্পে গল্পে আর হাসাহাসিতে পুরো সময়টা পার করে।
আরেকদিনের ঘটনা, আমি দোকানে বসে আছি, হঠাৎ শাহেদ আসে। বলা নেই কওয়া নেই বিস্কুট খেতে শুরু করে। বলতে থাকে যদি সবটুকু বিস্কুট শেষ করতে পারতাম তবে ভালো লাগত। আমি বলি যদি শেষ করতে পার তবে তোমার টাকা দিতে হবেনা। আর খেতে না পারলে দ্বিগুন মূল্য দিবে সে। বাজি? হ্যাঁ বাজি, ডান। তিন প্যাকেট ওপেল বিস্কুট ছিল্ সেখানে। ছোট ছোট চারকোনাকার কিন্তু পরিমানে একটু বেশিই। আস্তে আস্তে খেতে থাকে এবং এক সময় সব নিঃশ্বেষ। আমি বাজিতে রীতমতো হেরে যাই। সে কথা অবশ্য কাউকে এর আগে বলা হয়নি। শেষে আব্ব্বুর কানে যায়, আর আমার অনেক লজ্জা পেতে হয়। মার খাবার চেয়ে লজ্জা পাবার কষ্টটাই আমার সবচেয়ে বেশী।
আস্তে আস্তে আমি এইটে উঠি শাহেদ উঠে নাইনে। কারণ সে এক বছর না পড়েই সিক্স থেকে এইটে চলে গিয়েছিল। এটা নিয়ে স্কুলের ছেলে-মেয়েরা অনেক হাসা হাসি করত। বলত আরে নবধারা সিক্সেই পারেনি আবার এইটে গেছে। আমার কাছে এটা খুব বেশী মিনিং তৈরি করতনা। কারণ ও যদি পারে তো পড়ুকনা, হাসির কী আছে?
দিনদিন ও বড়দের সাথে মেশা শুরু করে। পড়ালেখাতেও ভাটা পড়তে থাকে। আমি আমার পড়া গোছাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। একদিন হানিফ স্যার বাসায় আসেন। জিজ্ঞেস করেন পড়ালেখার খবরাদি। এক সময় শাহেদের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি উত্তর দেই, নিজেই পড়ালেখা করিনা আবার অন্যের কথা কিভাবে যে বলি! স্যার বলেন, বাহ তুমি দেখি অনেক বুদ্ধিমানের মতো কথা শিখে গেছ। কেন জানি শাহেদের সাথে দিনদিন আমার যোগাযোগ অনেকটা কমে যাচ্ছে। ইদানিং শুনতে পাচ্ছি ও একটা মেয়ের সাথে রিলেশানে জড়াচ্ছে। এটা শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। ছেলেবেলায় ক্যারিয়ার বলতে শুধু বাইসাইকেলের বসার জায়গাটাকেই বুঝতাম। কিন্তু এই টিনবেলায় এসে অন্তত এতটুকু বুঝতে পারি যে ক্যারিয়ার বলে একটা জিনিস সবার জীবনেই থাকে, সেটায় ঠিকঠাক বসার জন্যই নিজ নিজ কক্ষপথে প্রত্যকেরই নিরন্তর এই ছুটে চলা। সময় গড়িয়ে যায় আমি নাইন পেড়িয়ে টেনে উঠে যাই। শাহেদের পড়ালেখার শব্দ শুনতে পাই আমার ঘর থেকে কিন্তু কোন কথা হয়না। একদিন সকালবেলা আমার পরিবারের এক সদস্য বলল যে শাহেদদের বাসার কাজের মেয়েটা আমাদের পেছন বাটির সদ্য গজানো কদু গাছের অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। ব্যাস, আমার চিরাচরিত অভিযান শুরু হয়ে যায়। ওদের বাসায় গিয়ে আমি হইচই করতে থাকি। কেন পাতা ছিঁড়েছে , গাছটা যে মরেই যাবে ইত্যাদি এমন সম্ভাবনার বাণী বর্ষন করতে থাকি । কিন্তু কেউ একজন বলে উঠে, শাহেদ ভাইয়ের মেট্রিক পরীক্ষাতো তাই। চট করে আমার মনে পড়ে যায়, শাহেদের পরিবারের বিধি মেনে চলার বিষয়টি। পরীক্ষার দিন সকালে কদু শাক দিয়ে ভাত খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভালো্ হয়। লজ্জায় জিভ কেটে দ্রুত কেটে পড়ি। শাহেদের জন্য কদু পাতা, ইস কেন আমি বলতে গেলাম! খুব খারাপ লাগে। দু'মাস বাদে ওর রেজাল্ট হয় তাতে দেখা যায় সে কৃতকার্য হয়নি। আবার ওর প্রতি একটা বাজে ধারণা তৈরি হয়। শুনলাম ওর বান্ধবীটাও নাকি অকৃতকার্য হয়েছে। পরের বছর আমার এস এস সি পরীক্ষা শুরু হয়। শাহেদের ভাই ওকে জোর করে আবার পরীক্ষা দেয়াতে চাইলেও সে কিছুতেই রাজী হয়না। যথারীতি আমার পরীক্ষা শেষও হয়। সুন্দর একটা রেজাল্ট আমি হাতে পাই। এতে শাহেদের মনটা কেমন হয়েছিল সেটা জানতে পারিনি। কিন্তু আমার প্রতি ওর একটা সমীহভাব লক্ষ্য করতাম। সেই ছেলেবেলার মতোই নিজেকে ছোটভাবে উপস্থাপন করে প্রকারন্তরে ও আমাকেই ছোট করে ফেলত। একদিন শত অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে গুটিসুটি পায়ে ওর ঘরে গিয়ে হাজির হই। আমি বলি শাহেদ তোমার কাছে দেখেছিলাম, এইচ এস সির ইংলিশ মূল বইটা আমাকে একটু ধার দাওনা। ভেবেছিলাম হয়ত না করে দিবে। কিন্তু আমার সব আশঙ্কা বদলে দিয়ে হাসিমুখে দিয়ে দিল বইটা । বলল বইতো তোমাদের জন্যই। আমরাতো আর বই পড়িনা । ব্যাস শুরু হয়ে গেল বদান্যতার মহড়া। বলল তোমাকে এ বইটা আর ফেরত দিতে হবেনা। খুব খুশী লাগলো বইটা হাতে পেয়ে। বাড়ী এসে পড়ে ফেলতে লাগলাম, একে একে সব গল্প। দ্য এনসেন্ট মেরিনার, গিফট অব দ্য মেজাই, দ্য লানসন, রিডিং ফর প্লেজার ইত্যাদি। খুব মজা পাই। ওর জন্য মায়া হয়।
শারদীয় দূর্গোৎসবে মেতে উঠেছে হিন্দু সম্প্রদায়। গেট করেছে আমাদের বাড়ির সামনেই। হাটখোলাতই মন্দির । বিশাল অশ্বুথ্থ বৃক্ষ। তার সাথে সাপের মতো পেঁচিয়ে উঠে গেছে তেঁতুল গাছ, মাকাল ফলের গাছ। তার নিচে ধুঁপের কড়া গন্ধমাখা ধূঁমায়িত দেবী বন্দনা চলছে তিনদিন তিনরাত ধরে। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণস্থল, প্রতিমা দর্শন এবং প্রসাদ, কুশলাদি, দক্ষিণা বিনিময় চলছে। আজ শেষ দিন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে, হঠাৎ মাইকে শাহেদের নাম ঘোষণা করে মুকুল গুন। এবং পরক্ষণেই 'তোমরা যতই আঘা---ত করো নেইকো অপমান, শুধুই আমায় দাওগো সুযো---গ শোনাত এই গা--ন, তোমরা যতই' সবাই মোহিত হয়ে যাই ওর গানে। পরদিন সবাই অনেক প্রসংশা করেছিল বাড়ীতে এসে । আমিও প্রসংশা করেছিলাম। শুনে ওর শুধুই স্বভাবসুলভ হাসি। মেয়রা ওকে অনেক বেশী পছন্দ করত। তখনকার দিনে বলিউড স্টার শাহরুখ খানের 'কাভি খুশি কাভি গাম' নিয়ে অস্থির মিডিয়া জগত। সত্যিকারের বিষয় ছিলো যে শাহেদের চুল, বডি ফিটনেস, চেহারা সম্পূর্ণ শাহরুখের মতোই ছিল। বিরল দৃষ্টান্ত হলেও সেটা বাস্তব ছিল। যা হোক ততোদিনে ওরও কিছু ভক্ত জুটে যায়, তবে সেটা লোকাল।
থেমে যাওয়া জীবনের গল্প-১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ৩:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




