আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান মান্নার লেখাটা পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে, তবে এই লেখাতে অনেক উল্লেখযোগ্য তথ্য উঠে আসেনি। তবুও সকলের পড়ার জন্য প্রকাশ করলাম।
ফেব্র“য়ারির প্রথম দিন সকালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম টাঙ্গাইলের দিকে। ফেব্র“য়ারি ভাষার মাস। এই ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম দিনেই টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের এক নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন শামসুল হক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। সেটা এক অন্য সময়। ভারত বিভক্তির বছর যেতে না যেতেই পূর্ববাংলার মানুষ বুঝেছিল পাকিস্তান প্রায় এক ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দিতে চায় এ দেশের জনগণের ওপর। ভাষার ওপর আঘাত ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের জাতির পিতা মহম্মদ আলী জিন্নার 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা' এই ঘোষণার প্রতিবাদ করে ছাত্রসমাজ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন আরও চার বছর লেগেছিল সেই আন্দোলনকে বিজয়ীর বেশে পেতে। যে একুশে ফেব্র“য়ারি আজ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্যোতক সেটি গড়ে উঠতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
কিন্তু এই চার বছর পূর্ববাংলার জনগণ বসে থাকেনি। এ কথাটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই ছিল ভুল ভিত্তির ওপর। যে কারণে এক বছরের মধ্যেই প্রতিবাদ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা কেবল ছাত্রদের ব্যাপার ছিল না। পূর্ববাংলার ব্যাপক জনগণও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে চেতনাগতভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তার একটি প্রমাণ ১৯৪৯ সালের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে শামসুল হকের বিশাল বিজয়।
২৬ এপ্রিল টাঙ্গাইলের এই উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী। একজন নিপাট প্রজাপ্রিয় ভদ্রলোক। প্রজা নিপীড়ন বা নির্যাতনের কোনো অভিযোগ ছিল না তার নামে। আবার আচরণে নিখুঁত বিনয়ী। তার বিরুদ্ধে শামসুল হক কোনো বিবেচনাযোগ্য প্রার্থী ছিলেন না। খুররম খান পন্নী তার নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করার জন্য মাইক নিয়ে এসেছিলেন। টাঙ্গাইলের মানুষ এর আগে কখনো মাইক দেখেনি। একজন মানুষ কথা বললে তাকে শতগুণ ম-িত হয়ে দূরের মানুষের কাছেও পৌঁছায়, তা এই প্রথম দেখল তারা। করটিয়া সাদাত কলেজের মাঠে সেই সভায় হাজার মানুষের ভিড়। মাঠের এক কোনায় বসেছিলেন শামসুল হক। জমিদার সাহেবের কথা শেষ হওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে গেলেন মঞ্চের ওপর। জমিদার পন্নীকে বললেন, হুজুর এই নির্বাচনে আমিও একজন প্রার্থী। কিন্তু আমার তো আপনার মতো টাকা নেই। আপনার মতো মাইক পাব কোথায়? যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে এই মাইকে আমি আমার নিজের দুটি কথা বলতে পারি। আমি একটু আগেও বলেছি খুররম খান পন্নী একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কেন নয়।
শামসুল হক একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া জানতেন। ইংরেজি বাংলা উভয় ভাষায় লিখতে এবং বলতে পারদর্শী ছিলেন। নিজেই নিজের দলের ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন এবং খুব ভালো বক্তৃতাও করতে পারতেন। মাইক নিয়ে তিনি প্রথমেই ভূয়সী প্রশংসা করলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী খুররম খান পন্নীর। কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও তার মতো একজন সাধারণ মানুষকে জমিদার সাহেব মাইক ব্যবহার করতে দিয়েছেন তার জন্য। তারপর তার মূল কথায় এলেন। শামসুল হক বললেন, জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে আমি প্রার্থী নই। তার মতো ভালো মানুষের বিরুদ্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার লড়াই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। আমি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছি। শামসুল হকের সেই বক্তৃতার কোনো ডকুমেন্ট আজ কারও কাছে নেই। কিন্তু অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। খুররম খান পন্নীর জনসভায় আসা মানুষও শামসুল হকের বক্তৃতা শুনে জেগে উঠেছিলেন। ভোট দিয়েছে শামসুল হককে। বিশাল ভোটের ব্যবধানে খুররম খান পন্নী পরাজিত হন।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শামসুল হকের এই বিজয় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের প্রথম রায়। এ বিজয়ের প্রায় দুই মাস পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এ দেশে প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়)। সর্বসম্মতিক্রমে শামসুল হক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং মওলানা ভাসানী সভাপতি, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ থেকে এটা ভাবা যায় যে, টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের বিজয় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় বিশাল, উর্বর একটি জমি তৈরি হয়েছিল এবং শামসুল হক এই জমি ও তার ওপর বাড়ি নির্মাণে অন্যতম কারিগর ছিলেন।
শামসুল হকের কথা এখন অনেকেই জানেন না। যে দল তিনি গড়েছিলেন, যে দলে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ওই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও তাকে ভুলতে বসেছে। দুই যুগের মতো আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ করেছি। আমি স্বীকার করছি, আমি নিজে কখনো শামসুল হক সম্পর্কে কোনো খোঁজ নেইনি। দলের মধ্যেও তার ব্যাপারে কোনো আলোচনা, কথাবার্তা হতে দেখিনি।
আওয়ামী লীগ শামসুল হকের জন্মদিন পালন করে না। কিন্তু শামসুল হকের আৎদীয়স্বজন, ভাতিজা-ভাগ্নে, নাতি-নাতনি, পরিবারের সদস্যরা মিলে গঠন করেন শামসুল হক ফাউন্ডেশন। শামসুল হক ফাউন্ডেশন ১ ফেব্র“য়ারি দিনব্যাপী তার জন্মদিন পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বিকালে শামসুল হকের জীবনীর ওপর আলোচনা সভা ছিল। সে আলোচনা সভায় যোগ দেওয়ার জন্য আমি রওনা হয়েছিলাম ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়া সোজা সুন্দর রাস্তা আছে চন্দ্রা হয়ে। কিন্তু পরদিন দুই তারিখে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত। টাঙ্গাইলের দু'একজন আমাকে পরামর্শ দিলেন মানিকগঞ্জ হয়ে যেতে, তাতে যানজট এড়ানো যাবে। তুলনামূলক পথ কম সময়ে টাঙ্গাইলে পৌঁছানো যাবে। কিছু কিছু মানুষের এই স্বভাব কারণ ছাড়াই না জেনে উপদেশ দেওয়া, ফলে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার রাস্তার সময় নিল পাঁচ ঘণ্টা। ৩টায় আলোচনা সভা শুরু হওয়ার কথা। আমি পৌঁছলাম ৫টারও পরে। অথচ আমারও পরে রওনা দিয়ে মাত্র দুই ঘণ্টায় টাঙ্গাইল পৌঁছলেন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু স্থপতি আক্তার হামিদ মাসুদ। তাও আবার সরাসরি অনুষ্ঠানস্থলে যেতে পারলাম না। পথের মধ্যে শহরের আদালতপাড়ায় শামসুল হক ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক লাবু সাহেব আমাদের কষ্টের কথা শুনে এবং আমরা সবাই অভুক্ত আছি জেনে খুব তাড়াতাড়ি তার স্ত্রীকে দিয়ে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করলেন। খাওয়াটা ভালো ছিল। আমরা তাড়াতাড়ি খেলাম। তারপরও অনুষ্ঠানে পৌঁছতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি যখন ঢুকলাম তার কিছুক্ষণের মধ্যে সেই হলরুম বলতে গেলে কানায় কানায় ভরে গেল।
প্রথম জীবনে যতই বর্ণাঢ্য ও আলোকোজ্জ্বল হোক না কেন, শামসুল হকের শেষ জীবন ছিল কষ্টের ও মর্মান্তিক। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অভিযোগে শামসুল হক গ্রেফতার হন ও কারাবরণ করেন। তার এক বছর পর ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর এবং জটিল মানসিক ব্যাধি নিয়ে কারামুক্তি লাভ করেন।
বই পড়ে এবং তার আৎদীয়দের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে শামসুল হকের স্ত্রীভাগ্যে শনি লেগেছিল। শোনা যায় সেই সময়কার ইডেন গার্লস কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন শামসুল হক। অভিযোগ, আফিয়া খাতুন একজন উচ্চাভিলাষী মহিলা ছিলেন। শামসুল হক আরও অনেক বড় হবেন। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন হয়তো এই আশায় তিনি শামসুল হককে বিয়ে করেন। কিন্তু শামসুল হক জেলে যাওয়ার পরে তিনি তাকে ছেড়ে চলে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকা চলে যান এবং সেখানে একজন পাকিস্তানিকে বিয়ে করেন। শামসুল হকের দুটি কন্যাসন্তান ছিল। বড় মেয়ের নাম উম্মেবতুল ফাতেমাজ জহুরা (শাহীন) এবং ছোট মেয়ের নাম উম্মেবতুল তাহেরা (সোয়েফা)। বর্তমানে তারা দুজনেই পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং বিবাহিতা। সপরিবারে আমেরিকা বসবাস করেন।
টাঙ্গাইলের এই অনুষ্ঠানে গিয়ে জানলাম মেয়ে দুজন কিছু দিন আগে টাঙ্গাইলে খুঁজে পাওয়া বাবার কবর দেখতে এসেছিলেন। এর আগে তারা জানতেনও না যে, শামসুল হক তাদের পিতা। তাদের নাকি বলা হতো তোমাদের পিতা একজন বদ্ধ উন্মাদ, তার কাছে গেলে সে তোমাদের মেরে ফেলতে পারে।
আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র। আর শেষ বিচারে মানুষ আসলে একা। আর একাকিত্বের বৃত্তে দুঃখ, নীরবে লেখে তার নাম। এ রকম একটি নাম শামসুল হক।
শামসুল হক ফাউন্ডেশন মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির লিখিত 'স্বাধিকার আন্দোলন এবং শামসুল হক' নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। তার ৯৮ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করছি। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মুকুল সিনেমা হলে (ঢাকা) আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। নিমন্ত্রণপত্র না পাওয়া সত্ত্বেও শামসুল হক অসুস্থ শরীর নিয়ে অধিবেশন কক্ষে এসে সরাসরি মঞ্চে চলে আসেন। মঞ্চে তখন মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপবিষ্ট ছিলেন। শামসুল হক মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ তার বসার জন্য কোনো আসন ছিল না। উপবিষ্ট নেতারা তার প্রতি কোনো মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। এ অবস্থায় একদল কর্মী শামসুল হককে বসার জন্য একটা চেয়ার এনে দেয়। শামসুল হক বসতে যাচ্ছেন কিন্তু তখনই জনৈক নেতার নির্দেশে অপর কর্মী এসে চেয়ারখানি টান মেরে সরিয়ে নেয়। শামসুল হক তখন খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলেন, কোনো কথা বললেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে প্রস্থান করলেন।
শামসুল হকের পরবর্তী জীবন আরও দুঃখের। তিনি তার হাতে গড়া দল থেকে লাঞ্ছিত হন। ধীরে ধীরে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যান এবং বলা যেতে পারে অদৃশ্য হয়ে যান। হঠাৎ তাকে দেখা গেছে অসুস্থ শরীর, ছিঁড়া-ময়লা কাপড়, ছিঁড়া স্যান্ডেল পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে এ অবস্থায় কোথাও কোথাও দেখা গেছে বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন।
শামসুল হক মৃত্যুবরণ করেন ১২ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার জোগারচর এলাকায়। সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়। প্রতিবছর ১১ সেপ্টেম্বর জোগারচরে শামসুল হক ফাউন্ডেশন অনুষ্ঠান করে থাকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের কী করুণ পরিণতি। ছাত্রলীগের এক সময়ের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এই রকম অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসা তাকে সারিয়ে তুলেছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে এ জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। কেউ কি ছিল না শামসুল হকের চিকিৎসা করতে? দেশবরেণ্য সব নেতা ছিলেন। অথচ শামসুল হক মারা গেলেন একটা পিপীলিকার মতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:০৩