somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

***শফিকের বাবা হওয়া অতপর উপলব্ধি*** (ছোট গল্প)

১২ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মানুষটির নাম সফিকুল ইসলাম শফিক। জন্ম থেকে সারা জীবন কষ্টই করেছে, ক্লাস সেভেন থেকেই লজিং থেকে পড়াশুনা করতে হয়েছে। দরিদ্রতার কারনে তাঁর বাবা-মা পড়াশুনায় এবং জীবন গঠনে তাকে তেমন সাহায্য করতে পারেনি। তাই শফিকও তাঁর জীবনে বাবা মায়ের অবদান আছে তা কখনই মনে করত না।

যা হোক সে নিজ চেষ্টায় মিরসরাই ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করে অনেক কষ্টে চট্টগ্রাম কলেজে বাংলায় মাস্টার্সে ভর্তি হয়, পড়াশুনার সাথে চলে জীবন সংগ্রামে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তাই সে দিনে ৮-১০ ঘণ্টার চাকরি শেষে তাঁর পড়াশুনা করত এবং মাস্টার্সে ভালো মানের দ্বিতীয় শ্রেণী নিয়ে পাশ করে গেল। ঘটনাটা ছিল ১৯৮৬ সালের দিকের তখন শিক্ষিত মানুষের অনেক অভাব ছিল তাই শফিক সহজেই বেসরকারি কোম্পানিতে নিজের জন্য চাকরি জুটিয়ে নিল। বেতন ভালোই ছিল মাসে ৮৫০০ টাকা।

এক বছর যেতে না যেতেই নিজ সহকর্মীর বোনকে বিয়ে করে ফেলল। মেয়েটির নাম জান্নাতুল মাওয়া, ডাক নাম ছিল জান্নাত। শফিক আচার আচরণে ভালো ছিল কোন বদ অভ্যাস ছিল না তাই সহকর্মী সফিকের অভিভাবকের অনুপুস্থিতিতেই নিজ বোনকে বিয়ে দিতে চিন্তা করেনি। আসলেই ব্যক্তিগত ভাবে শফিক অনেক ভালো মানুষ ছিল। কিন্তু তাঁর বাবা কৃষক হওয়ায় এবং চরম দরিদ্র হওয়ায় সে নিজের বাবার পরিচয় ও ফ্যামিলির পরিচয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে চাইত না। সে যেহেতু মনে করত তাঁর এই অর্জনে তাঁর বাবা মায়ের কোন অবদান নেই তাই বাবা মায়ের খোঁজ রাখা তাঁর কর্তবের বাইরে বলেই সে মনে করত।

শফিক নিজ রক্তের মানুষদের থেকে অনেক দূরে থাকত এবং তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখত না। সে সব সময় ভাবত তাঁর সন্তানের জীবন তাঁর মত কষ্টের হবে না। শফিক নিজের সব ভালোবাসা ও সামর্থ্য দিয়ে তাঁর জান্নাতকে ভালবাসত এবং এক কথায় জান্নাতের জন্য পাগলই ছিল। জান্নাত অনেক ফরহেজগার মেয়ে ছিল; সে মাঝে মধ্যেই শফিকের বাড়িতে যেতে চাইত এবং শফিককে তাঁর মা-বাবার খবর রাখতে বলত। শফিককে সে মা বাবার সেবা ও তাদের দোয়া পাওয়ার প্রয়জনীয়তা নিয়ে অনেক বোঝাতো। তা ছাড়া জান্নাত চাইত না তাদের পদচারণার এবং ভবিষ্যৎ সন্তানদের পচারনার গণ্ডি এত ছোট হোক।

শফিকের স্ত্রীর গর্ভে যখন তাঁর প্রথম বাচ্চা আসে তখন সে অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ে, সার্বক্ষণিক নিজের চাকরির বাইরে স্ত্রীকেই সময় দিত। দিনে দিনে তাঁর স্ত্রীর বাচ্চা প্রসবের সময় হয়ে আসে। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরামর্শে সে স্থির করল সে তাঁর স্ত্রীকে হাসপাতালে নেবে না, কারন সে দেখেছে হাসপাতালে অযাচিত ভাবে হলেও সিজার করানো হয়। সে তাঁর প্রিয় স্ত্রীকে এভাবে কাটাছেড়া হতে দিতে চায় না। তাই বাসায় অভিজ্ঞ নার্স দিয়ে বাচ্চা প্রসবের ব্যাবস্থা করল।

প্রসবের আগের সময়ের কথা, শফিক তাঁর বাসার বাইরে বসে ছিল তাঁর স্ত্রী বার বার স্বামীর কাছে ছুটে আসছিল আমি মনে হয় বাঁচব না আমাকে একটু বিষ দাও আর পারছিনা এমনি কাকুতি জানাচ্ছিল প্রসব ব্যাথার যন্ত্রণায়। তাঁর স্ত্রীর প্রতি কদমে রক্ত ঝরছিল, সারা বাসায় ফোঁটা ফোঁটা রক্তে ভরে গেছে। শফিক স্ত্রীর কষ্টে অনেক ভয়ে ছিল এবং সে তাকে সান্তনা দেবার মত ভাষাও পাচ্ছিল না। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির রাখল।

শেষ মেষ টানা ১৬ ঘণ্টার গুমোট ভয়ের পর ভোর ৪টার দিকে শফিক তাঁর সুস্থ ও সুন্দর ফুটফুটে ছেলে সন্তান পেলো। কিন্তু তাঁর অনেক উৎকণ্ঠা এখনও রয়েই গেল তাঁর প্রানপ্রিয় জান্নাতকে ঘিরে, সে যে এখন নিস্তেজ হয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। সকাল দশটায় জান্নাতের ঘুম ভাঙলো, আসলে প্রসবের পর শারীরিক দুর্বলতা এবং কিছুদিনের ঘুমহীনতায় এমন হয়েছিল। শফিক এতক্ষণ বাচ্চা নিয়েই স্ত্রীর পাশেই বসে ছিল। স্ত্রীর ঘুম ভাঙতে দেখে সে আনন্দে আত্মহারা হল। আসে পাশের প্রতিবেশী এবং নার্স শফিকের স্ত্রীকে বলল বাচ্চাকে দুধ দিতে। শফিকের স্ত্রী বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে দিল।

শফিক আজ অনেক খুশি সে মিষ্টি বিলি করেছে প্রতিবেশীদের মাঝে তখনি এক প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা বলে উঠল বাবা শফিক- ভয় কেটে গেছে, তোমার স্ত্রীর প্রথম বাচ্চা প্রসব ছিল বলেই সে এত বেশী কষ্ট পেয়েছে। হটাৎ শফিকের কলজে মোচড় দিয়ে উঠলো সে চিন্তা করল সেও তো তাঁর মায়ের প্রথম সন্তান। তাঁর মাও তো এমনি জীবন বাজি রাখা কষ্ট করে তাকে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছে। কিন্তু সে নিজে তাদের সাথে কেমন আচরন করছে? তারও তো ছেলেই হয়েছে এই ইতিহাস যদি আল্লাহ তাঁর বেলায় আবার ফিরিয়ে আনেন? আসলে প্রতিবেশীর ঐ কথাটি শফিকের মনে দারুনভাবে গেথে গিয়েছিল।

শফিকের মনে পাপ বোধ জন্ম নেয়ার পর শফিক তাঁর স্ত্রীকে শাশুড়ির তত্ত্বাবধানে রেখে তাঁর মা বাবাকে দেখতে গ্রামে ছুটে যায়। বাড়িতে গিয়ে দেখল- তাঁর মা মৃত্যু শয্যায় আর তাঁর বাবা তাঁর মায়ের শিয়রে বসে পানি ঢালছে, শফিককে দেখে তাঁর বাবা উৎফুল্ল হল না শুধু বলল খবর কার কাছে শুনেছ? ওদিকে তাঁর মা শফিক এসেছে শুনে অসুস্থ অবস্থা থেকেই সব শক্তি নিয়ে উঠে সন্তানের গলা জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বেহুঁশ হয়ে গেল।

এইদিকে চিৎকার ও আর্তনাত শুনে শফিকের দুই বোন ও ছোট ভাই দৌড়ে এলো; এসে ভাই থেকে দুরেই অবস্থান রেখে মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শফিক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে চিৎকার করে ছোট বাচ্চার কাদতে লাগলো আর ভাই বোনদের বুকে জড়িয়ে নিল, (ওদিকে শফিকের বাবা নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো)। শফিক ভাই বোনদের বললঃ আমি আমার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে হলেও আবার মাকে সুস্থ করে আনব ইনশাল্লাহ।

শফিক তাঁর মাকে নিয়ে থানা সদর হাসপাতালে গেল সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর মা সুস্থ হয়ে উঠল ইতিমধ্যে জান্নাতও মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছে। শফিক সবাইকে নিয়ে নিজের বাসায় গেল, জান্নাত সবাইকে পেয়ে অনেক খুশি হল, আর খুশিতে বলল আমার সন্তান তাহলে সবার আদর পেয়েই মানুষ হবে? এটাই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। আমি তোমাকে অনেকবার বলেছিনা বাবা মাকে সহ সবাইকে আমার কাছে আনতে? যাক আজ আমার মনের আশা পূরণ হল জান্নাত খুশিতে বলল।

জান্নাত ও শফিক বাচ্চার আকিকা খুব ভালভাবেই করার পরিকল্পনা করল এবং আকিকার অনুষ্ঠান করল শফিকের গ্রামের বাড়িতেই। রাতে তারা নিজেরদের আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালো। সারা দিন বউ শাশুড়ি মিলে রান্না করেছিল তাই সবাইকে খাইয়ে নিজেরাও তৃপ্তি পেল।

আসলেই নতুন মিলনের এই এমনি অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। সবাই অনেকদিন পর প্রান ভরে আনন্দ করেছিল। রাতের বাকীটা সময় সবাই মিলে জান্নাতকে নিয়ে গল্প করেই কাটালো। শফিক শুধু পুকুর ঘাট হতে সব নিরবে দেখছিল; প্রতিটি ক্ষণে যেন তাঁর মনে নতুন জীবন বোধের আনন্দ দোলা দিচ্ছিল। শফিক আনমনে বলে উঠল- জীবনের সব উপাদানের মাঝে অনেক বড় উপাদান বুঝি সবার মঝে সবাইকে নিয়ে থাকা!?
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×