প্রথম পর্ব: নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা - পর্ব:১
[এই প্রবন্ধটি কোনো ধর্মকে বা ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি]
স্রষ্টা অস্তিত্বহীন-২
লর্ড বেকন তার Bacon's Moral Essays-এ বলেছিলেন, "নাস্তিকতা মানুষের মাঝে যুক্তি, দর্শন, মানবতা, আইন এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনিবার্য সকল গুনের সন্নিবেশ ঘটায়, যেক্ষেত্রে ধর্ম নামক কুসংস্কারটি এর প্রায় সব-ই হরণ করে নেয় এবং একনায়কতন্ত্রের মতোন বিরাজ করতে চায় মানুষ-এর চিন্তাশীল মনটির উপর। এ কারণে দেখা যায়, নাস্তিকতা বা নাস্তিকেরা দেশ ও সমাজের হিতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে আর ধর্ম বা ধার্মিকেরা স্বস্বার্থে ঘটায় বিদ্রোহ।"
সভ্যতার আদি-তে মানুষ সে জানত না প্রকৃতির রহস্য, তাই সে ভীত ছিল তার চারপাশের প্রকৃতির প্রতি। আর এ অজ্ঞতাপ্রসূত ভয় থেকেই উৎপত্তি হয় ধর্মের। সে কল্পনা করে নেয় যে নিশ্চয়ই কোনো অপার শক্তিধর কেউ রয়েছে প্রকৃতির এ শক্তির নিহিতে। অন্যদিক থেকে আবার মৃত্যু নামক চক্রের মাধ্যমে মানুষের 'আমি' সত্ত্বাটি যে কোনো এক শূণ্যের মাঝে বিলীন হয়ে যায় তা-ও সে মানতে ছিল নারাজ। তাই মানুষ এ সকল সমস্যার সমাধান কল্পে জন্ম দেয় স্রষ্টার। যে স্রষ্টা অজানা-অচেনা মৃত্যুর বদলে দেবে কাল্পনিক স্বর্গ-নরকের সুখ বা দুঃখের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন এক মৃত্যু। এককথায়, মানুষের অজানা-অচেনার প্রতি যে সর্বকালীন ভীতি, তা-ই মানুষকে বাধ্য করেছে দানবীয় শক্তিধর কোনো কাল্পনিক স্রষ্টার জন্ম দিতে।
আমরা যদি যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা দ্বারা স্রষ্টাকে ব্যাখ্যা করতে যাই, তাহলে আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই যে, স্রষ্টার মতে মানুষ কখনোই সৃষ্টির সবচে' গোপন, সবচো' প্রাচীন, সবচে গুরুত্বপূর্ণ রহস্য সম্পর্কে জানার অধিকার রাখে না। বরং এ সকল চিন্তাজনীয় পাপ হতে দূরে থেকে তাকে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে নিতে হবে কায়মনবাক্যে। অর্থাৎ মানুষকে চিন্তাশীল না হয়ে, তার মেধার স্তরকে পরীক্ষা না করে অলস এবং মূর্খের মতো ধর্মীয় বুলি মেনে নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, যখনই আমরা বলে উঠি স্রষ্টা সকল সৃষ্টি কলেছেন, তিনি-ই সকল রহস্য জানেন, আমরা মূলত স্রষ্টার ঘাড়ে নিজের অজ্ঞতাটাই চাঁপিয়ে দিই মাত্র।
তবে যদি অজ্ঞতা হয়ে থাকে স্রষ্টান জন্মের শূক্রবীজ তাহলে জ্ঞান হচ্ছে তার ধ্বংসের পাদটিকা। মানুষ যখন তার নিজ সত্ত্বার ব্যাপারে চিন্তা করে এবং নিজস্ব সামর্থ্যের সাথে তার জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার যোগসাজুজ্য ঘটায় তখন অনুধাবন করতে পারে এ জগৎ ও তার তত্ত্বকে। আর সেক্ষেত্রে তার ব্যক্তিক ভয়- দ্বিধা ও শঙ্কা দূরীভূত হয়ে সেখানে স্থান করে নেয় সাহস-শিক্ষা এবং প্রাজ্ঞ চিন্তা-চেতনা। সুশিক্ষিত মানুষ খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুমেয় যে, হবেন কুসংস্কার মুক্ত।
পৃথিবীর সকল আস্তিকগোষ্ঠী-ই তার পিতা বা পুরহিত প্রদত্ত স্রষ্টার সাধনা করে আসছে আবহমান কাল ধরে। বংশ হতে বংশে প্রবাহিত হচ্ছে এ ধর্ম। আর এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রমানের জায়গায় আসন লাভ করেছে বিশ্বাস, আনুগত্য ও প্রথা। একটি শিশু স্রষ্টার সামনে অবনত হচ্ছে কারন তার পরিবার থেকে তাকে বলা হচ্ছে, জোড় করা হচ্ছে। তার পূর্বপুরুষদের একসময় যেমন জোড় করেছিল সমাজের শাসক বা কথিত ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষগণ, যারা গালভরা বুলির মতো ঘোষণা করেছিলেন, "স্রষ্টা আমাদের নির্ধারণ করেছেন তোমাদের আলোর পথে পরিচালিত করার জন্য। স্রষ্টার সিদ্ধান্তে, তার নৈকট্যে আমরা জ্ঞানলব্ধ হয়েছি আর আমাদের দায়িত্ব সে জ্ঞান তোমাদের মাঝে ছড়িয়ে দে'য়া। তোমাদের কর্তব্য কেবল স্রষ্টাকে বিশ্বাস এবং সম্মান প্রর্দশন।" আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেনো আমি মধ্যবর্তী কারো স্মরণাপন্ন হব? কারণ স্রষ্টা বলেছেন বলে? অন্যথায় নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে বলে? ঠিক আছে তা-ও না হয় মানলাম, কিন্তু এই স্রষ্টা যদি প্রকৃত স্রষ্টা না হয়!
পৃথিবীতে রয়েছে নানান ধর্ম এবং প্রত্যেক ধর্ম মতেই স্রষ্টা এক এবং অদ্বীতিয়। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য প্রতি ধর্মেরই বিশ্বাস নিজ ধর্মীয় স্রষ্টাই প্রকৃত স্রষ্টা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তবে কোন স্রষ্টা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃত। মানবতার সেবী, ধর্মের রক্ষা কর্তা, ঈশ্বর প্রেরিত এসকল ধর্মযাজকের স্রষ্টা প্রশ্নে একমত হাোয়া কি বাঞ্ছনীয় ছিল না? তবে কি তারা প্রমান করছে না তাদের একই পেশাজীবি অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ মিথ্যে বলছে না? তবে কি স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং তার রহস্য অনুসন্ধানের দাবি রাখে না? কিন্তু হায় পৃথিবীর কোনো ধর্মই দেয় না স্রষ্টার উপর অনুসন্ধানের অধিকার। আর আমাদের নির্ভর করতে হয় কথিত স্রষ্টা প্রেরিত সেসকল ভাগ্যবান দু' একজন তেজী পুরুষের ওপর, যাদের-কে স্রষ্টা স্বর্গালোকে ধর্মীয় জ্ঞানে প্রশিক্ষিত এবং সমৃদ্ধ করে মর্ত্যে পাঠিয়েছিলেন তার নাম প্রচারের জন্যে। অবশ্য হ্যা, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কারন মানবসৃষ্ট স্রষ্টার মানুষের কাছে পৌছুনোর জন্য আরেক জন মানুষকেই তো দরকার।
[চলবে]
[মূল: The Necessity of Atheism(1811) by P.B.Shelley]