
জার্নালিজমের ছাত্র ছিলাম। ভাল ছাত্রের সুনাম থাকলেও ডিপার্টমেন্টে নতুন মেয়েদের সম্মন্ধে জানার আগ্রহ যে ছিলনা তা না। নোটিশ বোর্ডে নবাগত মেয়েদের নামের ভেতর ম্যাগনোলিয়া নামটা পছন্দ হয়। বৃটিশ কবি নীল রের বিখ্যাত কবিতাটা মনে পড়ছিল। কিন্তু নবীন বরণের দিন খর্বাকৃতি মোটা মেয়েটিকে সুন্দর ফুলের নামের সঙ্গে মেলাতে পারি নি। চলতে ফিরতে অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি।
ক্লাসিক বুকস্টলের রতন ভাইকে দিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে নতুন একটা বই আনিয়েছি। আজিজ মার্কেটে গিয়েছিলাম সেটা আনতে। লিটল ম্যাগাজিনের দোকানে দু'চার আঁতেল গোছের বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে সন্ধা পড়ে গেল। মার্কেটের বাইরে এসে দেখি ঝম ঝম করে বৃষ্টি ঝরছে। বড় বড় ফোঁটা। মার্কেটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি । চোখে পড়লো নবাগত মেয়েটিও বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছে। চোখে মোটা কাচের চশমা, ওজন হয়তো আরো বেড়েছে। আমার দিকে চোখে চোখ পড়তেই বললো, "ভাইয়া, আপনি মুনিয়া আপাদের ব্যাচের না?"। আমি হ্যা সূচক উত্তর দিকেই সে জানালো সে আমার কথা অনেক শুনেছে।
পথে পানি জমে যাওয়াতে রিক্সা পাওয়া যাচ্ছিল না। বহু কষ্টে চেচামেচি করে তিনগুণ ভাড়ায় একটা রিক্সা পেলাম। রিকশায় ওঠার সময় মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো, "ভাইয়া, আপনি কোথায় যাবেন?" । তাকে জানালাম আমি আরামবাগে থাকি। তার বাসাটা আমার থেকে অনেক দুরে। সে কোন ভণিতা না করে বললো, "ভাইয়া, আপনিও উঠুন, এখানে রিক্সা পাওয়া কঠিন। সামনে প্রেস ক্লাবে অনেক রিক্সা পাবেন"। আমি ইত:স্তত করে উঠেই পড়লাম। মেয়েটাকে দুর থেকে দেখে যা ভেবেছিলাম তেমন নয়। দেখতে যেমনই হোক কথা বলে সুন্দর করে। গ্রীক নাটকের উপর বিস্তর পড়াশোনা করে। হাতে দুটো ভারী বই।
ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সামনে ধীর গতিতে রিক্সা চলছে। প্রায় অপরিচিত একটি মেয়ের সঙ্গে রিক্সার হুড তুলে বসে থাকতে বাংলা ছবির মতো লাগছিল। দুর্ভাগ্য যে মেয়েটি নায়িকার মতো কেউ না। এর মধ্যে বৃষ্টি বাড়তে থাকলো। বৃষ্টির ছটা নীল পলিথিনের মধ্যে দিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। এরকম মুহুর্তগুলো এত সুন্দর যে পাথর মনকেও গলিয়ে দেয়। কী মনে হলো তাকে বললাম, তুমি শেল সিলভারস্টাইনের রেইন কবিতাটা পড়েছ?
I opened my eyes
And looked up at the rain,
And it dripped in my head
And flowed into my brain,
And all that I hear as I lie in my bed
Is the slishity-slosh of the rain in my head.
মেয়েটা অবাক হয়ে বললো, "কী কান্ড, আমিও এই কবিতার কথা ভাবছি! তার জীবনী গতকাল পত্রিকায় পড়েছি। আর কবিতাটা আমার খুব প্রিয়"।
আমি ম্যাগনোলিয়াকে দেখছিলাম না। বরং তার মিষ্টি কণ্ঠস্বর আমাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। আমি মিল দিলাম, "বাহ! তোমার সঙ্গে আমার দেখছি খুব মিল। জানো, কবির একটা বই আনিয়েছি"। সে বইটা ধার নেবার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করলো। আমি বললাম কাল তো ভার্সিটি বন্ধ। সে নিজ থেকেই বললো, "আমার তেমন কাজ নেই, পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে আসুন। সময় থাকলে গল্পও করা যাবে"।
আমি কি মনে করে বলেছিলাম, "তাহলে দুপুরে এসো, সিলভানা রেস্টুরেন্টে এক সঙ্গে খাই"। শাহবাগের দোতলায় এই রেস্টুরেন্টে যে প্রেমিক প্রেমিকারা সময় কাটায় সেটা কারো অজানা না। কিন্তু সে বললো তার কোন আপত্তি নেই।
বাসায় ফিরে নিজের প্রতি বিরক্তি ধরে যায়। আমার ঘোরের ভেতর এরকম কথা বলার স্বভাবটা গেল না। আর মাথায় ঘুরছিল, এ কেমন ঘরের মেয়ে? একটা ছেলে বললেই সিলভানাতে খেতে রাজি হয়ে যায়! মেয়েটা ভাল চরিত্রের হলে নিশ্চয়ই এভয়েড করতো। বলতো, "না ভাইয়া, আমি বসতে পারবো না। অনেক কাজ"। এও মনে হলো অসুন্দরী মেয়েদের হয়তো এমনই করে।
রাতেই মেয়েটার নাম গোপন রেখে জাহিদকে ফোন করলাম। সে বিশ্বপ্রেমিক মানুষ। প্রেম বিষয়ে তার অভিজ্ঞ পরামর্শটা জানলে সুবিধা হবে। আমি বললাম,
"দোস্ত, একটা ঘটনা ঘটছে, একটা মাইয়ার সঙ্গে বাসে পরিচয়, প্রথম দেখা। বাইরে দেখা করনের কথা বলতেই রাজি হয়া গেল..এখন কী করি?".
"দেখতে কেমন?"
"মোটামুটি"
“পছন্দ হৈছে?”
(নিরবতা)
“পছন্দ না হইলে তুই দেখা করনের কথা কইতে গেলি ক্যান? এখন যা ধরা খা"
"আরে আমি কি আর বুঝবার পারছি যে এত সহজে রাজী হইবো?"
"অখন শোন, যে মাইয়া রিয়েললি ভালা, সে কোনদিনও একবারে রাজি হইবো না। খোজ নিলে দেখ এর বিয়াসাদী হয় না। না হইলে অন্য কোন প্রব্লেম আছে।"
জাহিদের বুদ্ধিটা পছন্দ হয় না।
কিন্তু সে আবারও বললো, "শোন, মাইয়াগো পটানি তোর কাম না। তুই কাইলকা যাবি না। মাইন্ড খাইলে খাউক। এ ঠিকই বুইঝা লইবো তুই এভয়েড করতাছস"।
"পরে কোন দিন সামনা সামনি অইলে?"
"তোগো নিয়া মুশকিল, লাভ আর ওয়ারে কি কোন নিয়ম থাকে? ফান্দে পড়লে কৈলাম ছুটতে পারবি না? পর্থম প্রেমেই বিয়ার দড়ি গলায় পড়বো"
জাহিদের কথা মত ম্যাগনোলিয়াকে এভয়েড করলে আমার হয়তো ভালই হতো। কিন্তু এভাবে নিজেকে ছোট করতে পারি নি। মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে। একবার নয় বেশ কয়েকবার।
মাঝে মাঝে একজন কে সঙ্গে পেতে ভালই লাগে। নি:সঙ্গ হয়ে থাকার চেয়ে সময় কাটানো আর কি। কিন্তু ম্যাগনোলিয়ার মতো অসুন্দর মেয়েকে নিয়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট করাটা মনে সায় দেয় না। রাতের পর রাত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি। নিজেকে ভীষণ বঞ্চিত মনে হয়। রাগ হয়।
একটা নিছক অসম বন্ধুত্বকে প্রেম বানিয়ে ফেলছি । মেয়েটা একটু ফর্সা হতো বা ইঞ্চি দুই লম্বা হতো তাও মানা যেত। স্থুলাঙ্গিনী একটি মেয়েকে বিয়ে করার কথা শুনলে মা নির্ঘাৎ ত্যাজ্য করবেন। বন্ধু মহলে বলবে আমি ঠকে গেছি। অথচ নিজেরই ভদ্রতায় সম্পর্কটা ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে, এখন না পারি গিলতে না পারি ফেলতে।
ম্যাগনোলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের কথা ঘনিষ্টদের জানানো হয়নি। এমন কি জাহিদকেও না। এসব বন্ধু বিচ্ছু। জানলে টক-আফ-দা-ডিপার্টমেন্ট করে আমাকে বিপদে ফেলবে।
***
ইউনিভার্সিটিতে অনেকদিন ধর্মঘট হয়। এরপর আজকে ক্লাস খুলেছে।
ম্যাগনোলিয়ার বিষয়ে দোনমনা ভাবটা ক্রমেই বাড়ছিল। ভাবলাম ঘনিষ্ট ৩/৪ জন বন্ধুকে ম্যাগনোলিয়ার নামটা বলবো। জাহিদের কথা মনে হলো সবার আগে।
তাকে ক্যাম্পাসে খুজে খুজে কোথাও পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম হাকিমের চায়ের দোকানে । আমাকে দেখে সে চেঁচিয়ে উঠলো, "এই এই দোস্ত, তোরে আমি খুইজা হয়রান"।
আমি কাছে গিয়ে বললাম,
"কি কস! আমিও তো তোরে হারিকেন দিয়া খুজতাছি"
এরপর জাহিদ নরম গলায় বললো
"দোস্ত! একটা কান্ড হইছে । ম্যাগনোলিয়া নামের একটা মাইয়া ঢুকছে জুনিয়র ব্যাচে দেখসস না?"
"হ, দেখছি। ক্যান, কি হইছে?"
"মাইয়াটার চেহারাটার মধ্যে কী যেন একটা আছে। আনকমন। দেখলে হেভ্ভী মায়া লাগে। ফিগারটা জটিল। ঠোট দুইটা একেবারে মাখ্খন! "
আমি জাহিদের শব্দ ব্যবহারে পরিচিত। সে বলতে থাকলো,
"তোরে একদিন বুদ্ধি দিসি, এইবার তুই আমারে একটা বুদ্ধি দে"
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সে বলতে থাকলো
"মাইয়াটার ভাব বেশী। তার লাইগা রকি, পিন্টু, বাবু ভাই পাগল। কিন্তু কেউরেই পাত্তা দেয়না। সেইদিন তারে লাইব্রেরীর সামনে দেইখা ডাইকা কইলাম, ফ্রী থাকলে চলো না মধুতে দুই মিনিট কথা বলি"।
"তারপর?"
"তারপর আর কি। সে আমারে কইলো, ভাইয়া, পরে অন্যদিন কথা হবে, আজকে ইউনিভার্সিটির বাসের টাইম হয়ে গেছে । মা চিন্তা করবে।
অথচ আমি জানি ধর্মঘটের জন্য সেদিন ইউনিভার্সিটিতে কোন বাসই চলেনি"

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


