somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিষয়বিদ্যার ভূমিকা : শুরুর তিন

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
বাংলাভাষায় দর্শন চর্চার বিকাশ হয় নি বললেই চলে। তার মানে এই নয় যে বাংলাভাষায় আমরা চিন্তা করি না, কিম্বা বাংলায় ভাবচর্চার কোন ইতিহাস নাই। বাংলার
ভাবচর্চার যে ধারা ও ইতিহাস সেখানে আমরা শিক্ষিতদের পাই না। পাই যাদের আমরা ফকির দরবেশ, বাউল, বয়াতি সুফি, বৈষ্ণব, শাক্ত ইত্যাদি নামে চিনি। তাদের ভাবচর্চার কোন লিখিত রূপ যে নাই তা নয়, তবে এই চর্চা এককথায় কণ্ঠস্থ ও মুখস্থ চর্চা। অর্থাৎ শ্রুতি ও কন্ঠ নির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে তাদের বিকাশ। এরা গান গেয়ে বা কথা বলে তাদের তত্ত্ব প্রচার করেন। শ্রুতি ও কণ্ঠ নির্ভর সংস্কৃতির যে বৈশিষ্ট তার সঙ্গে মুদ্রণ যন্ত্র নির্ভর চিন্তা চর্চার পার্থক্য থাকবার কথা। আছেও। মুদ্রণ যন্ত্র বা ছাপাখানা আমাদের পড়বার অভ্যাস তৈরি করেছে। ছাপা লেখা আমরা বাঁ দিক থেকে ডানে পড়ি, সরল রেখায়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বলছি। আরবি আর উর্দুতো ডান দিক থেকে বাঁয়ে পড়া হয় । বাংলা ভাষায় বিষয়কে ছাপা্র অক্ষর ও সরল রেখার মতো বাঁ দিক থেকে ডানে যখন পড়ি তখন সঙ্গে সঙ্গে আমরা কি বিষয় পড়ছি বুঝতে পারি না। পড়বার পর কি পড়েছি তা বুঝবার জন্য পড়াগুলোকে আবার একত্র করে ভাবতে হয়। এই প্রক্রিয়া কথোপকথন কিম্বা শ্রুতি ও কন্ঠের প্রক্রিয়া থেকে আলাদা। মুদ্রণ যন্ত্র আসার পর মানুষের চিন্তার অভ্যাসের পরিবর্তন কোথায় কিভাবে কি কারণে ঘটেছে তা নিয়ে গবেষণা আছে অনেক। তার হদিস নেওয়া এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা এই প্রশ্নটা জারি রাখতে চাইছি এই অনুমানে যে ছাপাখানা আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মধ্যে বদল ঘটিয়েছে বটে, কিন্তু মনে রাখা দরকার মানুষ ছাপার অক্ষরেই শুধু চিন্তা করে না। ছাপা লেখা মুখস্থ রাখার দরকার পড়ে না, কারণ তার কপি পাওয়া যায়, কিম্বা ভুলে গেলে আমরা পাতা উল্টিয়ে পড়ে নিতে পারি। কিন্তু কান ও কন্ঠ সংস্কৃতির সে সুবিধা নাই। তাকে মুখস্থ রাখতে হয়। মুখস্থ রাখবার সহজ পথ হচ্ছে গান বাঁধা। এজন্য সাধক দরবেশদের গান বাংলাভাষার দর্শন চর্চার বড় নজির হয়ে রয়েছে।

অর্থাৎ ছাপাখানাই চিন্তার বা দর্শন চর্চার একমাত্র মাধ্যম নয়। যখন ছাপাখানা ছিল না তখনও মানুষ চিন্তা করেছে। ছাপাখান থাকলেও মানুষ এখনও পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে, মানুষের সঙ্গে মানুষের কথোপকথন হয়। ওর মধ্যেও চিন্তার চর্চা চলে। বাংলার দর্শন বা ভাবচর্চার যে শক্তিশালী ধারা তার বিকাশ ঘটেছে ছাপাখানার বাইরে। আর তার ধরণ হচ্ছে প্রধানত, পুঁথি, পালা, গান ইত্যাদি। বাংলার দর্শন, ভাবুকতা বা ভাবান্দোলন যাই বলিনা কেন তার প্রধান ধারা গড়ে উঠেছে বাংলার সাধকদের জীবনচর্চা থেকে উঠে আসা কথা, গান ও উপদেশের মধ্যে। বাংলা ভাষায় দর্শন চর্চার ধারা গড়ে তুলতে হলে এই ছেঁড়া নাড়ির সঙ্গে আবার যুক্ত হবার পথ আবিষ্কার করতে হবে আমাদের। সেটা দরকারও বটে।

দুই
আমরা আসলে পাশ্চাত্য দর্শনের কয়েকজন মহাজনের চিন্তা নিয়ে লিখব বলে পণ করেছি। আজকের লেখা তার ভূমিকা মাত্র। কিন্তু চেষ্টা থাকবে বাংলাভাষায় ভাবচর্চার ধারার সঙ্গে যখনই সুযোগ মেলে তুলনা করে দেখানো। উদ্দেশ্য হচ্ছে চিন্তার যাঁরা মহাজন তাঁদের সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা নয়। বরং তাদের চিন্তা সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে যাবার অসুবিধা কিছুটা কমিয়ে আনা। দেখা যায় প্রবল ইচ্ছা থাকলেও মহাজনদের চিন্তা ভাবনার ওপর দাঁত বাসানো কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই মুশকিল মোচনের জন্য যে সকল গোড়ার প্রস্তাব ও ধারণা রয়েছে সেই ধারণাগুলো স্পষ্ট করা।

এ আলোচনা থেকে যে ফজিলত আমরা পেতে চাই তার একটা তালিকা করে ফেললে খারাপ হয় না। এতে আমাদের নিষ্ঠাকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের প্রতি সঙ্গতিপূর্ণ করতে আমরা মনোযোগী হতে পারব।

১. এ লেখালিখির উদ্দেশ্য বড় বড় দার্শনিকদের বড় বড় বই পড়তে গিয়ে আমাদের যেন হোঁচট খেতে না হয় তার জন্য বোঝাবুঝির প্রাথমিক জায়গাগুলো খানিক সাফ করে নেবার চেষ্টা। সেই ক্ষেত্রে ভাবুকদের জীবনীও আমাদের কাজে লাগতে পারে।

২. চিন্তার যাঁরা মহাজন তাদের চিন্তার সঙ্গে মোকাবিলা করবার পদ্ধতি যেন এমন হয় যাতে বাংলা ভাষায় আমরা যেভাবে ভাবি, লেখালিখি করি এবং সমাজে ও রাজনীতিতে যেভাবে তৎপর থাকি দর্শন চর্চা ও পঠনপাঠনকেও সেই ভাবাভাবি লেখালিখির তৎপরতার অন্তর্গত করা যায়। দর্শন চর্চা যেন কোন হাওয়াই ব্যাপার না হয়ে ওঠে। চিন্তার চর্চা ও চিন্তাশীলতার দার্শনিক গুরুত্ব শুধু নয়, তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যও আমরা যেন বুঝতে পারি। ফলে আমাদের আলোচনা অনেক সময় বাংলাভাষায় ভাবচর্চার সঙ্গে পাশ্চাত্য কিম্বা অন্য ভাষার দর্শনের তুলনামূলক আলোচনাও হয়ে উঠতে পারে।


৩. প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ইতিহাস এক নয়, এটা সত্যি। ফলে উভয়ের চিন্তা বা দর্শনের ইতিহাসেও পার্থক্য আছে। তাদের প্রশ্ন তুলবার ধরণ আলাদা, এমনকি বিষয়ের আগ্রহের ক্ষেত্রেও পার্থক্য রয়েছে । প্রাচ্য যদি পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট কোন পাশ্চাত্য চিন্তার বিরোধিতা জরুরী মনে করে তাহলে সেই চিন্তাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে বিচার করাই শ্রেয়। কিন্তু মানুষের চিন্তার ইতিহাসকে সামগ্রিক ভাবে যদি আমরা অনুধাবন করতে চাই তাহলে প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের ভেদ ভিন্ন ধরণের দার্শনিক মুশকিল তৈরী করে। শুরুতে আমাদের অনুমান হবে এরকম: যিনি চিন্তা করেন সেই ‘পুরুষ’ সকলের মধ্যে বিরাজ করেন এবং তিনি এক ও অখণ্ড। ইনি বায়োলজিকাল পুরুষ নন। প্রাচ্য/পাশ্চাত্য, সাদা/কালো কিম্বা নারী ও পুরুষের সকলের মধ্যে সেই একই ‘পুরুষ’সক্রিয়। আমরা মানুষ হিসাবে খণ্ড খণ্ড থাকলেও ইনি যেহেতু ‘অখণ্ড’ তাঁর খণ্ড খণ্ড হয়ে থাকা না থাকার মধ্যে কিছুই আসে যায় না।

“খণ্ডিলে খণ্ডন নাহি সেই অখণ্ডন

খণ্ড খণ্ড হয়ে আছএ তেকারণ” (কিম্বা ‘খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তেঁই সে কারণ”)


অর্থাৎ তাঁকে খণ্ডন করা যায় না। আর সেকারণে তিনি খণ্ড খণ্ড হয়েই বিভিন্ন মানুষ হয়ে বিরাজ করেব। এতে তার অখণ্ডত্বের বিলোপ ঘটে না। কঠিন প্রস্তাব। বাংলাভাষার ভাবুক সৈয়দ সুলতানের এই প্রস্তাবটা আমরা এখনকার মতো এভাবে অর্থ করে মেনে নেব। যিনি ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভাবে চিন্তা করছেন তিনিই বাংলাভাষায় চিন্তা করছেন কিনা সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু সেটা সুযোগ ও সময়মতো পরে করা যাবে। আবছা ভাবে এটা ভেবে নিলে দোষ নাই যে সম্ভবত ইম্মেনুয়েল কান্টের নির্লৌকিক আমি বা আমিত্বের (Transcendental I) সঙ্গে কোথাও সৈয়দ সুলতানের ‘পুরুষ’ ধারণার মিল থাকতে পারে। দেখা যাক। আলোচনা আগ্রসর হতে থাকলে আমরা দেখব আমাদের এই অনুমান আদৌ সঠিক কিনা।

আমরা শুরু করব তিনটি বিষয় নিয়ে (ক) মনোবৃত্তি (intentionality); (খ) বৌদ্ধিক উপলব্ধি (Categorical Intuition) এবং (গ) আগামঃ ‘আগাম’ (a priori) । অনুমান হচ্ছে এই তিনটি ধারণা এ কালে যাকে ফেনোমেনলজি বলা হয় তার খেই ধরিয়ে দিতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে বাংলার ভাবচর্চার সঙ্গেও তার মিল ও অমিল বুঝতে সুবিধা হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের পাশ্চাত্য দর্শন পাঠ করতে গেলে হোঁচট খেতে হয়। যে ধারণাগুলো সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ও প্রাথমিক ধারণা থাকলে হোঁচট তীব্র হয় না, সেই ধারণাগুলো নিয়েই আলোচনা চলবে। এখন আগ্রহ জাগাবার জন্য প্রাথমিক কিছু কথা বলে রাখছি।
১. মনোবৃত্তি (intentionality); এর আক্ষরিক অনুবাদ হতে পারত ইচ্ছা বা অভিপ্রায়, কিন্তু তাতে দর্শনে ধারনাটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার সঙ্গে অসঙ্গতি ঘটত। মনোবৃত্তি বললেও মুস্কিল আসান হয় না। দর্শনে ধারণাটি যেভাবে দানা বেঁধেছে বাংলায় তা পুরাপুরি ধারণ করা যায় না। তবে মন্দের ভালো। বাংলায় অভিপ্রায় বলতে আমরা কোন কিছু ইচ্ছা বা বাঞ্ছা করা বুঝি। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে ঠিক সেভাবে ধারণাটি দানা বাঁধে নি। ফ্রানৎস ব্রেনতানো (Frantz Brentano) ও এডমুণ্ড হুসার্লের (Edmund Husserl) হাত হয়ে এই শব্দবন্ধ ও ধারণার আগমন। ফলে এর গায়ে মনস্তাত্ত্বিক আঁচড় রয়ে গিয়েছে। এখানে মনের অভিপ্রায় বা ইচ্ছা নিয়ে কথা হচ্ছে না, কিন্তু তাকে বাদও দেওয়া হয় নি। মনোবৃত্তির মানে হচ্ছে কোন কিছু হাজির বা পেশ করবার জন্য মনের নিবিষ্টতা বা বৃত্তি। সেটা হতে পারে কোন বস্তু, বিষয় বা ধারণা কিম্বা কোন কামনা , বাসনা বা ইচ্ছা, মনে ধারণ, ইত্যাদি।

ফ্রানৎস ব্রেনতানোর দাবি হচ্ছে যে কোন চিত্তবৃত্তি বা মানসিক অবস্থার অর্থ হচ্ছে নিজের মধ্যে কোন না কোন বিষয় ধারণ করা, পেশ করা, তার সঙ্গে বা তার প্রতি সম্বন্ধযুক্ত থাকা, ইত্যাদি। চিত্তবৃত্তি তো এক রকম নয়। তার নানান ধরণ ও স্তর রয়েছে। ব্রেনতানো বস্তু জগতের কোন কিছুর অস্তিত্বের সঙ্গে চিত্তজগতের কোন বিষয়ের অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে চাইছেন। যখন আমরা চিন্তা করি তখন তো চিন্তার ‘বিষয়’ হিসাবে সেটা অস্তিত্বমান, সে ‘বিষয়’ আছে। আমরা যখন কোন কিছু চিন্তা করি তার মানে এই নয় যে বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকতে হবে, কিন্তু যেহেতু তা মনের বৃত্তি হিসাবে আছে সে কারনে তাকে ‘নাই’ বলাও যাচ্ছে না। ব্রেনতানো প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন আমরা যখন বলি যে আমরা চিন্তা করছি, তখন তার মানে দাঁড়ায় আমরা কিছু না কিছু চিন্তা করছি। বিষয়হীন চিন্তা বলে কিছু নাই। বিষয়ও চিন্তার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই বিষয় হয়ে থাকে । হেইডেগারে এসে ধারণাটির ব্যবহার যখন আরও বিকশিত হোল তখন দেখা গেল দৈনন্দিন ইন্দ্রিয়পরায়ন উপলব্ধির (perception) স্বভাব আদতে কেমন সেই দিকগুলো ব্যাখ্যা করবার জন্য হেইডেগার ধারণাটি ব্যবহার করছেন।

২. বৌদ্ধিক উপলব্ধি (Categorical Intuition): আমরা অনুমান করতে পারি যে আমরা যখন কোন কিছু উপলব্ধি করি তখন সেটা করি আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে। তারপর সেই ইন্দ্রিয়োপলব্ধিকে আমরা বুদ্ধির প্রক্রিয়ার অধীন করি এবং তাকে কোন কিছু জানা বা জ্ঞানে রূপান্তর করা হয়। এই অনুমানে ধরে নেওয়া হয় ইন্দ্রিয়োপলব্ধি আর বুদ্ধির দ্বারা জ্ঞান নির্ণয় বুঝি আলাদা দুটো প্রক্রিয়া। আমাদের ইন্দ্রিইয়ের কাজ হচ্ছে উপলব্ধি হিসাবে বুদ্ধিকে কাঁচামাল সরবরাহ করা। আর বুদ্ধি তাকে জ্ঞানে পরিণত করে। বৌদ্ধিক উপলব্ধির ধারণা দেখায় যে আসলে আমাদের বুদ্ধির যেসকল কলকব্জা দিয়ে ইন্দ্রিয়জাত উপলব্ধিকে জ্ঞানে পরিণত করা হয়, তাও আসলে উপলব্ধিরই প্রকার ভেদ। এই ধারণা দিয়ে আমরা সাধারণত ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ও জ্ঞানের স্তরকে যেভাবে আলাদা ভাবতে অভ্যস্ত সেই যান্ত্রিক বিভাজনকে প্রশ্নবোধক করে তোলা হয়েছে। (একই সঙ্গে তা কান্ট এবং হেগেলেরও সমালোচনা)। চিন্তা মানে ইন্দ্রিয়োপলব্ধি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নামক ত্রিস্তর বিশিষ্ট মেশিন নয় যার মধ্যে আমাদের বাইরের জগত থেকে প্রবিষ্ট ইন্দ্রিয়পরায়ন অনুভূতি বা উপলব্ধিকে কারখানার মতো আমরা প্রক্রিয়াজাত করি। আর ওর মধ্য থেকে যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি তৈরি হতে থাকে।

সম্ভবত জগতের সঙ্গে আমরা সবসময়ই এক আগাম উপলব্ধির সম্বন্ধে যুক্ত। দৈহিক বা মানসিক কোন স্তরেই আমরা জগত থেকে আলাদা থাকি না। আমাদের দৈনন্দিনতা এই সম্বন্ধের মধ্যেই অতিবাহত হয়। এই সম্বন্ধের বিচার সে কারনে হেইডেগারের চিন্তার সাম্রাজ্য প্রবেশের চাবির মতো। এই বিষয়গুলো আমরা পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।

৩. আগাম: ‘আগাম’ (a priori) কথাটার আদত মানে কি? এই ধারণার প্রবল প্রয়োগ আমরা দেখি ইম্মেনুয়েল কান্টে। যখন বলি জগতের সঙ্গে আমরা সবস্ময়ই এক আগাম সম্বন্ধে যুক্ত থাকি তখন এই যে আমরা ‘আগাম’ সম্বন্ধ বললাম সেই ক্ষেত্রে ‘আগাম’ কথাটার অর্থ কি? হেইডেগারের দাবি হচ্ছে ‘আগাম’ কথাটা বোঝার অর্থ অন্বেষণ করার মানে ‘সময়’ বলতে আমরা কি বুঝি তার রহস্যও উন্মোচন করা। আগাম মানে কোন কিছু আগেই আছে। কিন্তু উপলব্ধির মধ্যে মূর্ত হবার আগে আগে তাকে আছে বলার মানে কি? প্লাটো থেকে কান্ট কী অর্থে এই ধারণা ব্যবহার করেছেন সেইসব বিচারের বিচারের প্রস্তুতি হিসাবে এই ‘আগাম’ সংক্রান্ত ধারণা পরিচ্ছন্ন করা জরুরী মনে করেছেন।

তিন
চিন্তা কিভাবে চিন্তা করে দর্শন বা ভাবুকতার এ আগ্রহ দীর্ঘদিনের। ‘আপনাকে জান’ এই নির্দেশের পেছনে এই আগ্রহেরই তাড়না ছিল অধিক। মানুষ যখন চিন্তাকে তার নিজের বিশেষ প্রতিভা হিসাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তখন থেকেই তার এই আগ্রহ। প্রশ্ন উঠেছে, নিজেকে জানা আর নিশ্চয় জ্ঞানের জন্য চিন্তার আকুতি কি এক সূত্রে গাঁথা? এর মানে কি নিজের চিন্তাশীলতাকে জানা নাকি চিন্তা ও শরীর উভয় নিয়েই যে ‘মহাজনের পুঁজি’ তাকে জানলেই সেটা সম্পূর্ণ জানা হয়, নইলে না। চিন্তাকে চিন্তা করেই কেন নিশ্চিত হতে হবে সে যা জানছে তা নিশ্চয়জ্ঞান -- আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি? কেন? চিন্তার আগেই তো শরীরসম্পন্ন হয়ে চিন্তা হাজির ছিল। শরীর ছাড়া চিন্তা নামক তো কিছু নাই। তো নিশ্চিত হবার জন্য কেন শারিরীক ভাবে উপস্থিত এই দৃশ্যমান প্রত্যক্ষ শরীরকে প্রমাণ হিশাবে না মেনে চিন্তা করতে পারাকেই কেবল প্রমাণ হিসাবে পাশ্চাত্যে গ্রহণীয় হোল? রেনে দেকার্তের যুক্তি অনুযায়ী?

এক সময় জানা গেল নিজের বাইরে চিন্তার ‘বিষয়’ হিসাবে যে জগত হাজির থাকে সেই জগত চিন্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্বন্ধহীন আলাদা কোন জগত নয়, চিন্তা জগতকে যেভাবে জানে সেই জগতের গঠনে চিন্তা নিজেও ভূমিকা রাখে, নইলে জগত চিন্তায় প্রতিভাত হতে পারে না । একসময় চিন্তা নিজেকে যুগপৎ চিন্তার কর্তা ও প্রক্রিয়া হিসাবে শনাক্ত করবার তাগিদ বোধ করতে শুরু করে। হেগেল চিন্তার সংকট মীমাংসার যে পথ দেখালেন সেটা আবার মার্কসের কাছে গ্রহণযোগ্য হোল না। তার মনে হোল হেগেলের সমাধানটা চিন্তার আবর্তের মধ্যে বন্দী, এটা আসলে সমাধান না। সমাধান হতে হবে বাস্তব জগতে। তিনি চিন্তার কর্তা ও চিন্তার বিষয়ের সম্পর্ককে মানুষের সঙ্গে মানুষের বাইরের জগতের বৈষয়িক সম্পর্ক হিসাবে গণ্য করলেন। এটা জ্ঞানের কর্তা আর জ্ঞানের বিষয়ের সম্পর্ক না, বললেন, এটা উৎপাদন সম্পর্ক।

এতেও কি মীমাংসা হয়েছে? জ্ঞান আর উৎপাদন মধ্যে সম্পর্ক কি? তাদের ফারাক নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? উৎপাদনই কি জ্ঞানের নির্ধারক নাকি জ্ঞান উৎপাদনের সম্পর্ক নির্ণয় করে।? বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের এই তুরীয় যুগে কিভাবে এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে? এই সম্পর্ক নির্ধারণের কর্তা কে? মানুষ নাকি প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া? চিন্তাশীল মানুষ না মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ বৈষয়িক জগত বা জগতের ইতিহাস? ইতিহাসের অধীন থেকেই মানুষ ইতিহাস নির্মাণ করে এই আপ্তবাক্যে কি তার সমাধান হয়েছে?

কোন কিছু চিন্তা করাই আগেই মানুষ জগতের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থাকে। কোন কিছুকে আমরা যখন ‘আছে’ বলি তখন তো চিন্তার আগেই হয়ে থাকা সম্বন্ধের কথাই বলি। নাকি? নিজেকে ‘আছি’ বলার অর্থও তো একই। ‘আমি’ নামক কিছু একটা আগেই হাজির ‘আছে’ বলেই তো তাকে নির্দেশ করে মানুষ বলে, ‘আমি আছি’। এই সম্বন্ধ মানুষের মধ্যে ধরা দেয় কিভাবে?

এই অনতিক্রম্য সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কেন মানুষ মনে করে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক মানুষকে শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবেই নির্ণয় করতে হবে? বুঝি রক্তমাংসের মানুষ প্রকৃতি থেকে কিম্বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সত্তা? বুদ্ধির বাইরের বিষয়। আসলেই। জ্ঞানগত বা বৈষয়িক যেভাবেই দেখি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মানুষের বাইরের বিচ্ছিন্ন গণ্য করা কঠিন। কিন্তু কী এই সম্পর্কের চরিত্র ? সে বুদ্ধির বিষয় না হতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞার তো বিষয়? নাকি প্রজ্ঞারও নয় অন্য কিছুর। তাই কি? তাছাড়া বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার মধ্যেই বা ফারাক কিসের? চিন্তা কি এভাবে বিভিন্ন বিভক্ত বৃত্তি হয়ে কাজ করে? ইন্দ্রিয়োপলব্ধি (Sensuous Perception), বুদ্ধি ( Understanding) আর প্রজ্ঞা (Speculation)?

যে সকল ধর্ম, সংস্কৃতি, চিন্তা বা রাজনীতিকে আযৌক্তিক (irrational) , বুদ্ধিবিবর্জিত বর্বরতা বা সন্ত্রা্স ( senseless violence) কিম্বা বিদ্যমান সভ্যতার জন্য বিপজ্জনক (threat to civilization) মনে করা হয় তাকে বুঝতে হলে পাশ্চাত্য দর্শনের এই ভেতরকার তর্কবিতর্ক বোঝা ও তার পর্যালোচনা খুব জরুরী। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের জন্য যার কোন বিকল্প নাই। এই গোড়ার জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন না করা গেলে বাংলাদেশের চিন্তার বিকাশ ঘটবে না। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা দর্শন কিম্বা রাজনীতি দিক থেকে আদৌ কোন সদর্থক চিহ্নের ইঙ্গিত কিনা সেটাও আমরা এই সকল প্রশ্ন মোকাবিলা না করলে বুঝতে পারব না।

অন্যদিকে পাশ্চাত্যচিন্তার বাইরে বাংলাভাষা ও মুখস্থ সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে ওঠা ভাবান্দোলনের যে-ইতিহাস সেই দিক থেকেও এই সকল তর্কের পর্যালোচনা দরকার। ভাবান্দোলনের ভাষ্য হচ্ছে ভাণ্ড আর ব্রহ্মাণ্ড অভিন্ন, কিন্তু রসের রসিক না হলে যে-সম্বন্ধের মধ্যে এই চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের অভিন্নতা কিম্বা মানুষ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অভেদ বোঝা যায়, তার স্বাদ বা উপলব্ধি ঘটে তার আস্বাদন সম্ভব না। রক্তমাংসের মানুষ সেই সম্বন্ধের চিহ্ন, সেই ঐক্যের দাগ । যাকে বুদ্ধি বা তথাকথিত প্রজ্ঞা দ্বারাও ধরা যায় না, তাকে ধরবার একমাত্র চিহ্নসূত্র হচ্ছে রক্তেমাংসে ‘বর্তমান’ জীবন্ত মানুষ। মানুষই অধর ধরবার সূত্র ( ‘মানুষ অধর ধরার সুতা’)। অতএব মানুষ ভজনাই রসিকের কর্তব্য।

পাশ্চাত্য দর্শন নিয়ে আমাদের আলোচনা এখনকার দর্শনের কিছু ধারণার সঙ্গে আমাদের পরিচিত করবার অন্য শুধু নয়, একই সঙ্গে বাংলার ভাবচর্চার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে সহায়ক হবে আশা করি।

দেখা যাক।
ফরহাদ মজহার
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৫:০৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×