somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলেহো কার্পেন্তিয়ের

২৪ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লাতিন আমেরিকায় সাহিত্যে "রিয়ালিসমো মাহিকো " বা জাদু- বাস্তবতার অন্যতম প্রবক্তার নাম "আলেহো কার্পেন্তিয়ের" । ১৯৩১ সালে স্প্যানিশ ভাষায় রচিত "একুয়ে-ইয়াম্বা-ও" (হোক প্রভুর প্রশংসা ) উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে "আলেহো কার্পেন্তিয়ের" এর আবির্ভাব । ১৯০২ সালে কার্পেন্তিয়েরের ফরাসী বাবা ও রুশ বংশদ্ভূত মা চলে আসেন কিউবাতে, আলেহোর জন্মের ঠিক দু বছর আগে। স্পেনীয় উপনিবেশের হাত ছাড়িয়ে কিউবা তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে । কিউবার কালো মানুষদের জাদু- আবহে ডুব দিয়ে আফ্র-কিউবান সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের লেখনীর মাধ্যমে । তিনি একজন উপন্যাসিকই নন একজন সঙ্গীততত্ত্ববিদ - স্বয়ং সঙ্গীত রচনা করেছেন , লিখেছেন কিউবার সংগীতের ইতিহাস । তাঁর লেখা "লা মুজিকা এন কুবা" (কিউবার সংগীত - ১৯৫৬) এখন সমগ্র লাতিন আমেরিকায় একটি মৌলিক গ্রন্থের মর্যাদা পায় ।


কিউবাকে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক করে তোলার স্বপ্ন ছিল বলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন । কিউবার ১৯২৩ এর বিদ্রোহী প্রজন্মের সক্রিয় কর্মী ছিলেন কার্পেন্তিয়ের । ১৯২৩ -এর প্রজন্ম চেয়েছিল কিউবার জাতীয় সংস্কৃতিকে ব্যাবহার করে বিপ্লব ঘটাবে । তাদের লক্ষ্য ছিল একনায়ক হেরারদো মাচাদোর অপসারণ। এই সময় তিনি একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে "লা দিসকুসিয়ন" পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতে থাকেন এবং এ কারনে ১৯২৮ সালে তাঁকে জেলে যেতে হয়। ১৯৩৩ সালে গনঅভ্যুথানের কারনে একনায়ক মাচদো বাহামাসে পালিয়ে গেলে কিউবার ক্ষমতা চোলে যায় মার্কিন মদদপুস্ট আরেক স্বৈরশাসক "বাতিস্তার" হাতে । ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রো , চে দের নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কিউবায় মার্কিন মদদপুস্ট স্বৈরতন্ত্রই বহমান ছিল ।



ফিদেইল ও কার্পেন্তিয়ের

১৯২৮ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যান এবং প্যারিসে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে গুয়েতমালার উপন্যাসিক আস্তুরিয়াসের সাথে, পরে যিনি প্রথম লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৬৭ তে । পরিচয় হয়েছিল চিলির কবি, পরবর্তীকালের আর এক বিখ্যাত নোবেল জয়ী পাবলো নেরুদার সঙ্গে । প্যারিস থেকে কার্পেন্তিয়ের প্রায়ই আসতেন মাদ্রিদে, সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত কবি গার্সিয়া লোরকার । ১৯৩৯ এ কিউবার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয় দেশে ফিরে কার্পেন্তিয়ের আবার কিছু কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেন । কিন্তু বাতিস্তা সরকারের স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তাঁর ওপর আক্রমণ নামে এবং তিনি এবার দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশান্তরী হতে বাধ্য হন ভেনেজুয়েলাতে । ১৯৪৫ থেকে কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবা বিপ্লবের সময় (১৯৫৯) পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন । এই দেশান্তরেই লেখা হয় তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘এল রেইনো দেল এস্তে মুনদো’ (এই পৃথিবীর রাজত্ব ১৯৪৯ )। ফরাসী উপনিবেশ হাইতির আফ্রিকান ক্রীতদাস বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস লিখতে গিয়ে কার্পেন্তিয়ের ধারনা দিলেন লাতিন সাহিত্যের এক নতুন ধারার "লো রিয়াল মারাবিয়োসো" অর্থাৎ "আশ্চর্য সুন্দর বাস্তব" । ঐতিহাসিক পটভূমিতে বাস্তব এবং কল্পনার মিলনে যুদ্ধ , বিদ্রোহ এবং প্রেমের কাহিনী ।

অনেকের মতে আলেহো কার্পেন্তিয়ের এর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসের নাম "লোস পাশোশ পেরদিদোস" ( হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ - ১৯৫৩)। হারিয়ে যাওয়া পদক্ষেপ পড়ার পর মনে হতে পারে তিনি স্পর্শ করতে চেয়েছেন লাতিন আমেরিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্টির মেলবন্ধন । "মিথ" ও ইতিহাস একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন । এই গ্রন্থে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সভ্যতা এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রসঙ্গ এসেছে ।

"গেররা দেল তেইমপো" (সময়ের যুদ্ধ -১৯৫৮) তিনটি গল্পের সংকলন । এই গল্প গুলোতে জাদু-বাস্তবতার এক জটিল জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একই সালে প্রকাশিত আরেকটি উপন্যাসের নাম "এল আকোসো" ( পিছু ধাওয়া) । এই উপন্যাসে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন একনায়ক "মাচাদো" এর রাজত্বে তৎকালীন কিউবা থেকে একজন নিরীহ ও সচ্ছল মানুষের শরণার্থী হওয়ার করুন কাহিনী ।

১৯৬২ সালে লেখা উপন্যাস "এল সিগলো দে লাস লুসেস" ( আলোর শতাব্দী ) আন্তিঈয়াস অঞ্চল (মানে ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহৎ দ্বীপগুলির একটি দলকে বোঝায়, যার মধ্যে কিউবা ,পুয়ের্তো রিকো, জামাইকা , হাইতি , ডোমেনিকান রিপাব্লিক) এ ফরাসি বিব্লবের প্রভাব নিয়ে লেখা কাহিনী ।

পরবর্তী উপন্যাসের শিরোনাম "এল দেরেচো দে আসিলো" ( আশ্রয়ের অধিকার ১৯৭২) । সত্তরের দশকে স্প্যানিশ আমেরিকার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস , উল্লেখনীয় বিষয় হল এই যে , সেই সময়ের বিশিষ্ট লেখকগণ এই বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন যার মধ্যে গাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেস অন্যতম ।

"কনসারতো বারোকো" (ব্যারোক কন্সার্ট- ১৯৭৪) লিরিক আর সংগীতময়তায় প্রাণবন্ত এক সংক্ষিপ্ত উপন্যাস । "লা কনসাগ্রাসিওন দে লা প্রিমাভেরা" ( বসন্তের আরাধনা - ১৯৭৮) কিউবার বিপ্লব নিয়ে লেখা কাহিনী ।

উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ সংকলন যেমন "লাতিন আমেরিকার সাহিত্য এবং রাজনৈতিক বিবেক (১৯৬৯) , "শহর ও স্তম্ভ" (১৯৭০) , বিবিধ প্রবন্ধ (১৯৮৩) যা কিউবা ও লাতিন আমেরিকার সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করে । বাংলায় পাঠকদের কাছে আলেহো কার্পেন্তিয়ের জনপ্রিয়, বিখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনুদিত তাঁর "এল সিএরবো এরিদো " ( মৃগয়া ) উপন্যাসটির জন্যে । এই উপন্যাসটি পঞ্চাশের দশকে কিউবার স্বেচ্ছাচারী একনায়কদের রাজত্বের চালচিত্র ।

১৯৬০ এবং ১৯৭০ সালের দুই দশকব্যাপী লাতিন আমেরিকার গদ্য-সাহিত্যে অনন্য সম্রাট ছিলেন আলেহো কার্পেন্তিয়ের ।

কার্পেন্তিয়ের ১৯৮০ সালে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন এবং কিউবার রাজধানী হাভানার কোলন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:১৫
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×