
এ উপন্যাস দারিদ্র্যের লাঠিপেটায় আহত মানুষদের নিয়েই। দেশ ভাগের গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে যখন ভারতবর্ষের হাটে-ঘাটে-মাঠে—সে সময়কার আঁচ, মানুষের অবিরাম দুর্দশা আর আসলে দেশে স্বাধীনতা এলো কী এলোনা—এর আলাদা বিশেষ গুরুত্ব যে দেশের অতি সাধারণ, হতদরিদ্র মানুষগুলোর জীবনে তেমন নেই—চৈতালী-ঘূর্ণি হয়তো সে গল্পও।
আখ্যানভাগ মূলত দুটি পর্বে বর্ণিত হয়েছে। প্রথম অংশে গ্রামের এক হতদরিদ্র দম্পতি গোষ্ঠ ও দামিনী, দামিনীর শৈশবের খেলার সাথী সুবল, গোষ্ঠ'র বোন সাতু এদের নিয়ে। এককালে অবস্থাপন্ন গেরস্থ গোষ্ঠ'র বর্তমান আর্থিক অনটনের পাশাপাশি মানব-মানবীর সম্পর্কের যে সাইকোলজিকাল ব্রেকডাউন, সেটির খুব মর্মস্পর্শি অথচ সূক্ষ্য চিত্রণ দেখে অবাক হতে হয়। পাশাপাশি আছে দামিনীর প্রতি নিশ্চুপ মুখরতায় ডুবে থাকা সুবলের বিচিত্র প্রেম, সে একলা নিঃসঙ্গ বাউল-ফকির সুতরাং অর্থের অভাব তার নেই—তার একমাত্র অভাব দামিনী। সুবলের প্রেমে নিঃসীম ঘৃণা ও আগ্রহ আর স্বামীর প্রতি সৎ ও অসীম ভালবাসা নিয়ে দামিনীর এ মস্তাত্বিক টানা-পোড়েন পাঠককে বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করে।
জীবনের টানে এক ঝড়ের রাতে সব ফেলে শহরে চলে আসা গোষ্ঠ, দামিনী আর সুবল'কে নিয়েই শুরু হয় উপন্যাসের চুড়ান্ত পর্ব। এখানে এসে জীবিকার তাগিদে এরা ভিড়ে যায় কলের শ্রমিকদের সাথে—দিন-মজুরদের শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা, তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কিংবা অমানবিক পরিশ্রমের পাশাপাশি তাদের হল্লাময় জীবনের জীবন্ত চিত্র এ পর্বে দেখা যায়—আর আসলে কী হঠাৎ শুরু হওয়া সংগ্রামে সফলতা আসে? নাকি চৈত্রে বিষণ্ণ ধুধু বালোয়াড়ি মাঠে যে ক্ষণস্থায়ি ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, তা বাস্তবেও কঠিন বৈশাখী ঝড়ের আলামত হিসেবে ঝনঝন আওয়াজ তোলে?
দৃশ্য কিংবা চরিত্র, দুটো অংকনেই তারাশঙ্করের ম্যাজিকাল কলমে মুগ্ধতা জেগেছে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে—যদিও প্রথম পর্বে গল্পটি কোথাও কোথাও ধীরগতির মনে হয়েছে—কখনও মনে হয়েছে এই হয়তো কেমন একই বস্তু ঘুরছে বনবন; কিন্তু ২য় পর্ব যেমন হঠাৎ হাজির হয়, পাঠক চিরকালের জন্যই যেন মিশে যায় এ আখ্যানে—গল্প লাভ করে দূর্দান্ত গতী তখন মনে হয় জীবন তো এমনি, স্লো মোশন আর ফার্স্ট মোশনের সমন্বয়। নতুন কোন গল্প নিজের প্রথম উপন্যাসে লেখক বলেননি—নতুন যা ছিল তার চিন্তার গভীরতা, গল্প বলবার ঢং আর দার্শনিক সব উপলব্ধি। কিছু লাইন তুলে দেয়া যাক বরং:
'বাঁচলে দেবতার পূজা দেয়; না বাঁচলে বলে, পাথর, পাথর, দেবতা-ফেবতা সব মিছে কথা।'
'ভগবানকে ওরা মানে কী মানেনা, তা আজ এক অমিমাংসিত সমস্যা।'
'এখন অভাবের মাঝে কেবল অতীত প্রাচুর্য্যের স্মৃতিই একমাত্র সম্বল'
'মনের গতি মানুষের বাঁকা, প্রীতি ও পিরিতের মাঝে ভেদ করা বড় কঠিন।'
'চৈতালীর ক্ষীন ঘূর্ণি অগ্রদূত কাল-বৈশাখির।'
___________________________________________
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ২:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




