৩ তারিখ সকাল ৭ টার মাঝেই সবাই ঘুম থেকে উঠে পরলাম। দীর্ঘ জার্নি পড়ে আছে সামনে। সাদেক ভাই এর রান্না ততক্ষণে প্রায় শেষ। উঠে দেখি হাত পায়ের গিঁটে গিঁটে ব্যাথা। কিছু করার নেই আজকেই কেওক্রাডং পৌঁছাতে হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ৮ টার মাঝেই বের হয়ে গেলাম সবাই, গন্তব্য থাইখং।
সকালটা মোটামুটি ঝিরিপথ ধরেই হাঁটতে হয়েছিল। আমাদের অনভিজ্ঞতার কারণে সাদেক ভাই সোজাসুজি পাহাড় না টপকে ঝিরি ধরে আনে আমাদের। তার কথা অনুযায়ী উনি নিজেও এই রাস্তায় আসে নাই। পাহাড় দেখে দিক ঠিক রেখে আমাদের নিয়ে গিয়েছে। তবে এবারের ঝিরিপথ আগের যে কোন ঝিরির চেয়ে বাজে। পথে অনেক জায়গাতেই নদী পার হতে হল পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিছু কিছু পাথর এত পিচ্ছিল যে পড়ে গেলে হাত পা ভাঙ্গারও ভয় আছে। ঝিরি হলেও গতি তাই কিছুটা কম ছিল। ঝিরির শেষাংশ ছিল জঘন্য বাজে, টারজান এর মত লতায় ঝুলতেও হয়েছে দুএক জায়গা পার হওয়ার জন্য। সঠিক মনে করতে না পারলেও প্রায় ২.৫-৩ ঘণ্টা পর আমরা থাইখং এর গোড়ায় হাজির হলাম।
ঝিরিপথ
শুরু হল আমাদের ওঠা, থাইখং হয়ে কেওক্রাডং পৌঁছাতে হবে আজকের মাঝে। থাইখং এ যাওয়ার ট্রেইলটা আমিয়াখুম এর মত বাজে না হলেও খুব ভালও ছিল না। একটা জায়গায় প্রায় ৮০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে হালকা বাঁক খেয়ে উঠে গিয়েছিল। প্রায় দৌড়ে উঠেছিলাম ওই জায়গাটা, এরপর থেকেই ভাল রাস্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছি, অন্তত ভয় পেতে হয়নি শারীরিক কষ্ট হলেও। সূর্য ইতিমধ্যে মাথার উপরে উঠে গেছে, গরমে অবস্থা আরও কাহিল হবার জোগাড়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম কিছুক্ষণ হাঁটা এভাবেই চলতে চলতে একটা ছাউনি পেয়ে সবাই বসলাম সেখানে ছায়া পেয়ে। সৌভাগ্যক্রমে ওখান দিয়ে তখন একটা আদার গাড়ি যাচ্ছিল। ওরা আমাদের থাইখং এর গোরস্থানে নামিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। মোটামুটি ঘণ্টা খানেকের পথ তো অন্তত কমবে। আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। এইবার দুর্ভাগ্যক্রমে ৩০ সেকেন্ড অতিবাহিত হবার পূর্বেই গাড়ির ইঞ্জিন থেমে গেল। গাড়ির ইঞ্জিন এ সমস্যা ছিল। আদার সাথে অতিরিক্ত প্রায় ৭০০ কেজি ওজন নেয়া গাড়ির পক্ষে সম্ভব না। বাধ্য হয়ে গোমড়ামুখে সবাই আবার হাঁটা শুরু করলাম।
আমাদের বিশ্রামের একটি মুহূর্ত
আদার গাড়ি
দুপুর নাগাদ থাইখং পাড়ার গোরস্থানে পৌঁছালাম। সেখানে টেলিটক এর নেটওয়ার্ক আছে। সবাই একে একে বাসায় ফোন করে জানালাম সবাই সুস্থ আছি। প্রায় পাঁচ দিন নেটওয়ার্ক এর বাইরে ছিলাম। সবার বাসাতেই চিন্তায় অস্থির, সেই চিন্তায় আমরাও কিছুটা অস্থির। ফোন করতে পেরে হাঁটার গতিও বেড়ে গেল কিছুটা। মনে খানিকটা ফুরফুরে ভাব এসে গিয়েছিল ।
কেওক্রাডং যাওয়ার পথে
কেওক্রাডং সরাসরি বেশ কাছে মনে হলেও একটা পাহাড়ের রেঞ্জ ধরে প্রায় সার্কেলে ঘুরে সেখানে পৌঁছাতে হবে। এই হাঁটা যেন শেষ হওয়ার নয়, হাঁটছি তো হাঁটছি, হাঁটা আর শেষ হয় না। এর মাঝে আবার আমাদের খাবার পানি সব শেষ। পিপাসায় সবার অবস্থাই কাহিল। মাঝে মাঝে চরাই উৎরাই পার হতে হচ্ছে, প্রায় অভ্যাস বশেই হাঁটছিলাম তখন। শেষ দুই আড়াই ঘণ্টা ব্যাক্তিগত ভাবে আমার কোন অনুভুতিই ছিল না, সব ভোঁতা হয়ে গেছে। কেনান পাড়া অথবা পাসিং পাড়ার আগের তিনটা সাইন কার্ভের কথা এখনও মনে পড়ে অবশ্য। ওখানে বেশ কষ্ট হয়েছিল।
কেনান পাড়া
পাসিং পাড়া
অবশেষে সন্ধ্যার একটু আগে আগে কেওক্রাডং পোঁছালাম। তখনকার অনুভূতি ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। ৫ দিনের কষ্ট কিছু সময়ের জন্য সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। যে পাহাড় গুলি এতদিন জ্বালিয়েছে সেগুলোকে পায়ের নিচে দেখা সত্যিই একটি অসাধারণ অনুভূতি। অনুমান করি বগালেক দিয়ে ঢুকলে হয়ত এই অনুভূতি পেতাম না।
কেওক্রাডং এর পিকে
ইহা আমি
যার কথা না বললেই না আমাদের গাইড সাদেক ভাই
রাত কাটালাম কেওক্রাডং এর কটেজে। দু দিন পর আরামের একটা ঘুম হয়েছিল, জন প্রতি তিনটা করে কম্বল পেয়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে ফেললাম প্রায় সাথে সাথেই। একেকজন মোটামুটি গলা পর্যন্ত খেলাম। খাওয়ার শেষ দিকে হঠাৎ দেখি আরেক ট্যুরিস্ট দল হাজির। পরিচিত হতে গিয়ে দেখি এরাও ভার্সিটির জুনিয়র। ওরা এসেছে জাদিপাই থেকে। এবার যাওয়ার সুযোগ না হলেও পরেরবার আশা করি মিস হবে না।
পরবর্তী পর্বে থাকছে বগালেক হয়ে বান্দরবান শহর ফেরা।
পূর্ববর্তী পর্ব সমূহের লিঙ্ক
প্রথম পর্বঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link
তৃতীয় পর্বঃ Click This Link
চতুর্থ পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:০৫