১০০ বছর আগে আমেরিকানদের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের যে আস্থা ছিল তা আজ ফিকে হতে শুরু করছে
১৯১৬ সালে আমেরিকা সফরে বলেছিলেন
জাতীয়তাবাদ এক ভয়ংকর জিনিস; এই চেতনা মানুষে মানুষে দেশে দেশে বিভেদের দেয়াল তুলে দেয়। তিনি সাবধান করে বলেছিলেন, দেশপ্রেমের নামে যারা নৈতিকতার আইন বিস্মৃত হয়, একসময় তারা সহিংসতার আগুনে নিজেরাই জ্বলেপুড়ে মরবে
ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন যে আমেরিকার ছবি আঁকতে চাইছেন, তাতে ‘সবার আগে আমেরিকা’, ‘সবকিছুর আগে আমেরিকা’। এই জাতীয়তাবাদী আমেরিকায় শুধু তারা, অর্থাৎ এ দেশের খ্রিষ্টধর্মী সাদা মানুষেরা সৎ, কর্মঠ ও মহৎ। অন্য সবাই, বিশেষত অ-শ্বেতকায় বহিরাগত—তারা মেক্সিকো থেকে আসা বাদামি মানুষ অথবা মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসা ভিন্নধর্মী যা-ই হোক, এ দেশের মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। তাদের ঠেকাতে হবে, সে জন্য দরকার পড়লে দক্ষিণের সঙ্গে শক্ত প্রাচীর তুলে দাও। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিমদের আগমন নিষিদ্ধ করো; যারা ইতিমধ্যে এসে পড়েছে, তাদের ঘাড় ধরে বের করে দাও।
শুধু আমেরিকায় নয়, ‘অন্যের’ প্রতি এই ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান, এখন ইউরোপের অনেক দেশেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে
সর্বত্রই এই আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ও নিম্নবিত্ত শ্রমিক এবং কর্মজীবীরা, যারা একসময় আওয়াজ তুলেছিল ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও।’ আজ তারাই বলেছে বিদেশি খেদাও, নিজের ঘর আগে সামাল দাও।
আসলে যা সহজে বোঝা যায় না
এই জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার পেছনে রয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। গত দুই দশকে তথাকথিত বিশ্বায়নের ফলে একদিকে একদল লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ, যারা দু-দশ বছর আগেও ভদ্রগোছের জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল—তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। একদিকে ১ শতাংশ ধনিক গোষ্ঠী, অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া ৯৯ শতাংশ। এই দৃশ্য শুধু আমেরিকায় নয়, অধিকাংশ শিল্পোন্নত দেশে। যেখানে একসময় অর্থনীতির প্রাণশক্তি ছিল উৎপাদন খাত, এখন তার স্থান দখল করেছে নতুন ‘আর্থিক’ বা ফিন্যান্স খাত। কোনো কিছু না বানিয়ে, গায়ে-গতরে কাজ না করে অন্যের পয়সা এদিক-সেদিক করে মুনাফার বিশাল পাহাড় গড়ে তুলেছে একদল লোক।
এই ১ শতাংশই অধিক মুনাফার লোভে নিজ দেশের কলকারখানা তুলে নিয়ে বসাচ্ছে সস্তা শ্রমিক পাওয়া যায় এমন সব দেশে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমেরিকায় শিল্পশ্রমিকের জায়গায় গত আড়াই দশকে ৯৮ শতাংশ নতুন কর্ম সৃষ্টি হয়েছে এমন সব খাতে, যেখানে চাকরির জন্য কোনো বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেতন মেলে সরকারের বেঁধে দেওয়া ঘণ্টাপ্রতি ন্যূনতম হারে। এই সময়ে এক চীনে তৈরি সামগ্রীর ওপর নির্ভরতার কারণে আমেরিকায় খোয়া গেছে প্রায় ৩২ লাখ চাকরি। এর জন্য কাউকে দোষ দিতে হবে, ফলে তর্জনী উঠেছে বিদেশিদের বিরুদ্ধে। তারাই হয়ে উঠেছে আসল শত্রু।
আমেরিকায় সে রকম জাত্যভিমানের পুনরুত্থান ঘটাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু সাদা মানুষদের শাসন কায়েম করতে চাইছেন। আমরা বনাম ওরা। যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অশনিসংকেত ১০০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গিয়েছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করছেন। ট্রাম্পের কথায়, আমরা এখন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, যখন কেউ আমাদের সম্মান করে না
এই অনন্যতা ও অপরিহার্যতার দোহাই দিয়ে বুশ গং ইরাক আক্রমণ করে পুরো মধ্যপ্রাচ্য লন্ডভন্ড করেছে। ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে সেই অপরিহার্যতার ভূমিকা কম নয়। সাদা মানুষদের ক্ষোভের কারণে যে নয়া জাতীয়তাবাদ এখন পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে, রাজনীতিকদের কূটচালে তার প্রকাশ ঘটছে কালো বা বাদামি মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে। কিন্তু বিশ্বায়নের শিকার তো শুধু সাদা মানুষ নয়, কালো ও বাদামি মানুষেরাও। তা সত্ত্বেও সাদারা এখন নিজেদের আক্রান্ত ভাবছে, কারণ নিজেদের অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতেই তারা অভ্যস্ত। পরিহাসের বিষয় হলো, যারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী, তারাও সাদা মানুষ, যাদের একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:০৮