হেফাজতে শয়তান এন্ড কিস মাই....-১
ইহুদীদের তোরাহ এর প্রথম চ্যাপ্টারের তালমুদ অনুসারে ইসরাইলের ব্যুৎপত্তিকাল থেকে রাজা সলোমনের দ্বারা জেরুজালেমে প্রথম উপসনালয়ের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনের সময়কাল পর্যন্ত প্রতি বছরের নির্দিস্ট একটা দিনে সবাই নিজেদের পাপমুক্তির জন্য পাপশুদ্ধির দিন পালন করতেন। প্রথম দিকে এই দিনে ইহুদীদের প্রধান র্যাবাই বা যাজক একটা ষাড় জবাই করতেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। এর মূল লক্ষ্য ছিলো অনিচ্ছাকৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তার হাদিয়া স্বরূপ এই ষাড়ের কোরবানী ঈশ্বরের প্রতি। পরে ক্যানানরা ইসরাইল দখল করলে রীতিতে পরিবর্তন আসে। জুরুস্থ্রু সহ অন্যান্য ধর্মের প্রভাবে একটা ষাড়ের বদলে দুটো কাছাকাছি আকৃতি ও গড়নের ছাগল বেছে নেয়া হয়। একটি ছাগলকে ধরে নিয়ে উপসনালয়ের মেঝেতে কোরবানী দিয়ে তার রক্ত বেদীতে ছিটিয়ে দেয়া হতো। কারন হলো ইসরাইলবাসীর যত অনিচ্ছাকৃত পাপ আছে সেটার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা। এসময় র্যাবাই তাদের সেই পাপের কনফেসন করতো। আরেকটা ছাগলের শিং অর্ধেক কেটে তাতে লাল রিবনের কাপড় বেধে মরুভূমির মাঝেখানে ছেড়ে দিতো আজাজিলের উদ্দেশ্যে। তালমুদ অনুসারে আজাজিল ছিলো বহিস্কৃত ফেরেশতা যাকে কিনা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করার কারনে স্বর্গচ্যুত করা হয়।
আজাজিলের বিচ্যুতির ঘটনাটা গ্রীক মিথলজীতে থাকা প্রমেথিউসের ঘটনার সাথে অনেকাংশে মিলে যায়। আদি সময়ে পঙ্কিল পৃথিবীতে প্রকৃতির বৈরী পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে মানবজাতী নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটে খাবি খেতো। তা দেখে আজাজিলের মন নরম হয়, মানবজাতিকে আগুন এবং লোহার ব্যাবহার সম্পর্কে ধারনা দেয়। ধারনা দেয় কাপড়ের বুনন কিভাবে সম্ভব। এর ফলে মর্ত্যের মানুষেরা লোহা দিয়া অস্ত্র বানিয়ে শিকারে নেমে প্রোটিনের উৎস বুনোমাংসের স্বাদ পায় এবং আগুনে পুড়িয়ে নিজেদের ক্ষুধা মেটায়। বিনা অনুমতিতে এ কাজ করায় ঈশ্বর ইয়াহওয়ে (ইহুদীদের ঈশ্বর) তাতে রুস্ট হন। আজাজিলকে স্বর্গচ্যুত করে এবং তারপর থেকেই সে মরুভূমির অজানা স্থানে বাস করতে থাকে। দ্বিতীয় ছাগলটিকে আজাজিলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেবার কারন হলো তারা তাদের পাপসমূহ ঐ ছাগলের ঘাড়ে চাপিয়ে আজাজিলের কাছে পাঠিয়ে দেয়া। যদি ছাগলটা মরবার আগে লাল রিবন সাদা হয়ে যায় তাহলে ধরে নেয়া হতো তারা তাদের পাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে।
খ্রিস্টানদের বাইবেলে মিথটা একটু অন্যভাবে বিবর্তিত হয়েছ। এখানে আজাজিলের জায়গায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তিকে ব্যাবহার করা হয়। এবং প্রথম ছাগলটিকে উৎসর্গ করার কারন হিসেবে তাদের পাপের কারনে যে সামাজিক দূষন, অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে মুক্তির জন্য আর দ্বিতীয়টিকে ধরা হয় পাপের বোঝা হিসেবে। এই দ্বিতীয় ছাগলটিকেই স্কেপগোট বা বলির পাঠা বলা হয়।
ধর্মীয় এসব মিথগুলো একটা একটার উন্নততর সংস্করন হলেও প্রায় সব ধর্মেই বলির পাঠা ব্যাপারটা বিদ্যমান।
যুক্তিবিদ্যাতে ঠিক এরকমই এক অপযুক্তি বা ফ্যালাসি আছে যার নাম স্কেপগোট ফ্যালাসী বা বলির পাঠা অপযুক্তি (এর নামকরন অন্যকিছু হতে পারে প্রচলিত দেশী যুক্তিবিদ্যায়। যেহেতু আমি যুক্তিবিদ্যার ছাত্র ছিলাম না সেহেতু যদি কারো জানা থাকে ঠিক করে দেবেন)। তর্কের খাতিরে কোনো অপকর্ম বা দুর্ভাগ্যজনক বা অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য ভিক্টিমকে অভিযুক্ত করাকেই স্কেপগোট অপব্যাখ্যা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। উদাহরন হিসেবে বলা যায় রাস্তায় কালো বিড়াল দেখার পর যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে এর দোষ কালোবিড়ালের। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে কালোবিড়ালের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই তবুও কালো বিড়ালটাকেই বলির পাঠা বানানো হবে।
আবার ধরা যাক একটা মেয়েকে ধর্ষন করা হলো। স্বভাবতই ধর্ষক দোষী এবং সে শাস্তি পাবার উপযোগী কিন্তু একশ্রেনীর মানুষ মেয়েটির দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে মেয়েটির কাপড় বা তার চালচলনের দোষ। এই স্কেপগোট ফ্যালাসীর একমাত্র কারন ব্যাক্তিবিশেষের অপরাধকে হাল্কা করা অথবা স্বার্থ উদ্ধার করা।
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা সবাই জানি শরীয়া আইন দ্বারা পরিচালিত আরব সহ মিডল ঈস্টে ধর্ষনের হার কতটা জঘন্য এবং রাস্ট্রিয় ভাবে কিভাবে ধর্ষনে প্রশ্রয় দেয়া হয়। এছাড়া দেশের পত্র পত্রিকায় হরদম শোনা যায় মাদ্রাসা ছাত্রীর ধর্ষনের শিকার এবং মাদ্রাসাগুলোতে শিশু ধর্ষনের হার দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। এর প্রধান কারন কিন্তু পোশাক না, দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং মানুষের নৈতিক অবক্ষয়।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি এজন্য বলবো আজ পর্যন্ত কখনো শোনা যায়নি মাদ্রাসাতে শিশু ধর্ষনের কারনে ওমুক হুজুরের এত বছরের জেল। আমরা শুধু গ্রেফতার ও চাকুরিচ্যুতি এবং মব জাস্টিস হিসেবে সালিশের কথা শুনি। তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এছাড়া আমাদের বিচারব্যাবস্থা যে কতটা দুর্বল তা নীচের ছবিটা দেখলেই পরিস্কার হয়ে যায়।
ছবির স্পস্ট রেজুলেশন চাইলে এখানে ক্লিক করুন
এরকম দুর্বল বিচারব্যাবস্থা নিয়ে এত বড় জনগোষ্ঠিকে কিভাবে ন্যায়বিচার দেয়া সম্ভব সেটাও ভাবার বিষয়।
আবার অনেকেই বলেন মৃত্যুদন্ডের বিধান করলেই ল্যাঠা চুকে যায়।এই যুক্তিটাকে আমরা আরগুমেন্টাম এ্যাড ইগনোরানটিয়াম বা আপিল টু ইগনোরেন্স বা অজ্ঞতার স হায়ক ফ্যালাসী বা অপযুক্তির সাথে তুলনা করতে পারি। এই অপযুক্তি বা ফ্যালাসী অনুসারে তর্কের খাতিরে আপনি এমন একটা তথ্য পেশ করলেন যেটা সঠিক নয়।
মৃত্যুদন্ডের সাথে অপরাধের হারের সমানুপাতিক সম্পর্ক খুজতে গিয়ে ডর্টমুন্ড ইউনিভার্সিটির একটা পেপারে চোখ বুলাতে পারি। পেপারটা কোয়ালিটিটিভ এবং কোয়ান্টিটিভ মেথডে লেখা হয়েছে। যদিও বইটি মৃত্যদন্ডের সাথে হত্যার হারের সম্পর্ক দেখানোর চেস্টা করা হয়েছে আদতে পুরো বইটি পড়লে একটা উপসংহারই ধরা দেয় বিচারিক মৃত্যদন্ড কখনোই হত্যার মতো অপরাধ ঠেকাতে পারে না বরংচ বাড়িয়ে দেয়। ৭০-৮০ এর দশকে জাস্টিস প্রোগ্রাম ডিপার্টম্যান্ট সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পায় যে মৃত্যুদন্ড ধর্ষনরোধে খুব সামান্যই ভূমিকা রাখে এবং তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো ৫০ ভাগ ধর্ষনের বিচারের আসামীর কোনো সাজা হয় না। এ্যামনেস্টির এই পেপারটিও একটা বড় প্রমান যে মৃত্যুদন্ড কখনোই কোনো অপরাধ কমানোতে ভূমিকা রাখে না এবং কেন রাখে না সেটাও বিস্তারিত আলোচনা করেছে তারা।
সেদিন বিবিসি বাংলাতে একটা খবর আসলো বাংলাদেশে ধর্ষনের বিচার খুব কম হয়। ২০০১ হতে ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় সাড়েচার হাজার ধর্ষনের কেসের বিপরীতে মাত্র ৪৭টার সাজা হয়েছে। আর এত কম সাজা হবের কারন উপরের ছবিতে আমাদের বিচারব্যাবস্থার তুলনামূলক অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারবেন। তার ওপর ধর্ষনের বিচার চাইতে গেলে ধর্ষিতাকে কি পরিমান লাঞ্চনার শিকার হতে হয় তা পাবেন এই আর্টিক্যালে।
প্রশ্ন আসতে পারে যেসব দেশে ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড সেসব দেশের কি অবস্থা। এই লিংকে মৃত্যুদন্ড ও হত্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত পরিসংখ্যানের ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে দেখানো হয়েছে। খোদ আমেরিকার স্টেট বাই স্টেট অর্থাৎ যেসব স্টেটে মৃত্যুদন্ড নাই আর যেসব স্টেটে আছে সেখানকার কি অবস্থা সেটাও সচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ভারতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চালু হবার পরও ধর্ষনের মহামারী এতটুকু কমেনি। তার চেয়ে বড় কথা এই যে ইসলামী শরীয়া মতে চলা সৌদী আরব সেখানে বাংলাদেশী গৃহকর্মীদেরকে ধর্ষন হচ্ছে তার কতটার বিচার ওরা করেছে কারো কাছে তার কোনো পরিসংখ্যান পর্যন্ত রাখতে দেয়নি।
তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারি ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিলেই ধর্ষন কমবে না। মৃত্যুদন্ড বা লিঙ্গ কর্তনের মতো মবজাস্টিসের দাবী পক্ষে যারা যুক্তি দেখান সেটা চোখ বন্ধ করে আপিল টু ইগনোরেন্স ফ্যালাসীর মধ্যেই ফেলে দেয়া যায়।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে বাইবেলে ব্যাভিচারের শাস্তি মৃত্যুদন্ড, ইসলামে হদ দিয়ে তথাকথিত মৃত্যুদন্ড আছে তাহলে সেটা কি ভুল? উত্তর হিসেবে যদি এসব পরিসংখ্যান সাথে গবেষনামূলক আর্টিক্যাল পেশ করেন ফ্যাক্ট হিসেবে তাহলে বলা হবে সেহেতু এসব ধর্মগ্রন্থে লেখা তাই সত্য তখন এটাকে সরাসরি সারকুলার রিজনিং ফ্যালাসী বলা চলে।
উদাহরন হিসেবে বলা চলে বাইবেল একটা সত্য ধর্মগ্রন্থ কারন বাইবেলেই তা বলা আছে। এই অপব্যাখ্যা সহসাই হতবুদ্ধ করে ফেলবে যুক্তিপ্রদানকারীর কমনসেন্স দেখে।
এত কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম শফি হুজুর মেয়েরা যাতে ব্যাভিচারে যুক্ত না হয় তাই তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মাদ্রাসাতে পাঠানো উচিত বলে ওয়াজে বলে বেড়াচ্ছেন এবং সবাইকে ওয়াদাও করাচ্ছেন। তার সাথে এটাও বলেছেন বাংলাদেশের নারীরা নাকি ন গ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করেন যার কারনে ধর্ষনের পরিমান বেড়ে গেছে।
মেয়েরা স্কুলে গেলেই ব্যাভিচারে যুক্ত হবে এই অপব্যাখ্যাকে ফল্স ডাইলেমা মানে মিথ্যা উভয়সংকট অপব্যাখ্যা। স্কুলে ব্যাভিচার হয় এটা কেউ কল্পনা করতে পারে না। স্কুল বিদ্যা অর্জনের জায়গা, এবং স্কুলে ক্লাস চলাকালীন বা তার ফাকে ধর্ষন হবার খবর এখনো আমরা জানি না। যদি দুয়েকটা ঘটনা ঘটেই থাকে সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। আর যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না ধরি তাহলে মাদ্রাসার ধর্ষন, মসজিদে ধর্ষন এবং হজ্বের সময় যে নিগ্রহের ঘটনা ঘটে সেগুলোও আমলে নেয়া উচিত। এবং হ্জ্ব এর সময় যে ধর্ষন এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে সেটার ওপরও হ্যাশট্যাগ চালু আছে #MosqueMeToo।
আমাদের এসব সিলেক্টিভ কথা বা এ নিয়ে ইস্যু সৃষ্টি বা কুতর্ক করার একটাই উদ্দেশ্য আমরা নারীদেরকে দমিয়ে রাখতে চাই। যেখানে উন্নত বিশ্বের নারীরা সর্বক্ষেত্রে তাদের মেধা ও মননের ছাপ রাখছে সেখানে শফি হুজুরের মতো খারাপ এবং জঙ্গি মতাদর্শের অনুসারীরা কি ষড়যন্ত্র করছে সেটা ভাবলেই গা শিওড়ে ওঠে ।