পর্নোগ্রাফির প্রয়োগ
সাম্প্রতিক বাংলা ছবির (২০০০-২০০৬) অন্য কিছু না হোক 'অশ্লীলতা' নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা শোনা যায়। কিন্তু এর স্বরূপ কী, সেসম্পর্কে এসব ছবির গুটিকয়েক দর্শক ছাড়া অন্য কারও কোনো ধারণা নেই। 'মডারেট মুসলিম' - এর সার্টিফিকেট প্রাপ্ত এই দেশে কি কল্পনা করা যায় যে এদেশের ছবিতে পুরুষ দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য নারীর সমকামিতা প্রদর্শিত হয়? তাই আগেই বলা হয়েছে এসব ছবিকে কেবল 'অশ্লীল' ছবি বলে ডাকলে এতে উপস্থিত আধেয়সমূহের যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। কারণ সংজ্ঞাভেদে, মাত্রাভেদে অশ্লীলতার কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। যৌনতাসংশ্লিষ্ট নয় এরকম অনেক কিছুকেই অশ্লীল মনে হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে 'পর্নোগ্রাফি' শব্দটা বেশি প্রযোজ্য হবে। সাধারণত পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের প্রধান অবলম্বন হলো গান। গানগুলোর ভাষাতে সরাসরি যে কদর্যতা ফুটে ওঠে, সেটি দর্শকপ্রিয় বলে দাবি করা হয়। অথচ, সাধারণ মানুষের নিজস্ব নির্মাণ লোকসঙ্গীতে কিন্তু এধরনের কদর্যতা অনুপস্থিত। ছবিগুলোর সংলাপও বিকৃত যৌনতা প্রকাশক ইঙ্গিত, স্ল্যাং, এবং খিস্তিতে পরিপূর্ণ।
রঙ্গীন চশমা ছবিটির কথাই ধরা যাক। ৭টি গান ছবিটিতে রয়েছে, প্রচলিত গানের পুনর্ব্যবহার রয়েছে, রয়েছে নকল সুর। গানগুলোর কোনোটিই মৌলিকভাবে লিখিত বা সুরারোপিত নয়। কিন্তু প্রতিটি গানই ভীষণ কদর্য। নায়িকাদের বৃষ্টিতে-ভেজা-স্বল্পবাস, উত্তেজক অঙ্গসমূহের ভালগার ভঙ্গি, সমকামিতার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত গানগুলোতে দেখা গেছে। ভিলেনের দুই সহকারী এবং দুই নায়িকা কেউই যৌনতা প্রদর্শনে পিছিয়ে ছিল না। একটি গানে ভিলেন তার দুই সহচরীর সঙ্গে নাচছে-গাইছে। এক পর্যায়ে ভিলেন বলছে 'দিসনা আমায় মাইনকা চিপা রে'। ভিস্যুয়ালে দেখা গেলো দুই সহচরী দুই দিক থেকে তাদের স্তন দিয়ে ভিলেনের মুখমণ্ডল চেপে ধরছে। ছবির বিরতির পর অযাচিতভাবে এক দৃশ্যে এক পুরুষ নারী-সাজে মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকে পড়ে, হোস্টেলের রুমে নারীযুগল প্রকাশ্যে চুমু খায় এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রসদৃশ এক নারী তা দেখে উত্তেজিত হয়ে ছদ্মবেশী পুরুষকে চুমু খায়। নারীরূপী পুরুষ পোশাকের বাইরে থেকে তার স্তনমর্দনও করে। হোস্টেলের এই দৃশ্যটির মূল ছবির সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। একে কাটপিসই বলতে হবে। ভিলেন যেভাবে বেশিরভাগ সময়ে খালি গায়ে, তলপেট অনাবৃত করে পর্দায় দৃষ্টিপীড়া দিয়েছেন, বস্ত্রহীন দরিদ্র দর্শকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ সেটির লক্ষ ছিলনা, বলাই বাহুল্য।
বিদ্রোহী সালাউদ্দিন ছবির কাহিনী বা সংলাপে পর্নোগ্রাফিক উপাদান না থাকলেও গানের চিত্রায়ণ তা থেকে মুক্তি পায়নি। তিনজন ভিলেন তিন নর্তকীর সঙ্গে যেভাবে নাচ ও অঙ্গভঙ্গি করে এবং শরীরের বিভিন্ন অনাবৃত অঙ্গ ক্যামেরার সামনে হাত দিয়ে চেপে তুলে ধরে, নিজের চোখে না দেখলে এর ভয়াবহ কদর্যতা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। আরেকটি গানে দু'জন নর্তকী, স্তন প্রায়-উন্মেচিত, স্বচ্ছ পোশাকে নৃত্য করে। নৃত্যের মুদ্রায় ছিল শশা ও কলা ব্যবহার করে বিষমকামী যৌনইঙ্গিতমূলক চোষণ ও ঘর্ষণ, স্বমেহন ও সমকামী আচরণ। 'অসৎ' পুলিশ অফিসারের সঙ্গে নাচিয়ে মেয়েদের আচরণে যূথ-যৌনতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আরেক দৃশ্যে মূল নায়ক-নায়িকাও কম্বলের নিচে শয্যাদৃশ্যে অংশ নেন, সাউন্ড-ইফেক্টে কম্বলের নিচে কী হচ্ছে তা বোঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। আরো মুশকিল হলো, এই দৃশ্যগুলো সংযোজন করা হয়েছে কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতি না রেখেই।
বাঘের বাচ্চা ছবি থেকে সংলাপে কীভাবে অযৌক্তিক কদর্যতা উপস্থিত হয় তার নিদর্শন দেওয়া হলো। বস্তিবাসী তরুণের সাইকেল পাম্প করে একজন তরুণী, তারা এভাবে কথা বলে:
যুবক: আখেরি জামানা এখন, নাইলে মাইয়া মানুষে পাম্প করে?
যুবতী: করলে কী হয়?
যুবক: সিস্টেম নাই। পাম্প করনের কাম পুরুষ মানুষের। তাগো আলগা পাম্পারের কোনো দরকার হয় না। পুরুষ মানুষের পাম্পার লগেই থাকে।
যুবতী: কও কী?
যুবক: আরে এই সকাল বেলায় আমি তরে মিছা কতা কমু?
যুবতী: তোমার লগে আছে?
যুবক: আছে না!
যুবতী: দেখাও তো।
সন্ত্রাসীরা বস্তি দখল করতে আসলে তাদের সংলাপে ছেদ পড়ে। ছবিটিতে এই তরুণ-তরুণী মোট চারবার দেখা করে। প্রত্যেকবারই পাম্পার-সংক্রান্ত আলাপ হয়। তরুণী কিছুতেই যৌন ইঙ্গিতটি বুঝতে পারে না বলে এই দু'জনের সংলাপ কিছু দৃশ্যের পর পর, ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। এমনকি তরুণী তার বাবাকেও তার পাম্পার দেখাতে বলে। এক দৃশ্যে যুবকটি পাম্পারের বিষয়টি অঙ্গভঙ্গি করে দেখায়। এরপরও তরুণী কিছুই বুঝতে পারে না। আরেক দৃশ্যে যুবক তাই প্যান্ট খুলে পাম্পার দেখাতে উদ্যত হয়, তরুণীর বাবা তাকে তাড়া করে এবং কদর্য প্রসঙ্গের অবসান ঘটে। বাঘের বাচ্চা ছবির পার্শ্ব নায়ক-নায়িকার গানের দৃশ্যেও সফট পর্নোগ্রাফিক উপাদান প্রদর্শিত হয়েছে। শুধু এই তিনটি ছবিতে নয়, সার্বিকভাবে ২০০০-২০০৬ সময়কালের বাংলা ছবিগুলোতে পর্নোগ্রাফির যে ধরন দেখা যায়, তা নিম্নরূপ:
সফট পর্নো, কুশীলব ছবির নায়ক-নায়িকা
সিনেমার মূল নায়ক-নায়িকা যদি রিয়াজ, মান্না, ফেরদৌস কিংবা মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমার মতো নামী কেউ হন, তবে তারা সাধারণত কোনো খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করেন না। কিন্তু একই ছবিতে যদি শাহীন আলম, আলেকজান্ডার বো, মেহেদী কিংবা ময়ূরী, পলি, শানু, ঝুমকা, নাসরীনের মতো নায়ক-নায়িকা থাকেন, যারা সাধারণত দ্বিতীয় নায়ক-নায়িকা হয়ে থাকেন, তারা স্বল্পবাসে, পানিতে ভিজে, পার্কে, সমুদ্রতটে যে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন তাতে এধরনের যৌনদৃশ্য থাকে, যাকে সফট্ পর্নো বলা যায়।
সফট পর্নো, কুশীলব ভিলেন-সহচর
প্রায় প্রতিটি ছবিতে ভিলেনের আস্তানায় একটি 'আইটেম গান' থাকে যেটি কয়েকজন সহনৃত্যশিল্পীর সঙ্গে একজন 'আইটেম গার্ল' নেচে ও গেয়ে থাকেন। মূল ভিলেন আরব্যোপন্যাসের চরিত্রের মতো সুরা পান করেন এবং সাকীর রূপ-যৌবন উপভোগ করেন। কখনো কখনো তিনি নিজেই মাঠে নেমে ঐ নর্তকীর সঙ্গে যৌনাত্মক অঙ্গভঙ্গির প্রতিযোগিতায় নামেন।
তবে মূল ভিলেনের আরও যে সহযোগীরা থাকেন, তাদের মধ্যে একজন হতে পারেন নায়কের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী কোনো বন্ধু, আরেকজন হতে পারেন অসৎ পুলিশ অফিসার -- এরা কাহিনীর ধারাবাহিকতা (আদৌ যদি কিছু থাকে) ভঙ্গ করে হঠাৎ নর্তকীদের সঙ্গে গানের দৃশ্যে নাচতে থাকে। এই নর্তকীদের পোশাক খুবই সংক্ষিপ্ত এবং খুবই স্বচ্ছ হয়ে থাকে। এই নর্তকীদের সঙ্গে পুলিশ অফিসাররা পোশাক-পরিহিত অবস্থায়ই সকল প্রকারের যৌনভঙ্গি করে থাকেন, যা বিষম, বিকৃত এবং যূথ -- সবধরণের যৌনতার ধারণা দেয়। এসব গানের দৃশ্যে নর্তকীরা প্রায়শই আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদির মাধ্যমে সমকামী আচরণ প্রকাশ করে থাকে। আবার কোনো কোনো গান থাকতে পারে কেবলই যৌন-উপাদান হিসেবে, যেখানে নাচিয়ে মেয়েরা সমকামী আচরণ করে অথবা স্বমেহনের নানা কলাকৌশল দেখায়।
পর্নোগ্রাফি, কাটপিস সমাচার
বাংলা-সিনেমার সাম্প্রতিক আলোচনায় 'কাটপিস' শব্দটি খুব পরিচিতি হয়ে উঠেছে। এটি ছবির যেকোনো পর্যায়ে দেখানো হতে পারে, সাধারণত মাঝামাঝি, বিরতির আগে বা পরে এটি দেখানো হয়ে থাকে। অনেকসময় এটি একটি গানের দৃশ্য হয়ে থাকে, তবে স্নানের দৃশ্যও হতে পারে, এমনকি সঙ্গমের দৃশ্যও হতে পারে। এসব কাটপিসের পাত্র-পাত্রী এদেশীয়, এগুলো শুটিং ও এডিটিং-এর কাজ এফডিসিতেই হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো এগুলোর প্রিন্ট আবার মূল ছবির চাইতে ভালো হয়ে থাকে। অর্থাৎ টেকনিশিয়ানরা এই কাজটি বেশ যত্ন নিয়ে করে থাকেন। গান বা স্নানের দৃশ্যে নারীর অনাবৃত উর্ধাঙ্গের বা নিতম্বের দেখা মেলে, সমকামী বা বিষমকামী দৃশ্যে যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত পোশাকে চুম্বন ও যৌনক্রিয়া সমার্থক আচরণ করা হয়। তবে কোনো কোনো কাটপিসে সঙ্গমের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে এমনকি নারী-পুরুষের যৌনাঙ্গও দেখানো হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ কাটপিসগুলো প্রায়ই হার্ডের সীমা ছুঁয়ে বা অতিক্রম করে যাওয়া সফট পর্নো ।
গান, অশ্লীলতার অবলম্বন
গান হলো পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের প্রধান অবলম্বন। গানগুলোর টেক্সটই অশ্লীল হতে পারে। আবার কোনো গানের টেক্সট যদি আপাতভাবে হৃদয়-মন সংক্রান্তও হয়, তার দৃশ্যায়নে ব্যাপারটা প্রায় পুরোপুরিই শরীর-সংক্রান্ত হয়ে দাঁড়ায়। রঙ্গীন চশমা ছবিতে নায়ক ওস্তাদ জাহাঙ্গীর বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে নিয়ে রঙিন চশমা চোখে দিতেই সে দেখতে পায় বিজ্ঞানীর বোন সুজানা (ক্রাইম রিপোর্টার) বৃষ্টির মধ্যে নাচছে ও গান গাচ্ছে: 'যায় যায় অন্তর আমার পুড়ে যায়, পিরীতের আগুনে'। তার গান ও অনাবৃত অঙ্গের নৃত্যভঙ্গি দেখে মনে হয় আগুন তার মনে নয়, শরীরে লেগেছে। সে আগুন নেভাতে পরিচালকের পক্ষ থেকে গানের দৃশ্যায়নে বৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাঘের বাচ্চা ছবির একটি আইটেম-গানের ভাষা এরকম:
আমার যৌবন দেবো কেমন করে
এ জওয়ানী দেখো উথলে পড়ে
আমায় জলদি বুকে টেনে নেনা
ধরেছি আমি যে বায়না
দেনা মিটিয়ে দেনা।
কিংবা একই ছবির অন্য গানের ভাষা আরও অপরিশীলিত:
ধাক্কা মারো, ধাক্কা মারো, ধাক্কা মারো ডানে বামে
ভালোবাসার ধাক্কা মারো প্রেমেরই ময়দানে
খেলবো খেলা পাক্কা রে, মারবো জোরে ধাক্কা রে
সুখেরও ভাগ নেবো দু’জন সমানে সমানে।
অশ্লীলতা বা পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে দর্শক টানার মরিয়া চেষ্টা করছে প্রযোজক-পরিচালকরা, কারণ তাদের নিম্নমানের ছবিগুলোতে দর্শককে ধরে রাখার কোনো উপাদান অবশিষ্ট নেই। কিন্তু প্রাপ্তবয়ষ্ক-সনদবিহীন এইসব ছবি যে-কজন দর্শকই দেখুক, তা বারো বছরের কিশোর বা বাহান্ন বছরের প্রৌঢ়, যিনিই হন না কেন, তার ওপরে একটা প্রভাব পড়েই। এবং এই প্রভাব কেবল নগ্ন ছবি দেখে ধর্ষণোদ্যত হবার মতো সরল আশঙ্কার বিষয় নয়। এর সঙ্গে অন্যকিছু জড়িত। রুথ ওয়ালসগ্রোভ মনে করেন:
এরকম কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যে পর্নো সরাসরিভাবে ধর্ষণের কারণ হয়েছে, এবং এমন হতে পারে এক্ষেত্রে কোনো কার্যকারণসূত্র নেই। কিন্তু তা মনোভঙ্গির সঙ্গে জড়িত। পর্নোর দৃশ্য ও পর্নোদ্ভূত মনোভঙ্গি উভয়েরই নারী ও যৌনতার প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে -- উভয়েই নারীকে মানুষ না ভেবে যৌনবস্তু ভাবতে চায় (এলিস উদ্ধৃত, ১৯৯২: ১৫১)।
ভ্যালেরি মাইনার-এর মতে, 'পর্নোগ্রাফি যতটা না যৌনতার প্রকাশ তার চাইতে বেশি করে [পুরুষের] ক্ষমতার চর্চা' (স্টার্ন উদ্ধৃত, ১৯৯২: ১৯৯)।
একসময় মনে করা হতো পর্নোগ্রাফি কেবলই যৌনকর্মের খোলামেলা উপস্থাপন, এমনকি নারীরাও পর্নোগ্রাফি থেকে যৌনতাকে আস্বাদন করতে পারেন, তাকে কেবল পুরুষ-ভয়ারের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করতে হবে।
কিন্তু অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক মনে করেন, পর্নোগ্রাফি কেবলই পুরুষদর্শকের জন্য নির্মিত যৌনকর্মের প্রদর্শনী নয়। এর সঙ্গে লৈঙ্গিক সম্পর্কের বিষয় জড়িত রয়েছে, রয়েছে ক্ষমতা-প্রশ্নও। লরা কিপনিস-এর মতে পর্নোগ্রাফি প্রতিষ্ঠা করে, 'পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং নারীর অধস্তনতা ও পীড়নের ধারাবাহিকতা' (কিপনিস, ১৯৯৮: ১৫৩)। তাই বাংলা ছবিতে অশ্লীলতা বা পর্নোগ্রাফিকে কেবল সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধের দৃষ্টিতে দেখলে চলছে না। এর জেন্ডার-পরিপ্রেক্ষিতটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
তবে তৃতীয় তরঙ্গের ও উত্তরাধুনিক নারীবাদীদের একটি অংশ পর্নোগ্রাফিবিরোধী নন; তারা মনে করেন, পর্নোগ্রাফি দেখা ও তাতে অংশ নেয়া একজন নারীর ব্যক্তিগত রুচি ও অধিকারের মধ্যে পড়ে, পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক বিধিনিষেধ দিয়ে তাকে আটকানো যাবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত পর্নোবিরোধী নারীবাদীদের দাবিই শক্তিশালী। বাংলা সিনেমার পর্নোগ্রাফ নিয়ে প্রবল আপত্তি পেশ করতে হচ্ছে কয়েকটি কারণে:
প্রথমত, সহিংসতা ও পর্নোগ্রাফি -- এটাই সিনে-ইন্ডাস্ট্রির শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ ছবির বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে। এটিই প্রধান জঁরা, পর্নোগ্রাফি আলাদা জঁরা হিসেবে আসছে না। তাই ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক রুচি ও মানের বিচারে সব ছবিতে অপরিহার্য সহিংসতা ও অশ্লীলতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, সেন্সরবোর্ডকে সামলে কিংবা পরবর্তী সময়ে কাটপিস জুড়ে দিয়ে, যেভাবেই হোক না কেন, এধরনের ছবিগুলো দৃশ্যগুলো থাকছে এবং জনপ্রদর্শন (Public Screening) আকারে সেগুলো প্রেক্ষাগৃহে চলছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্নোগ্রাফি দেখা একটি ভিন্ন বিষয়, কিন্তু জনপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব, নীতিনির্ধারণের প্রশ্নটি চলে আসে।
তৃতীয়ত, আমাদের জরিপে আমরা দেখেছি মফস্বলের প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু-কিশোর। যেহেতু ছবিগুলোর কোনো রেটিং থাকছে না, তাই শিশু-কিশোরদের এই ছবিগুলো দেখা থেকে নিবৃত করার কোনো উপায় নেই।
চতুর্থত, পর্নোগ্রাফি দর্শন নারীর জন্যও কোন সুবিধা বয়ে আনতে পারে কিনা, সে প্রশ্নটি এখানে অবান্তর। কেননা, এই নির্মাণটির দর্শক হিসেবে জনপরিসরে নারী আদপেই আর অংশগ্রহণ করছেন না বা করতে পারছেন না। এই বিষয়ে দর্শক হিসেবে আস্বাদন, সমর্থন বা বিতর্ক করবার মতো পরিসরই নারীর নেই।
চলবে...
চিত্র: রঙ্গীন চশমা ছবিতে যৌনাবেদন সৃষ্টিতে শানুর কসরত।
দ্রষ্টব্য: গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হক প্রণীত 'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প: সঙ্কটে জনসংস্কৃতি' (শ্রাবণ, ২০০৮) গ্রন্থে এই ধারাবাহিকটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।