১৩ আগস্ট, বলাকা প্রেক্ষাগৃহ
অনন্ত জলিল (এজে)-এর নতুন ছবি ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’ দেখতে গিয়ে বহুদিন বাদে পুরনো দৃশ্যমালা দেখতে পেলাম। অনেকগুলো সিকোয়েন্স মিলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রই যেন। সাড়ে তিনটায় ছবির প্রদর্শনী শুরু, আমি সোয়া দুইটায় গিয়ে বলাকার গেটেই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। কারণ লম্বা লাইন। সেই লাইন আবার অজগরের মতো বলাকা চত্বরেই কুণ্ডলী পাকিয়েছে, মূল রাস্তায় নামেনি। অনেকক্ষণ পরে সর্পিল কায়দায় লাইনটা এগুতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে বুঝলাম আমি রেয়ার স্টলের লাইনে। দৌড় দিয়ে ডিসির লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডিসির কাউন্টারের শাটার ফেলে দেয়া হলো। রেয়ার স্টলের লাইনে ফিরে এলাম। চলচ্চিত্র গবেষক-সহকর্মী গীতি আপাকে ফোনে বললাম, ডিসি শেষ, রেয়ার স্টলে ছবি দেখতে হবে আপনাকে। তিনি ছারপোকা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন, কিন্তু দেখে ফেলার সিদ্ধান্তই দিলেন। রেয়ার স্টলের লাইনের কাছাকাছি এবার কয়েকজন ‘ডিসি’ ‘ডিসি’, ‘ডিসি’ … আওয়াজ দেয়া শুরু করলেন। বাংলা ছবির টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রি হচ্ছে? দাম দেখলাম ডাবল হাঁকাচ্ছেন তারা। লাইনে যখন আছি, শেষ দেখি, ভাবি আমি। দেখলাম এবং দুটো টিকেট পেলাম, ডব্লিউ সারির। সন্দেহ হলো এ বোধহয় ভালো আসনের টিকেট নয়। টিকেট পেয়ে বলাকা চত্বরের এক কোণায় ছায়াবীথিতলে এসে দাঁড়ালাম। বলাকা চত্বর পুরোটা লোকে লোকারণ্য। বয়সে সবাই তরুণ, এদের কাছে নিজেকে প্রবীণ মনে হলো; গীতি আপার নিজেকে কী মনে হবে তাই ভাবছিলাম। বন্ধুবান্ধববান্ধবী গ্রুপ করে এসেছে। এরা সবাই কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া, অনুমান করা যায়। সপরিবারে মানুষ এসেছে খুব কম। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী দর্শক।
কিছুক্ষণ পরেই দেখি ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ বোর্ড ঝুলছে। ডিসির বন্ধ কাউন্টারের শাটারে কয়েকবার আঘাত করলো কে যেন। শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত গার্ডের হুইসেলও শোনা গেল। একটা সরগরম-হুলুস্থূল পরিবেশ। ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ বোর্ডের পাশেই ব্ল্যাকার তার টিকেট বিক্রি করছে। বলাকায় বহুদিন ধরেই ছবি দেখছি। অনন্ত জলিলেরই ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ দেখেছি এখানে। এরকম দৃশ্য ছোটবেলায় এলাকার সিনেমাহলে দেখেছি, বলাকায় দেখিনি। কোনো টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রি হয় তখনই, যখন ছবিটির চাহিদা থাকে। গীতি আপা চলে এলেন সোয়া তিনটায়। ভেতরে গিয়ে দেখি আমাদের সিট নিচে ব্যালকনিতে নয়, ফ্রন্ট স্টলের চতুর্থ লাইনের একেবারে ডান দিকে। একে একে ভরে গেল সব সিট। বহু বছর পর ঘাড়ের পেছনে মাথা ফেলে থার্ড ক্লাসে ছবি দেখলাম। হলভর্তি দর্শক মহামুডে ছিল। পর্দায় প্রথম আলো পড়লো, একটা বিজ্ঞাপনের, দর্শক তা দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো। এরপর ছবি শুরু হলো। পরের আড়াই ঘণ্টা দর্শক অনেক কলরব করলো। ছবি কেমন হলো, কী দেখলাম, সে আলাপ অন্যত্র হবে। কিন্তু ছবি দেখার আগে সেই চেনা দৃশ্য দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল — লাইনে দাড়িয়ে টিকেটের জন্য ধস্তাধস্তি, অল্পক্ষণের মধ্যেই ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ সাইনবোর্ড ঝোলানো, টিকেটের জন্য হাহাকার, ব্ল্যাকে টিকেট বিক্রি, গার্ডদের তৎপরতা, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী দর্শক — প্রেক্ষাগৃহে বাংলা সিনেমার জন্য এই দৃশ্যই তো স্বাভাবিক ছিল একসময়।