somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: তিন নম্বর বেড

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনির মতো চলে এসেছে। এটা অ্যানেসথেসিয়ার ফলাফল কি না সেটাও বুঝতে পারছি না। যাইহোক, অনুভূতিটা মন্দ নয়। মাঝে মাঝে সবকিছু স্লো-মোশন ছবির মতো চলছে, আবার মাঝে মাঝে ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ সুরুজ ভাই বললেন, এই পটকা, এদিকে আয়। তিন নম্বর বেডে শুয়ে পড়।

সুরুজ ভাই হলেন ডেন্টিস্ট, মহল্লার বড়ো ভাই। আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাঁর চেম্বারে এলে নিজের ছোট ভাই’র মতোই দেখেন। তাঁর চেম্বারটা অবশ্য অন্যান্য চেম্বার থেকে কিঞ্চিত আলাদা। সারি সারি করে চারটা বেড সাজানো, প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা ইন্সট্রুমেন্ট রাখা। পাশাপাশি আরেক সারিতে কয়েকটা চেয়ার রাখা। সেগুলোর একটাতে বসেই ঝিমুচ্ছি। তাঁর আন্ডারে দু’তিনজন বিডিএস ডাক্তার থাকলেও প্রত্যেক রোগীর প্রতি তাঁর নিজের নজরদারী করা চাই। ফলে আমার মতো কেউ কেউ বসে ঝিমায়, আবার কেউ কেউ ব্যথায় কাতড়াতে কাতড়াতে দাঁতে দাঁত চেপে সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করে। সুরুজ ভাই একটা এসিস্ট্যান্টকে ডেকে আমার দিকে ইশারা করে বললেন, সোলায়মান, লোকাল দিয়েছিস কতক্ষণ আগে?
- স্যার, বিশ মিনিট হবে। আবার দিবো?
ব্যাটা বলে কী! মিনিট বিশেক আগে ডান গালের ভেতরের মাংসে যে লোকাল অ্যানিস্থিশিয়া দিয়েছে তার যন্ত্রণায় তো কূল পাচ্ছি না! গাল নাড়াতে পারছি না। সুরুজ ভাই বাঁচিয়ে দিলেন, বললেন, থাক, লাগবে না। তুই ট্রে রেডি কর।
আমি গুটি গুটি পায়ে তিন নম্বর বেডে গিয়ে শুলাম। এটাকে বেড না বলে আসলে চেয়ার বললেই ভালো হয়। আশে পাশে অনেক সুইচ, ইচ্ছে মতো দেহের বিভিন্ন অংশ ওঠানামা করা যায়, মাথার ওপর অপারেশন থিয়েটার স্টাইলের একটা লাইটও আছে। পাশের ট্রেতে নানান কিসিমের যন্ত্রপাতি। রুট ক্যানেল করার সময় দাঁতের রুট খোঁচানোর জন্য বিভিন্ন মাপের খোঁচানো কাঠি দেখা যাচ্ছে। সেবার একটা দাঁতে রুট ক্যানেল করানো হয়েছিল। উফ! রুট ক্যানেলের সময় যখন দাঁতের ভেতরে বারবার খোঁচাচ্ছিলেন, তখন কী যে একটা অমানুষিক আনন্দ হচ্ছিলো বলে বোঝানো যাবে না। যে পরিমাণ ব্যথা নিয়ে ডেন্টিস্টের কাছে এসেছিলাম, মনে হচ্ছিলো সে ব্যথাটাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাড়াচ্ছে!

কতক্ষণ তিন নম্বর বেডে পড়ে রইলাম জানি না। ঝিমুনিটা আরো গাঢ় হচ্ছিলো। এর মাঝে কখন যেন সোলায়মান এসে বুকের ওপর একটা ন্যাপকিন বিছিয়ে সেটার ওপর কিছু যন্ত্রপাতি রেখে গেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ মনে হলো খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে, নিদেন পক্ষে গুনগুন করে একটা গান গাওয়া দরকার। গুনগুন করলাম কিন্তু কোনো আওয়াজ হলো না। সুরুজ ভাইকে ডাক দিলাম, কিন্তু এবারো আওয়াজ বের হলো না। সন্দেহ হলো, তাহলে কি লোকাল বেশি দিয়ে ফেলেছে যে ঠিক মতো ঠোঁট নাড়াতে পারছি না! ভুল করে কয়েক ফোঁটা গলায় চলে যায়নি তো আবার! অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো! গিনিপিগ গিনিপিগ মনে হলো নিজেকে। ঠিক এসময় সুরুজ ভাই এসে পড়লেন। পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে মাথার পাশে কোণাকুনিভাবে বসলেন। সোলায়মানও যেন কোত্থেকে উদয় হলো। একটা ইউশেপ চিকন পাইপ মুখের একপাশে ঢুকিয়ে দিলো। সুরুজভাই বললেন, ভাইয়া মুখ হাঁ কর।
বড়ো একটা হাঁ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কতখানি বড়ো হলো বুঝতে পারলাম না। মাথার উপর অপারেশন লাইটটা জ্বালিয়ে দিলেন, তারপর নামিয়ে আনলেন মাথার কাছাকাছি। এ অভিজ্ঞতা নতুন না, কাজেই ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে কপালটা খুব চুলকাতে ইচ্ছা হলো। মনে হলো, এখনি না চুলকালে মারা যাবো। সমস্যা হলো, এই মুহূর্তে এমন কিছুই করা যাবে না। হাত দুইটাই ন্যাপকিনের নিচে, পাশাপাশি সুরুজ ভাই এখন কাজ শুরু করেছেন। কাজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এখন চুলকানো যাবে না, আরেকটু পরে নিশ্চয় সুযোগ পাবো! এই জাতীয় সমস্যাগুলো খুবই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আসে। যেমন, যখন খুব মনোযোগ দিয়ে ডান হাত দিয়ে কিছু একটা লিখছি ঠিক তখনি বামহাতের কব্জিতে মশা এসে বসবে। মশা বসেছে, দেখেছি কিন্তু তাড়াতে পারছি না। আবার লেখায় মনোযোগ দেবো ঠিক তখনি মশাটা কামড়াবে। শুধু কামড়িয়েই উড়ে যাবে তা নয়, কামড়িয়ে সে বসেই থাকবে, রক্ত খেতে থাকবে না মারা পর্যন্ত। তখন যদি মশার উপস্থিতিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ উপেক্ষা করা যায় তাহলে রক্ত খেতে খেতে ঢোল হয়ে ফুলে সেখানেই পড়ে থাকবে। আমি আপাতত নিজেকে বোঝাতে থাকি, একটু পরেই সুরুজ ভাই সরে যাবে, তখন একটা সুযোগ নেবো কপাল চুলকানোর। কপাল চুলকানোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা আরকি।

সুরুজ ভাই বললেন, সবসময় দাঁতের অবস্থা খারাপ করে তোরা তারপর ডাক্তারের কাছে আসিস। এমন একটা সময় আসিস যখন আমার কিছু করার থাকে না।
কিছু একটা বলা দরকার কিন্তু কিছু বললাম না। তিনি বললেন, ঠিক করে বলতো কোন দাঁতটায় ব্যথা?
অনেক শক্তি সঞ্চয় করে মৃদু স্বরে বললাম, নিচের পাটির ডানদিকে।
উনি বললেন, উম হু। তোর নিচের পাটির দাঁত তো ঠিকই আছে। সমস্যা তো উপরের পাটিতে। শোন, অনেক সময় এমনটা হয়। উপরের দাঁতের সমস্যা কিন্তু ব্যথা মনে হয় নিচের দাঁতে।
কিছু বললাম না। উনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন। কিন্তু ব্যথাটা সত্যিই নিচের পাটির দাঁতে। সুরুজ ভাই হুকের মতো কিছু একটা বস্তু দিয়ে নিচের পাটির দাঁতে টাং টাং করে বাড়ি মারলেন। বললেন, লাগে?
লাগে, তবে সহ্য করা যায়। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
উনি মুচকি হাসলেন। তারপর উপরের পাটির একটা দাঁতে টাং টাং করে বাড়ি মারলেন। এবার ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। উনি বললেন, নিচের পাটিতে যে জোড়ে মেরেছি, উপরে তার অর্ধেকও মারিনি। বুচ্ছিস এইবার, ব্যথা কোন দাঁতে?
আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। এই সামান্য বিষয়টা বোঝানোর জন্য এতো জোড়ে না মারলেও পারতেন। যাইহোক, এবার নিশ্চয় ট্রিটমেন্ট শুরু করবেন।

সুরুজ ভাই ট্রিটমেন্ট শুরু করলেনও। আমি বিরাট একটা মুখ হাঁ করে চুপচাপ শুয়ে আছি। আর উনি ইচ্ছামতো দাঁত খুঁচিয়ে যাচ্ছেন। খানিকক্ষণ পরে বললেন, তোর তো ছয় নাম্বার দাঁতের অবস্থা ভালো না। অবশ্য রুট ক্যানেল লাগবে না, একটা ফিলিং দিলেই হবে। ভালো ফিলিং আছে আমার কাছে, কয়েক বছর ঝামেলামুক্ত থাকতে পারবি। তারপর আবার আসবি।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম।
- কিন্তু সাত নাম্বার দাঁতটা মনে হয় এফেক্টেড। বরং এক্স-রে করে দেখি। কি বলিস?
আমার বলাবলির অপেক্ষায় না থেকে সোলায়মানকে ডেকে একটা এক্স-রে করতে বললেন। সুরুজ ভাইর চেম্বারে একটা ছোট্ট পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন আছে। ডিএসএলআর ক্যামেরার সাইজের। দেখতেও একদম ক্যামেরার মতো। সামনের দিকে লেন্সের মতো উঁচুও আছে, সম্ভবত ঐদিক দিয়ে রে বের হয়। যাই হোক, সোলায়মান ব্যাটা এক্স-রে ক্যামেরা বের করলো। তারপর আমার মুখের ভেতর একটা ফিল্ম ঢুকিয়ে দাঁতের পেছনে সেট করে ধরতে বললো। আঙ্গুল দিয়ে আটকে ধরলাম মুখের ভেতরে। আমি এসবে অভ্যস্ত। আগেও বেশ কয়েকবার এসবের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। সোলায়মান এবার ক্যামেরা তাক করে রে পাঠিয়ে দিলো ফিল্মে। এক্স-রে শেষ। বললো, আরো দশ মিনিট ঝিমান, টাইম লাগবে।

এক্স-রে রিপোর্টটা হতে নিয়ে সুরুজ ভাই বললেন, সোলায়মান তোর হাত তো অনেক ভালো হয়ে গেছে। আট নাম্বার দাঁতও ক্লিয়ার দেখা যাচ্ছে। কিনননতু, আট নাম্বার দাঁতের অবস্থা তো আরো বেশি খারাপ। আক্কেল দাঁত! বের হতে গিয়ে ঠিক মতো বের হতে পারেনি। মাড়ির ভেতরে বাঁকা হয়ে সাত নাম্বার দাঁতের সাথে আটকে গেছে। ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। সোলায়মান, আরেকটা এক্স-রে কর। এবার আট নাম্বার দাঁত ফোকাস করবি যেন পুরাটা আসে, ঠিক আছে?

সোলায়মান মাথা নাড়লো। আমি কিছুই বলার সুযোগ পেলাম না। আরেকবার এক্স-রে করা হলো।

এক্স-রে রিপোর্ট রেডি কিন্তু সুরুজ ভাই’র সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো, কপালটা তো চুলকানো হলো না। এতক্ষণে অবশ্য চুলকানিটাও নাই। তবুও মৃদু একবার কপালটা চুলকে নিলাম। আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা সোলায়মানকে ইশারায় ডাকলাম। কাছে আসতেই বললাম, পানি খাবো।
সোলায়মান পানি আনতে গেল। ঠিক তখনি আবিস্কার করলাম, আমার আওয়াজ ফিরে এসেছে। আহ, শান্তি।
সোলায়মানের পানি নিয়ে ফেরার আগেই সুরুজ ভাই এসে এক্স-রে রিপোর্টটা হাতে নিলেন। অদ্ভুতভাবে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসলেন। একবার এক্স-রের দিকে তাকান, একবার আমার দিকে তাকান! তারপর বললেন, কি রে পটকা, কী মনে হয়? ভালো না খারাপ?
বললাম, খারাপই তো মনে হয়।
- হুম, বেশ খারাপ।
ভয় পাওয়া দরকার কিনা বুঝতে পারছি না। বললাম, তাহলে?
- তাহলে আর কী, চুপচাপ শুয়ে থাক। যা করার আমি করছি। প্রথমে আক্কেল দাঁতটা তুলতে হবে। বাঁকা হয়ে মাড়ির ভেতর আটকে গেছে। উঠতে পারছে না। কিন্তু তোর তো এই দাঁতে ব্যথা হবার কথা, ব্যথা হয় না?
- না, ব্যথা নাই।
- আজব। তুই একটা আজব ছেলে। যে দাঁতের অবস্থা কাহিল সেটার ব্যথা নাই, আর যেটা সামান্য ক্যাভিটিতে ফুটা হয়ে যাচ্ছে সেটার ব্যথা নিয়ে এসেছিস!
বোকার মতো হাসলাম। ব্যথা না হলে তো আর জোড় করে ব্যথা আনতে পারবো না।
সোলায়মান পানি নিয়ে এসেছে। একটা সুইচ টিপতেই ঘাড়সহ মাথা উপরে উঠে গেল। আধ-শোয়া হয়ে পানি খেলাম।
সুরুজ ভাই বললেন, পেট কি ভরা না খালি?
প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না। সেটা বুঝতে পেরে উনি বললেন, দাঁত তুলবো তো, আগামি কয়েকঘন্টা খেতে পারবি না। কাজেই যদি পেট খালি থাকে তো কিছু খেয়ে আয়।
বললাম, না, খিদা নাই।
- ঠিক আছে। শুয়ে পড় আবার।
শুয়ে পড়লাম। সুরুজ ভাই সোলায়মানকে কী কী যেন ইন্সট্রাকশন দিলেন, শুনতে পেলাম না। কিন্তু দেখলাম সোলায়মান দাঁতে বের করে হাসছে। খানিকক্ষণ পর একটা ইনজেকশন সিরিঞ্জ নিয়ে হাজির হলো সোলায়মান। আবারো কি অ্যানিস্থিশিয়া দেবে?
অ্যানিস্থিশিয়া দিয়ে সোলায়মান বললো, শুয়ে থাকেন পাঁচ-সাত মিনিট। স্যার আসতেছে।
স্যারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আবার ঝিমুনি শুরু হয়ে গেল। অ্যানিস্থিশিয়া ইফেক্ট। এবার বোধহয় অবস্থা বেশি খারাপের দিকে চলে গেল। এলোমেলো একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। কী দেখলাম মনে নাই। তবে স্বপ্ন ভাঙ্গলেও ঝিমুনি কাটে না। এর মাঝেই কখন যেন সুরুজ ভাই কাজ শুরু করে দিয়েছেন। আমার হাঁ করা মুখের ভেতর ইচ্ছা মতো যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন। ব্যথা তেমন অনুভব করতে পারছি না, হালকা কিছু চাপ টের পাচ্ছি। যাই হোক, এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কি না বুঝতে পারলাম না। সুরুজ ভাই’র ডাকে চেতনায় ফিরলাম, ঐ পটকা, মুখ বন্ধ করিস না এখন। হাঁ কর। বড়ো হাঁ।
বড়ো একটা হাঁ করার চেষ্টা করলাম। চোখ খুলে স্পষ্ট করে তাকাতেই মাস্ক পড়া সুরুজ ভাই’র মুখমন্ডল প্রকট হলো। ঘেমে ভিজে গিয়েছেন, অথচ রুমে কড়া এসি চলছে। উনি বললেন, তোর কপালটা খারাপ রে পটকা। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু সহজে বের হচ্ছে না। মনে হয় হাড় কেটে বের করতে হবে। কী বলিস?
আমি কিছু বলি না। বলার কিছু নাই। হাড় কাটা নিশ্চয় একটা বড়ো বিষয়, সেটার জন্য তিনি আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবেন না। তাছাড়া আমি ‘না’ বললে তো তিনি শোনার কথা না। নিচের পাটির দাঁতে ব্যথা নিয়ে এলাম, তিনি বললেন উপরের পাটির ছয় নম্বর দাঁতে সমস্যা। তারপর ক্রমান্বয়ে সাত এবং আট নম্বরে গিয়ে থামলেন। যা ভালো হয় তাই তো করবেন!
উনি আমার উত্তরের অপেক্ষাও করলেন না। সোলায়মানকে ডেকে আরো যেন কী কী সব বের করতে বললেন। মনে হলো সোলায়মান আবারো একটা হাসি দিয়ে চলে গেল।
কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতর চলে গেছি। সময় কিভাবে কাটছে বুঝতে পারছি না। সোলায়মান তার মতো যন্ত্রপাতি যোগান দিয়ে যাচ্ছে, সুরুজ ভাই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি ঝিমুচ্ছি আর জাগছি। মুখ কিন্তু হাঁ করাই থাকে। হাঁ করে কিভাবে ঝিমুচ্ছি বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক, এবার ঝিমুনি কাটলো অদ্ভুত একটা শব্দে, তবে শব্দটা পরিচিত। চোখ মেলতেই দেখি সুরুজ ভাই আমার বুকের ওপর চড়ে বসেছেন, হাতে ড্রিল মেশিন। মেশিনটা বন্ধ করলেন, শব্দ থেমে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি সোলায়মানের হাতে ইলেকট্রিক কড়াতের মতো ছোট একটা যন্ত্র। যন্ত্রের মাথায় কড়াতের ব্লেডের মতো গোল একটা চাকতিও আছে! রীতিমত কেটেকুটে ফেলার আয়োজন। ভয়ে আত্মা বেরিয়ে আসার দশা হলো। হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই দেখি সেগুলো অসাড়, বেঁধে রেখেছে নাকি অ্যানিস্থিশিয়ার ফল বুঝতে পারলাম না। সুরুজ ভাই ড্রিল মেশিনটা চালু করে বললেন, একদম ভয় পাবি না। এরকম অনেক হাড় কেটে দাঁত বের করেছি। কোনো ব্যাপার না। সোলায়মান, কাটারটা রেডি রাখ।
সোলায়মান বললো, রেডি আছে স্যার।
- হাতুড়ি-ছেনি কই?
- সব রেডি স্যার। গাল কেটে দাঁত বের করবেন নাকি?
সুরুজ ভাই কোনো জবাব দিলো না। ড্রিল মেশিনের শব্দটা ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগলো। আমি বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সম্ভাব্য বিপদের জন্য অপেক্ষা করছি। সুরুজ ভাই’র মুখমন্ডল থেকে গড়িয়ে দু’ফোঁটা ঘাম পড়লো আমার বুকের ওপর। ছ্যাঁত করে শব্দ হলো কি? ঘাম পড়লো নাকি এসিড? ড্রিল মেশিনের শব্দটা আরো প্রকট হলো, মনে হচ্ছে মুখের ভেতর ঢুকে গেল।
পরবর্তী কিছুক্ষণ কী হলো আমি বর্ণনা করতে পারবো না। ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি। কোনো ব্যথাও অনুভূত হচ্ছে না। শুধু বুঝতে পারছি সুরুজ ভাই তাঁর সকল শক্তি আর অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়ে আমার দাঁত বের করার চেষ্টা করছেন। কতক্ষণ সময় গেল জানি না, হয়তো অনন্তকাল হবে। এক পর্যায়ে তিনি সফলভাবে একটা দাঁতকে তিন টুকরো করে বের করে বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, সোলায়মান, বলেছিলাম না, বের হবে! বের তো হতেই হবে।
বড়ো টুকরোটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নে, সুভ্যেনির হিসেবে রাখ।
হঠাৎ করেই জ্ঞান হারালাম।

শীত শীত লাগছে।
চোখ মেলতেই একরাশ আলো এসে পড়লো। মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। গভীর ঘুম ভেঙ্গে গেলে যেমনটা লাগে আরকি। হঠাৎ মনে পড়লো, ডেন্টিস্টের চেম্বারে ছিলাম। এখনো কি সুরুজ ভাইয়ের চেম্বারে আছি? দাঁত তোলা কি শেষ? চোয়ালটা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই খুব সহজেই নাড়ানো গেল। অ্যানিস্থিশিয়ার প্রভাব কি শেষ? চেয়ারেই তো বসে আছি। হঠাৎ সুরুজ ভাই’র আওয়াজ পেলাম, এই পটকা, আর কত ঘুমাবি? উঠ, যা, তিন নম্বর বেডে শুয়ে পড়।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। তাহলে এখনো তিন নম্বর বেডে যাইনি? অ্যানিস্থিশিয়ার দুর্দান্ত প্রভাবে নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম। এ যাত্রায় তাহলে বেঁচে গিয়েছি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর তিন নম্বর বেডের দিকে হাঁটা দিলাম। হঠাৎ মনে হলো প্যান্টের ডান পকেটে কী যেন খোঁচা লাগলো। হাত দিয়ে বের করে সামনে আনলাম, তিন টুকরো হওয়া দাঁতটার বড়ো টুকরাটা!

ছবি: ফ্লিকার

প্রকাশিত: যে সূর্যটা রানুর জন্য উঠেছিল
পাওয়া যাবে: নৈঋতা ক্যাফে
স্টল নং: ৪৮৩
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০।
অনলাইনে: রকমারী


সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:২৮
১৬টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×