আমি জেল খানায় যখন প্রবেশ করি তখন রাত ৮ টা। সারা দিন কিছু খায় নি। ২ দিন ধরে এক পোষাক পড়া ছিলাম। খুব অসস্তিতে ছিলাম। জেল খানার প্রতিটি রুম কে একটা ওয়ার্ড হিসাবে অভিহিত করা হয়। একটি ওয়ার্ডে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকে।
ওয়ার্ডের যে দায়িত্বে থাকে তাকে ম্যাট বলা হয়। সে অবশ্যই সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হয়। জেল খানার সকল লোক ২ ভাগে বিভক্ত। যাদের মামলার রায় হয় নি তারা হাজতী আর যাদের মামলার রায় হয়েছে তারা কয়েদী। কয়েদীদের মধ্যে আবার সশ্রম বিনাশ্রম দুইটাই আছে। শুধুমাত্র কয়েদীরাই জেল খানার সকল কাজ কর্ম গুলি করে। যাই হোক আমি ঐ ম্যাটের কাছে একটা লুঙ্গি চাই। তাছাড়া প্যান্টেও অনেক ময়লা, রক্ত লেগেছিল। তখন ঐ ম্যাট আমাকে বলে- “ তুমি কি আমাকে চিঠি দিয়ে আগে জানিয়ে দিয়েছিলে যে তোমার লুঙ্গি লাগবে ? ”
প্রথম ব্যবহারেই আমি থ। ম্যাটের বয়স ৬০ এর উপর। সে আজ ২০ বছর ধরে খুনের মামলায় জেল খাটছে। তার দাড়িও ছিল। তাই আমি ভাবলাম তার কাছে একটা লুঙ্গি চাইলে হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ব্যবহার আমি আশা করিনি। তখন সালাউদ্দিন ভাই আমাকে বললেন - “ফারাবী একটা মাইর তো পুলিশ লাইনে খাইছ, এখন জেল খানার ভিতর ম্যাটের হাতে আরেকটা মাইর খাইও না। ”
যাই হোক আমি আর কথা বার্তা না বলে চুপচাপ হয়ে যাই। যেহেতু ঐ দিন সারাদিন আমরা কিছু খাইনি তাই এক সুবেদার দয়া করে আমাদের জন্য কিছু ভাত ও কাকরোলের তরকারি নিয়ে আসে। কাকরোলের ভিতর খালি বিচি। এই কাঁকরোলই ছিল আমাদের জেল খানার খাবারের একটা প্রচলিত আইটেম। আমি এই দেখে বললাম আর কিছু নাই? তখন একজন কয়েদী আমাকে বলল কয়েক বছর আগে ২ বেলা রুটি আর ১ বেলা ভাত দেয়া হইত। আর এখন তো ২ বেলাই ভাত দেয়া হয়। এখন আমি জেল খানার ভিতর তথাকথিত জেল হাসপাতালের ব্যাপারে আপনাদের কে কিছু জানাব। জেল খানার হাসপাতালের ভিতর বেড আছে, কিন্তু ঐখানে কোন অসুস্থ রোগী থাকতে পারে না। রোগীরা থাকে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে আর সুস্থ লোকেরা থাকে বেডের উপরে। এইখানে বাণিজ্য টা যে ভাবে হয় তা হল জেল খানার হাসপাতালের দায়িত্বে যে ডাক্তার থাকে তার সাথে আপনার কোন আত্বীয় স্বজন ঐ ডাক্তারের বাসায় যেয়ে দেখা করবে। ডাক্তারদের বাসা জেল খানার বাইরে হয়। যে কোন ডাক্তারকে এককালীন ১০ হাজার টাকার মত দিবে। তারপর প্রতি মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা ডাক্তার কে দিলে আপনাকে কাগজ কলমে রোগী বানিয়ে ঐ ডাক্তার প্রতি মাসে আপনাকে হাসপাতালে রাখবে। দেখা যায় খুব অসুস্থ রোগী কে ১ সপ্তাহও হাসপাতালে রাখা হয় না। আর টাকার বিনিময়ে বছরের পর বছর সুস্থ লোকেরা জেল খানায় থাকছে। জেল খানায় বদলী খাটা বলতে একটা কথা আছে। এটা হল এক জনের সাজা আরেক জন খেটে দেয়। মামলা চলার সময় নাম ঠিকানা বদলিয়ে আপনার পরিচয় টা অন্য কেঊ ধারন করে সে আপনার মামলার আপনার হয়ে জেলে ঠুকবে আর বাকী সাজা টা জেল খেটে বের হয়ে আসবে। এই জাতীয় লোকেরা সব হাসপাতালে থাকে। আমি এইরকম ১০ জনের মত পেয়েছি। বাংলাদেশ আসলেই একটা বিচিত্র দেশ।
পরের দিন ফজরের নামাযের পর আমরা যারা ঐ রাতে জেল খানায় নতুন এসেছিলাম তাদের সকল কে জেল খানার মাঠে আসতে বলে। সেখানে আমরা ছাড়া আরো অনেক নতুন হাজতী সবাই মাটিতে বসে সিনিয়র জেলার এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জেলার এসে প্রথমেই আমাদের সাথে কথা বলে। উনি বললেন আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও আজকে এই নরকের কীটে। আপনাদের মাঝে কি কেউ Law তে পড়েন। তখন ২ জন উঠে দাড়াল। তখন জেলার বলল- “ আজকের এই দিন টা অবশ্যই আপনাদের জীবনে একটা স্মরণীয় দিন। বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগ কি জিনিস তা আপনারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আশা করি আইন পড়াশোনা শেষ করে আপনারা এই আইন ও বিচার বিভাগ পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। ” তারপর উনি বলল আপনার অনেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকল আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক মতবাদ কয়েদী ও হাজতীদের মাঝে ছড়াবেন না। আর আপনারা আল্লাহর কাছে বেশি করে দোয়া করেন যেন তাড়াতাড়ি এই নরকের গর্ত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তারপর জিজ্ঞাস করল মাদক মামলায় কাড়া কাড়া এসেছে। তাদের কে আলাদা করে একটা বিশেষ বয়ান দেয়া হল যে জেল খানার ভিতর মাদক বেচা কেনায় জড়িত হলে নতুন করে আবার কেইস খাবে।
যাই হোক এইসব ক্যাচালের শেষে
সকল নতুন হাজতিকে প্রথম চুল কাটা হয়। তারপর শার্ট খুলে জন্ম দাগ নিয়ে একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ছবি তোলা হয়। সেই ছবি দিয়ে আর প্রত্যেকের মামলার ধারা দিয়ে একটা কেইস কার্ড করা হয়। সেই কেইস কার্ডে আপনার হাজতী নাম্বার লেখা থাকে। এই কেইস কার্ড টিকে সব সময় সাথে রাখতে হয়।
জেল খানার সম্বল থালা বাটি কম্বল। আপনি জেল খানায় কেইস কার্ড বুঝিয়ে পাওয়ার পর আপনাকে একটা থালা, একটা বাটি ও একটা কম্বল দেয়া হবে। এই থালা বাটি দিয়েই আপনাকে ভাত খেতে হবে আর গোসল করার জন্য হাঊস থেকে যুদ্ধ করে আপনাকে এই থালা দিয়েই পানি উঠাতে হবে। প্রথম প্রথম মগ বালতি কিনা তো একটা অসাধ্য জিনিস।
এখন আমার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর পরিবারের কথা বলব। গ্রেফতার হওয়ার পর পরই আমি পিতাকে মোবাইল দিয়ে আমার এই অবস্থা জানায়। ২ মিনিট কথা বলার পরপরই সৎ পুলিশ ভাইয়েরা আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। শুধু আমার না যারা মিছিল থেকে গ্রেফতার হইছিলাম তাদের সবার মোবাইল পুলিশ জোর করে ছিনিয়ে নিছিল। এর মধ্যে একটা ছেলের আই ফোন ছিল। এক সাব-ইন্সপেক্টর ঐ আই ফোন টা জোর করে ছেলের হাত থেকে কেড়ে নেয়। আই-ফোন দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে বলেন ? :!> :!> :!>
যাই হোক আমার রক্তের সম্পর্কিত খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে চাকরি করে। উনি ঐ রাতে পুলিশ লাইনে এসে অনেক দেন দরবার করছিল আমাকে মাইর ও জেল খানার হাত থেকে বাচানোর জন্য। কিন্তু রাজনীতির যেই পর্যায়ে আমি চলে গেছিলাম সেখান থেকে আমাকে ছাড়ার কোন কারন আওয়ামীলীগের ছিল না। আমার ঐ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সময়ের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি এরশাদ ভাইয়ের সাথেও কথা বলছিল কিন্তু আমার পুড়া কপাল উনার এত তদবীরের পরেও আমি জেলের ভাত থেকে বাচতে পারলাম না।
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ১ম পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৩য় পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৪র্থ পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৫ম পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৪৭