আমি যখন চট্রগ্রাম জেল খানায় তখন আমার পিতা মৌলভীবাজার জেলায়। আমার পিতা একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মৌলভীবাজার জেলার দায়িত্বে ছিলেন উনি।
যাই হোক সেই মৌলভীবাজার জেলা থেকে চট্রগ্রামে আসা উনার জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। সিলেট থেকে উদয়ন নামক একটা ট্রেন চট্রগ্রামে আসতো। ঐ ট্রেন টা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে থামত। শ্রীমঙ্গলে উদয়ন ট্রেন টা আসত রাত ১২ টার দিকে। তো আমার পিতা ঐ রাত ১২ টায় একা একা ট্রেনে উঠে চট্রগ্রামে আসতো। উনার বয়স ছিল তখন ৫৪ বছর। খুব কষ্ট হত উনার।
যাই হোক চট্রগ্রামে এসে উনি আমাদের ঐ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যে পুলিশে চাকরি করতেন তার মাধ্যমে জেল খানায় আমার সাথে দেখা করেন। জেল খানার কারাবন্দীদের সাথে দেখা করার ২ টা নিয়ম। সরকারী নিয়ম টা হল ২ টাকা দিয়ে একটা কুপন কাটবে। বন্দীর নাম ঠিকানা এইসব লিখে জমা দিবে। ৩০ মিনিট পর একটা গনরুমে যেতে হবে। ঐ পাশে আপনি থাকবেন। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসা কোন আত্মীয় স্বজনের একটা কথাও শুনতে পারবেন না। তাছাড়া যে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে আপনি তার মুখ টাও ভাল করে দেখতে পারবেন না। কারন আপনার ও ঐ আত্মীয়ের মাঝে একটা বিশাল নেট বা প্লাস্টিকের জাল যার মাঝখান দিয়ে ছোট ছোট ছিদ্র করা। ঐ ছোট ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে আপনাকে উনাকে দেখতে হবে।
আর বেসরকারী যে নিয়ম টা হল তা হল আমার পিতা ৫০০ টাকা জেল খানার বাইরে একটা কারা রক্ষী কে দিল। তারপর ঐ কারা রক্ষী আমার পিতা কে জেল খানার অফিসে নিয়ে গেল। তারপর আমাকে ঐ কারারক্ষী ওয়ার্ড থেকে ডাক দিয়ে জেল খানার গেইট খুলে আমার পিতার সাথে সামনা সামনি দেখা করার সুযোগ করে দিল। কিছুক্ষন কান্নাকাটির পর আমি আমার পিতা কে জিজ্ঞাস করলাম উকিল কারে ধরলা ? তখন আমার পিতা বলল তুমি আগে যে দলটা করতা সেই দলের আইনজীবীরা আমার সাথে যোগাযোগ করে তোমার মামলা ২ টা চালাইতে চাইছিল। কিন্তু ঐ দলটা তো এখন নিষিদ্ধ তাই আমি নিজে B.N.P. এর একটা উকিল ধরতে চাইছিলাম। কিন্তু তোমাদের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি আরিফ আমাকে অনুরোধ করল ফারাবীর মামলা টা আমরা চালাবো। কারন ফারাবী তো শিবিরের সাথে ধরা খাইছে। আর ২৪ জনের মামলার ধারা তো একই। তো আমি বললাম ঠিক আছে এক উকিলই ভাল। আমাদের মামলা চালাইছিল জামাতের আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। তো যাই হোক আমার পিতা আমাকে ২০০০ টাকা দিল জেল খানার ভিতরে খরচ করার জন্য।
এখন আমি আপনাদের কে জেল খানার ভিতর মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলব। এই যে আমার পিতা আমাকে ২০০০ টাকা দিল এই টাকা টা কিন্তু আমি জেল খানার ভিতরে নিতে পারবো না। জেল খানার প্রত্যেক বন্দীর নামে একটা P.C. Card থাকে যেটার মানে হল Personal Card. ঐ কার্ডে আমার নামে ২০০০ টাকা লিখা থাকবে। জেল খানার ভিতরে প্রতি ভবনে একটা রুম থাকে যেখানে বিভিন্ন শুকনা জিনিস যেমন বিস্কুট, আলু, কলা ফলমূল প্রভৃতি বিক্রি হয়। প্রত্যেকে তার P.C. Card দিয়ে এইসব জিনিস কিনে। তবে জেল খানার ভিতর সবচেয়ে বেশি বিক্রি কি হয় জানেন ? সেটা হল সিগারেট। এই সিগারেট কিন্তু খাওয়ার জন্য কেউ কিনে না। কেন কিনে বলি। জেল খানার ভিতরে গোসল করা খুব কষ্টকর। হাউসে নেমে হুড়াহুড়ি করে গোসল করতে হয়। তো আপনি যদি প্রতি সপ্তাহে ১ টা করে গোল্ডলিফের প্যাকেট ঐ কয়েদীকে দেন যে পানির দায়িত্বে থাকে তাইলে সে আপনাকে প্রতি সপ্তাহে মোটামুটি ভাবে গোসল করার পানি দিবে। এইভাবে সে যে গোল্ডলিফের প্যাকেট গুলি পাবে ধরেন ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ দাম ৭০০ টাকা। এই ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ সে কোন কারা রক্ষীর মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করবে ৬০০ টাকায়। এরমধ্যে ১০০ টাকা আবার ঐ কারা রক্ষীর পারিশ্রমিক। তাইলে থাকে ৫০০ টাকা। এই ৫০০ টাকা কারা রক্ষী ঐ কয়েদির নামে তার P.C. Card এ জমা দিয়ে দিবে, তারপর ঐ কয়েদি P.C. Card এর ৫০০ টাকা দিয়ে জেল খানার ভিতর বিভিন্ন খাবারের জিনিস কিনবে। আবার ঐ সিগারেটের প্যাকেট অন্য ভাবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ঐ কয়েদির কোন আত্মীয় স্বজন তার সাথে দেখা করতে আসলে সে ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফ কোন কারা রক্ষীর মাধ্যমে তার ঐ আত্মীয় স্বজন কে দিবে। ঐ ১০ প্যাকেট গোল্ডলিফের মাঝে কারা রক্ষী নিবে ১ প্যাকেট আর বাকী থাকে ৯ প্যাকেট গোল্ডলিফ। ঐ ৯ প্যাকেট গোল্ডলিফ তার ঐ আত্মীয় স্বজন জেল খানার বাইরে কিছু নির্দিষ্ট দোকানে বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা নিয়ে চলে যাবে। এইভাবে জেলে থেকে অনেক কয়েদী সংসার চালায় বা বাপ মাকে টাকা দেয়। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের চেয়ে এত বিচিত্র দেশ এই পৃথিবী তে আছে। জেল না খাটলে আমি আসলে এই অদ্ভুত দেশের অনেক কিছুই
জানতাম না।
আর আমি তো এইখানে শুধু গোসল করার পানির কথা বললাম। আপনি গোল্ডলিফ, বেনসনের প্যাকেট দিয়ে মোটামুটি ভাল ভাত ও একটা বেশি মাছের টুকরাও খেতে পারবেন দৈনিক বা সাপ্তাহিক হিসাবে। জেল খানার প্রত্যেক ওয়ার্ডে নতুন কারা বন্দীকে ম্যাটকে কমপক্ষে ৫ টা গোল্ডলিফ সিগারেট দিতে হয়। না দিলে ঐ ম্যাট তাকে বাথরুমের পাশে ঘুমানোর জায়গা দিবে। আবার প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে ১ টা করে গোল্ডলিফ ঐ ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীকে দিতে হয়। না দিলেই ঐ ম্যাটের খবর আছে। তাকে শাস্তিস্বরুপ চৌকায় বদলী করে দেওয়া হয়। জেল খানার রান্নাঘর কে চৌকা বলে। কয়েদীদের জন্য রান্না করা একটা কষ্টকর ব্যাপার। এইজন্য কয়েদীরা নতুন কারা বন্দী আসলে তার কাছ থেকে চাপ দিয়ে গোল্ডলিফের প্যাকেট নিয়েই ছাড়বে। একটা কথা আছে যে “ জেল খানার ইটও টাকা খায়। ”
জেল খানায়া আমাদের ঘুম থেকে উঠতে হয় ফযরের পরপরই। এরপর ফাইল হয়। ফাইল মানে ৪ জন ৪ জন করে এক সাড়িতে বসতে হয়। তারপর জমাদার এসে মানুষ গোনে। এইভাবে দিনে মোট ৩ বার ফাইল হয়। সকালে , দুপুর ১২ টায় ও বিকাল ৫ টায়। বিকাল ৫ টার ফাইলের পর রুমের তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর মুরগির মত ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া রাত পাইর করতে হয়। তবে জেল খানায়
রুমের ভিতর টিভি আছে তবে শুধু B.T.V. দেখা যায়।
জেল খানায় একটা কথা প্রচলিত আছে যে জেলখানায় ছাগল বাঘকে চড়ায় মানে আপনি জেলের বাইরে যত বড় কেউকাটাই হন না কেন জেল খানার ভিতরে আপনাকে ঐ কয়েদিদের মন মত চলতে হবে। আজ এই পর্যন্তই। সামনের পর্বে আমার রিমান্ডের কাহিনী বলব ইনশাল্লাহ।
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৫ম পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৪র্থ পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ২য় পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ১ম পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৪৫