একটা সময় আমার বস্তির লোকদের দেখলে খারাপ লাগত। কিন্তু ১ মাস জেল খাটার পর আমার আর বস্তির লোকদের দেখলে খারাপ লাগে না। কারন ঢাকার বস্তির লোকেরা চাইলেই রামপুরা খিলগাঁও মিরপুর থেকে ঘুরে আসতে পারে। কিন্তু চট্রগ্রাম জেল খানায় ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় আটক সেনা বাহিনীর সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল, মেজর জেনারেল রাও জেল খানায় ডিভিশনে বসে দিন কাটাতে হয়। একটা সুস্থ সবল মানুষ সারাদিন একটা ৫ তলা ভবনে আবদ্ধ আর বিকাল ৫ টার পর মুরগির খোয়ারের মত রাত কাটান সেটা যে কি কষ্টকর এটা যে জেল খাটছে সেই জানে।
“ জেলের ভিতর জেল আর সেটা হচ্ছে সেল। ” আমি গত পর্বে আপনাদের কে ৩২ সেলের কথা বলছিলাম। এটা হল ২ তলা একটা বিল্ডিং। ৩২ টা রুম আছে সেখানে। প্রতি রুমে ৬ জন করে থাকে। বিকাল বেলা ৫ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত ৩২ সেলের লোকদের কে মাত্র ২ ঘণ্টার জন্য বারান্দায় হাটাহাটি করার সুযোগ দেয়া হইত। আর বাকি সারা দিন ঐ ছোট সেলে বসে তাদের ঝিমাইতে হত। আমরা তো ফজরের পর থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত যে কোন তলার যে কোন ওয়ার্ডে যেতে পারতাম কিন্তু ৩২ সেলের লোকদের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। এই ৩২ সেলে জে এম বি, হরকাতুল জিহাদ, শিবির ক্যাডার নাসির, পেশাগত খুনী দের রাখা হত।
আর ফাসীর আসামীদের কে রাখা হইত ১ তলা Condemned সেলে। সেখানে লেখা “ হতাশ হইও না আয়ু কমে যাবে। ” আরে আয়ু কমার জন্যই তো Condemned সেলে থাকি।
আবার যে সব কয়েদী জেল খানার ভিতর নিজেরা সমকামিতায় লিপ্ত হত তাদের কেও শাস্তি স্বরুপ সেলে রাখা হত। জেল খানার ভিতর সবচেয়ে বাজে ব্যাপার টা ছিল সমকামিতা। জেল খানায় অনেকেই যুবক হিসাবে ঢুকে আর বৃদ্ধ হয়ে বের হয়। মানুষের জীবনে জৈবিক চাহিদা এটাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। ইউরোপের জেল খানায় কিন্তু ঠিকই বিবাহিত কয়েদীদের কে তাদের স্ত্রীদের সাথে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়া হয়। এই নিয়ম টা বাংলাদেশেও চালু করা উচিত। জেল খানায় কেইস টেবিল বলে একটা কথা আছে। বাংলায় যেটার নাম হল বিচার বৈঠক। বন্দীরা যারা নিজেদের ভিতর মারামারি করে বা কোন কারারক্ষীদের সাথে কোন বেয়াদপী করলে তাদের কে এই কেইস টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সুবেদার রা এত মাইর মারে যে সে পুড়া অসুস্থ হয়ে যায়। অনেক বন্দী এই কেইস টেবিলের মাইর খেয়ে অসুস্থ হয়ে পরে মারা গেছে এমনও ঘটনা আছে।
জেল খানায় সবচেয়ে যে জিনিস টা আমার বিরক্ত লাগছে তা হল ধরেন আপনি মাদক মামলার কারনে জেলে আসলেন। আপনার ঐ মামলায় সাজা হবে সর্বোচ্চ ২ বছর। এখন আপনি যদি আপনার কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ না করতে পারেন তাইলে কিন্তু আপনাকে ৫ বছরও জেল খাটতে হতে পারে। এরকম বহুত লোক জেলে পচতাছে যে তার মামলার যে সাজা হইত তার থেকেও সে বেশিদিন জেল খাটতাছে কিন্তু বাইর হইতে পারতাছে না শুধু একজন উকিলের অভাবে। আর সরকারি ভাবে যে অসহায় দরিদ্র লোকদের জেল খানায় যে আইনগত সাহায্য দেওয়ার কথা আছে তা শুধু মাত্র কাগজে কলমেই আছে। আমি ১টা লোককেও পাইলাম না যে সরকারী আইনজীবীর মাধ্যমে জেল থেকে ছাড়া পাইছে। আপনার কোন আত্মীয় স্বজন যদি জেল খানায় আপনার কোন খোজ খবর না নেয় তাইলে আপনাকে বছরের পর বছর জেলে পচতে হবে এখন আপনার মামলা টা যত সাধারনই হোক না কেন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা।
জেল খানায় আর যে জিনিস টা খুব খারাপ লাগছে তা হল কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করতে না পারা। সরকার যদি এত লোককে জেল খানার ভিতর Free খাওয়াইতে পারে তাইলে এই লোকদের কে মোবাইল ফোনে তার আত্মীয় সজনদের সাথে সপ্তাহে একদিন কথা বলার সুযোগ করে দিলে কি হয়। অনেক বন্দী আছে শুধুমাত্র আত্মীয় সজনদের সাথে যোগাযোগ না করতে পারার কারনে বছরের পর বছর জেল খাটতাছে। আর ঐ ব্যক্তির পিতা মাতাও জানে না যে তার ছেলে দুনিয়াই আছে না মারা গেছে না জেলের কোন ওয়ার্ডে আছে। বাংলাদেশের মত এত বিশ্রী দেশ মনে হয় এই পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
জেল খানায় আমাদের মুল কাজটা ছিল পানি সংগ্রহ করা। ঘন্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের সাথে হুড়াহুড়ি করে আমাকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হত। এই পানি সংগ্রহ করতেই আমার দিনে ২-৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় হত।
তো যাই হোক ২৫ রমজানে আমি জামিন পাই আর জেল খানা থেকে মুক্তি পাই। জেল খানা থেকে মুক্তি পাবার পর আমি আমার আপন ফুফুর বাসা চট্রগ্রামের ফৌজদারহাটে যেয়ে ফৌজদারহাট পুলিশ ফাড়ির পিছনে যে পুকুর টা আছে সেখানে ১ ঘণ্টা ডুব দিয়ে থাকি। কারন জেল খানায় আমি একদিনও ভাল ভাবে গোসল করতে পারি নাই শুধু পানির অভাবে। আমি দোয়া করি আমার যে চরম শত্রু সেও যেন কখন জেলে না যায়। নরকের একটা অংশ হল বাংলাদেশের জেল খানা গুলি। আর জেল থেকে মুক্তি পাবার পরও আমাকে ১ বছর কোর্টে মিথ্যা ঐ ২ মামলার জন্য মাসে ১বার করে হাজিরা দিতে হইছে। তারপর ১ বছর টানা হাজিরা দেয়ার পর আনি খালাস পাই। রাজনৈতিক মামলা গুলাতে কোন সাক্ষী পাওয়া যায় না। কোন বাপের বেটাও নাই যে রাজনৈতিক মামলায় সাক্ষী দিবে। আর এই কারনে রাজনৈতিক মামলায় যারা ধরা পরে তারা সবাই খালাস পেয়ে যায়। খুনের মামলায় সাক্ষীর অভাবে কত বড় বড় খুনী খালাস পেয়ে গেল। আর এই জন্যই তো বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার এনকাউন্টারের সাথে মিলাইয়া ক্রসফায়ার সংস্কৃতির সুচনা হইছে।
যাই হোক সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। আমি জেল খাটছি এটা হয়ত আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাকে একটা পরীক্ষা নিল যে আমি জেল খানায় থেকেও নামায রোযা করি কিনা ? খুশির বিষয় হল এই যে আমি জেল খানায় থেকেও সব গুলি রোযা রাখছি আর মাঝে মাঝে ওয়ার্ডে ইমামতিও করছি। ১ ওয়াক্ত নামাযও আমি ছাড়ি নাই। তাই বলে আমি কিন্তু আবার জেলে যেতে ইচ্ছুক না
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৪র্থ পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ৩য় পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ২য় পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
আমার জেল জীবনের স্মৃতিকথা ১ম পর্ব পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:২৩