somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্কুল ও মক্তব

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হেড মাস্ট্রেস ছিলেন হিন্দু মহিলা। কপালে বিশাল বড় সিদুর। তাকে দেখেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এই ভয় পাওয়ার পেছনে কোনো কারণ ছিল কিনা মনে পরছে না। হেড মিস্ট্রেসের চেহারা রাগী কিংবা ভয়ানক ধরনের ছিল না। তিনি ছিলেন হাসি-খুশি স্বভাবের মধ্যবয়স্ক মহিলা। তবু তার দিকে তাকাতেই ভয়ে আমার বুকের ভিতরটা কেপে ওঠে। চোখ দুটো ছল-ছল করতে থাকে।
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তখন আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুদ ঘটনা ঘটেছিল। নিজের নামটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। মাথার ভিতরে শুধু 'পটল' শব্দটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবাই আমাকে পটল নামেই ডাকে। এমনকি আমার মা-বাবাও এই নামেই ডাকতো। এই নামকরণের পেছনে কারণ হলো আমি দেখতে গাপলু-গুপলু ধরনের ছিলাম। অনেকটা পটলেরই মতো। অনেক চেষ্টা করেও নিজের আসল নামটা মনে করতে পারলাম না। ছল-ছল চোখ দুটো থেকে পানি বর্ষিত হতে লাগলো।
আমার এই আহাম্মকি আচরনে বাবা খুব বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন। নিজের এই গর্ধব ছেলেকে নিয়ে মনে মনে লজ্জিত হচ্ছিলেন সম্ভবত। হেড মিস্ট্রেস আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। আমার বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'আপনার ছেলের বয়স কতো?'
বাবা বললেন, 'ছয় বছর।'
হেড মিস্ট্রেস আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার পরখ করে বললেন, 'দেখে কিন্তু তা মনে হয় না। আপনার ছেলেকে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি করুন। এই বছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করাটা ঠিক হবে না।'
বাবা বললেন, 'শিশু শ্রেণীতে ভর্তি করার প্রয়োজন নেই। আমি ওকে ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি করতে চাই। ওর বয়স ছয় বছরের কম নয়।'
হ্যাড মিস্ট্রেস আর কথা বাড়ালেন না। একটা ভর্তি ফরম বের করে বাবার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, 'ফরমটা পূরণ করুন।'
বাবা যত্ন সহকারে ফরমটা পূরণ করে জমা দিলেন। এবার হেড মিস্ট্রেস আমাকে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, 'বাবু, এবার তোমার নামটা আমাকে একটু বলবে?'
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'ম্যাডামকে তোমার নামটা বলো।'
আমি পরিষ্কার গলায় নিজের নামটা বললাম, 'বিজয়। '
হেড মিস্ট্রেস বললেন, 'বাহ! বেশ ভালো নাম।'
হ্যাড মিস্ট্রেস আমার দিকে তাকিয়ে চিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি স্বরে-অ স্বরে-আ পারো?'
আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।
'ঠিক আছে। তাহলে আমাকে শুনাও'
আমার আর ভয় লাগছে না। আমি স্বরবর্ণগুলো একে একে বলা শুরু করলাম।
আর কোনো সমস্যা হলো না। আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে নেওয়া হলো। এটা আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঘটনা। এটা মানুষ হওয়ার পথে আমার প্রথম পদক্ষেপ। শৈশবের চির স্মরনীয় ঘটনা।
স্কুলে প্রথমদিন গেলাম স্কুল ড্রেস ছাড়াই। আমার সবচেয়ে ভালো নতুন শার্ট-প্যান্ট পরেছিলাম সেদিন। আথায় নারিকেল তেল দিয়ে একপাশে সিথি করে চুল অচড়ে দিয়েছিল মা। চোখে কাজল দিতে আমি পছন্দ করতাম না। তবে আমার মা সব সময় আমার চোখে কাজল দিয়ে দিতেন।
স্কুলে সেদিন কোনো ক্লাস হলো না। স্কুলের মাঠে, পাশের বাজারে, স্কুলের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালাম। মক্তবের সহপাঠি দুই তিনটা ছেলে আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। তাদের সাথেই সময় কাটাতে লাগলাম। দুপুর বারোটার পর থেকে স্কুল থেকে নতুন বই বিতরন শুরু হলো। আমরা সবাই স্কুলের সামনে লাইন দিয়ে দাড়ালাম। একে একে নাম ও রোল নাম্বার ডাকা হলো। অবশেষে আমার নামটা ডাকা হলো। তখন আমি জানতে পারলাম আমার রোল নাম্বার হয়েছে ছেষট্টি। আমাকে তিনটা নতুন বই দেওয়া হলো।
নতুন বই নিয়ে মহা আনন্দে ফিরে এলাম। বইগুলো নিয়ে সারাটা সন্ধ্যা পার করে দিলাম। বই পড়ার চাইতে বই নাড়া-চাড়া করাটাই ছিল বেশি অনন্দের। 'আয় আয় তালগাছ' কবিতাটা মুখস্ত করে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমানোর সময় বইগুলো আমার বালিশের কাছে নিয়েই ঘুমিয়েছিলাম।
প্রতিটি সকাল আমার জন্য ছিল প্রচন্ড বেদানার। সকালে মক্তবে যাওয়াটা ছিল আমার সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ। মাঝে মাঝে এই মক্তবে যেতে না চাইলে মায়ের হাতর প্রচন্ড মার খেতে হতো। এলাকর মসজিদ থেকে ইমাম সাহেব খুব সকালে মাইক দিয়ে মক্তবের ছাত্র-ছত্রীদের ডাকতেন। মুখ ধুয়ে ওজু করে মক্তবে যাওয়ার সময় পকেটে করে মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট, ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। পকেট থেকে বের করে সেগুলো খেতে খেতে মক্তবে যেতাম।
মসজিদের বারান্দায় ইমাম সাহবে একটা মোটা বেত নিয়ে জায়নামাজের উপর বসতেন। আমরা তার সামনে চতুর্ভূজ আকৃতিতে সারিবদ্ধ হয়ে বসতাম। এক হাটু উপরে উঠিয়ে বসতে হতো। এটা মক্তবে বসার অলিখিত নিয়ম ছিল।
সবাই ঘই-ঘই করে উচ্চ স্বরে পড়া শুরু করতাম। মক্তবের আধ কিলোমিটার দুর থেকেও সেই পড়ার শব্দ শুনা যেত। পড়ার ফাকে-ফাকে পকেট থেকে বিভিন্ন খাবার বের করে খেতাম। কাজটা খুব সাবধানে করতে হতো। কখনো কখনো পাশে বসা সহপাঠির সাথে গল্প করতাম। সেটাও খুব কৌশলে করত হতো। দেখে হবে আমরা ঢুলে-ঢুলে মনযোগ দিয়ে পড়ছি। এভাবে অনেক্ষণ পড়ার পর ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে সেই পড়া সবক দিতে হতো। সবক দেওয়াটা মক্তবের সবচেয়ে আতঙ্কের কাজ। পড়া ভুল হলে বইরে থেকে পিঠের উপরে বেত পরার শব্দ শুনা যেত।
ছুটির পর সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ফিরতাম। মক্তব ছুটির পর সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো নিজেন জুতো জোড়া খুজে পাওয়া
মক্তব হলো এক বিচিত্র পাঠ্যশালা। এই পাঠ্যশালা দিন দিন হরিয়ে যাচ্ছে। হয়তো অদুর ভবিষ্যতে এর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আমি মক্তবে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পেরেছি।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×