সেকালে রেডিও বাংলাদেশকে বাংলাদেশ বেতার বলা হতো। আব্বা ঢাকা থেকে বাড়ীতে আসলে আমি তাঁকে বাড়ীতে ঘটা সকল ঘটনার বিবরণ প্রদান করতাম। আব্বা ছিলেন হিসাবী মা ছিলেন কিছুটা খরুচে। সেজন্য আমার বিবরনির কারণে মাকে অনেক সময় দু’কথা শুনতে হতো। সেজন্য আব্বা আসার আগে মা আমাকে বলতেন, এই বাংলাদেশ বেতার তোর আব্বাকে এই এই ঘটনা কিন্তু বলা যাবে না। মায়ের অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে আমি সেসব ঘটনা চেপে যেতাম। তাতে পরিবারে আমার খাতিরও বেড়ে গিয়েছিলো।
বড় ভাইয়ের রাতে মাছ ধরার নেশা ছিলো। তিনি টেটা দিয়ে মাছ ধরতেন। সাথে থাকতো দোনালী বাতি।দোনালী বাতিতে পানির অনেক নীচ পর্যন্ত মাছ দেখা যেত। মাছ ধরে রাখার ভান্ডকে আমাদের এলাকায় খলি বলা হতো। বড় ভাইয়ের সাথে মেঝভাই ছিলেন। খলি তাঁর হাতে ছিলো। বড় ভাই অনেক মাছ পাচ্ছিলেন। সেজন্য সেদিন তাঁর মাছ ধরার আগ্রহ বেড়ে গিয়ে ছিলো। তাঁদের সামনে একজন লোক ছিলো। তাঁর পিছু পিছু তাঁরা অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তাঁরা দেখলেন সেই লোক উদাও এবং তাঁরা নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে এসেছেন। তখন তাঁরা ভয় পেলেন এবং দ্রুত বাড়ী ফিরে আসলেন। আপা সব সময় তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে জেগে থাকতেন মাছ কুটার জন্য। বাড়ী আসার পর মেঝ ভাইয়ের মনে হলো খলি হালকা। তিনি খলি উপুড় করার পর দেখলেন কোন মাছ পড়লো না। তখন তাঁরা বললেন, এত মাছ গেলো কোথায়? আপা বললেন, থাক মাছ লাগবে না। তোরা ফিরে এসেচিস এটাই বড় কথা। তারপর থেকে মেঝ ভাইয়ের মাছ ধরতে যাওয়ার আগ্রহ কমে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে বড় ভাই বাংলাদেশ বেতার কে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। যদিও আমি তখন খুব ছোট ছিলাম।
আমার ছ’বছরের সময় আপার বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমার দায়িত্ব ছিলো আপার শ্বশুর বাড়ীতে মাছ নিয়ে যাওয়া। তখন রাস্তার উপর পোল গুলো ছিলো বেশ উবাকাটা। সেই পোল পার হতে গড়িয়ে পড়ার ভয়ে অন্তর আত্মা শুকিয়ে যেতো। শাঁকোগুলো বুড়োর দাঁতের মত নড়বড়ে ছিল। এমন রাস্তা পাড়ি দিয়ে আপনার শ্বশুর বাড়ীর হাঁটে পৌছালে আপার এক দেবর লুঙ্গিটা খুলে রেখে দিত। এমতাবস্থায় মহা সংকোচ নিয়ে আপার শ্বশুর বাড়ী পৌঁছে মাওইজানকে আপার সেই দেবর শাজাহান ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশ দিতাম। পরে শাজাহান ভাই লুঙ্গি ফেরৎ দিতে এলে মাওই খুব করে তাঁকে বকে দিতেন। তাতে মনে কিছুটা শান্তনা পেতাম। এত কিছুর পরেও আপার শ্বশুরবাড়ী যাওয়া বন্ধ হয়নি দায়িত্বের টানে। ভাইদের বোনের প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না?
অন্যপথ একটু লম্বা ছিলো। আসার পথে সেই পথে আসতাম। সেই পথে দুলাভাইয়ের বড় বোনের বাড়ী ছিলো। মাওই তাঁর জন্য কিছু দিলে সেটা নিয়ে আসতাম। তারপর সেখানে খেয়ে বাড়ী ফিরে আসতাম। আপার শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার পথে সে পথে যেতাম না, কারণ তাতে তাঁকে যদি আবার ভাগ দিতে হয়? ফেরার পথে আসতাম তাঁর বাপের বাড়ী থেকে কিছু নিয়ে। তবে বেয়ারার হিসাবে আদর পেতাম। এরপর বাড়ী ফিরে আসলে মা খুব খুশী হতেন। বাংলাদেশ বেতার হিসাবে আপাকে কেমন কিভাবে দেখলাম সেসব নিখুঁতভাবে বিবরণ দিতাম। আমার অন্য ভাইদেরকে পাঠালে তাঁরা যা বিবরণ দিতেন তাতে মা খুশী হতে পারতেন না। সেজন্য এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেতার হিসাবে মা আমাকে খুব আদর করতেন।
# একালেও রেডিও বাংলাদেশের নাম বাংলাদেশ বেতার। তারমানে সরকার পাল্টালে বাংলাদেশ বেতার রেডিও বাংলাদেশ হয়, আবার রেডিও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেতার হয়। আমার শৈশব বাংলাদেশ বেতার দিয়ে শুরু হয়ে এখনো বাংলাদেশ বেতারে চলমান আছে। জানিনা জীবনটা কোন অবস্থায় শেষ হয়? রেডিও বাংলাদেশ নাকি বাংলাদেশ বেতার। সরকার পাল্টালে সব কিছু পাল্টে যায়, সেজন্য সরকার পাল্টানো আমার নিকট বিরক্তিকর মনে হয়। তথাপি সরকার পাল্টে যায়। এটাই নাকি গণতন্ত্রের নিয়ম!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৩ সকাল ৮:২১