কবিতা কেমন হওয়া উচিত? স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার? নিস্তরঙ্গ পানির মতো অতি তরল? নাকি পাখির ভাষার মতো অভেদ্য? কবিতা কি একটা মিনি স্কার্টের মতো নয়? কবিতা কি নারীর মতো রহস্যাবৃতা নয়? (নারী কবিদের কাছে উপমাটা কী হতে পারে জানি না)। একটা ভালো কবিতার স্বরূপ কী রূপ হওয়া চাই? চলুন একটু আলোচনা করি।
পৃথিবীর যে কোনো ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট হলো এর সহজবোধ্যতা বা প্রাঞ্জল্য। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও এ বিষয়টার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয় কিভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে হবে। আর প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে পারার গুণ সবার থাকে না, এটা অনেকটাই আল্লাহ্ প্রদত্ত বলে আমার মনে হয়। সবাই সার্থক বক্তা যেমন হতে পারেন না, তেমনই সার্থক লেখক বা কবিও সবাই হতে পারেন না। 'সহজ করে যায় না বলা সহজে।' বক্তা যেমন অপরের উদ্দেশ্যে বলেন, কবি বা লেখকও। একজন কবি বা লেখককে তাঁর পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে হলে পাঠক যেভাবে চায় আপনাকে সেভাবে লিখতে হবে বইকি। না? নিজের জন্য, নিজের আত্মতুষ্টির জন্য লিখবেন? তা নিয়ে তো আর তাহলে পাঠকের কোনো সমস্যা নেই, যা পাঠকের হাতে পৌঁছলোই না, তা নিয়ে আর আলোচোনাও হয় না।
কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক বিদ্যমান। কবি সাজ্জাদ কাদির একবার বলেছিলেন, অনেকে কবিতা লিখেন যার অর্থ কবি নিজেই জানেন না। আমার এক বন্ধু দুটি উপন্যাস, দুটি কাব্যগ্রন্থ সহ ৬টি বইয়ের জনক। পত্রপত্রিকায় তাঁর বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা দেখা যায়। তো, আমার একটা অতি ক্ষুদ্র সাহিত্যপত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তাকে খুব শংকার মধ্যে থাকতে হয়, কারণ, আমি তাঁর কবিতা না বুঝলে নির্ঘাত ব্যাখ্যা চাই, এবং অবশ্যাম্ভাবীভাবে দেখতে পাই চয়নকৃত অনেক শব্দের অর্থ পর্যন্ত তার জানা নেই, অভিধান ঘাঁটতে ঘাঁটতে কিছু শব্দ তার চোখে পড়ে, কিছু তার এমনি মাথায় আসে, অমনি কবিতায় তা বসাতেই হবে, আর অনিবার্যভাবে প্রয়োগ ভুল বা অর্থহীন হয়ে যায়। আরেক উঠতি কবি একুশে বইমেলায় বই বের করবেন। পত্রিকায় পাঠালেই তাঁর কবিতা ছাপা হয় (হয়তো মেয়ে হবার সুবাদে কিছু বাড়তি সুবিধা তিনি পান (মাফ করবেন), নিজেও ছোটখাট পত্রিকা বের করেন, বড় পত্রিকার প্রতিনিধি, তাও একটা যোগ্যতা হতে পারে)। তাঁর বই এডিট করে দিতে হবে। কিন্তু কোনও শব্দ বা বাক্য কাটাকুটি করা যাবে না। তাহলে এডিট কী করব? বানান। পান্ডুলিপি ফেরত নাও, আমি প্রুফরিডার নই। তিনি কিছু তালিম গ্রহণ করলেন আর এডিটেড কপি হাতে পেয়ে বললেন, 'এ কবিতা তো আমি লিখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই 'কঠিন কঠিন' শব্দগুলো কোথায় গেল?'
আমি গত বছর আগষ্ট মাসে কোনও এক সাইটে 'কামাকাঙ্ক্ষা নদী' নামে নামের আড়ালে একটা কবিতা পোস্ট করেছিলাম। সাইটের ডাকসাইটে কবিগণ সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আমার কবিতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন। আমি অভিভুত এবং বিস্মিত হয়েছিলাম সেই ডাকসাইটে প্রিয় কবিদের প্রতিভায়; আর আমার প্রতিভায়ও। বহুদূরবর্তী এক কবিকে মেইল করেছিলাম, তিনি পৃথিবীর বড় বড় কবি আর চিত্রশিল্পীদের থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমার কবিতার বিশদ প্রশংসা করেছিলেন। আর ঐ কবি (বই বের করলেন যিনি) বললেন, 'ভাইয়া, আপনি নাকি কঠিন কবিতা লিখতে পারেন না?'
এবার আমার কঠিন কবিতা লিখার ইতিহাস। আমি শুধু 'বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান' বইটা থেকে সুন্দর সুন্দর কিছু শব্দ নির্বাচন করেছিলাম, একটার পর একটা বসিয়েছিলাম আর কী, জাস্ট এ্যাজ এ ফান। তাতেই বাজিমাত।
একজন কবি বা লেখকের কাছে কঠিন শব্দ বলে কিছু নেই, সত্যিকার অর্থে কঠিন শব্দ বলে কি কিছু আছে? কবিতা হলো সাহিত্যের সম্রাজ্ঞী। বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু। কবিতা হলো সুচয়নকৃত শব্দমালার সুগ্রন্থিত রূপ, পঠনে যা শ্রুতিমধুর, পাঠ করলেই যা বুকের ভেতর ঢুকে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দেবে। যা পাঠককে ভাবায়। কবিতা হতে হবে রসে টইটুম্বুর। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু যে কোনও লেখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একগুচ্ছ অভিজাত শব্দ পাশাপাশি বসালেন, তা একটা ভাব বা অর্থ সৃষ্টি করলো বটে, কিন্তু শ্রতিমধুর হলো না, আমি এর বিপক্ষে।
কাব্যে দুর্বোধ্যতা বা জটিলতা বিগত প্রায় ত্রিশচল্লিশ বছরের বিতর্কের বিষয়, এর বেশি সময়েরও সম্ভব। অনেকে দুর্বোধ্যতাকে বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি বলেন। কবিতা যত দুর্বোধ্য তত উত্কৃষ্ট। আমি নগণ্য এর বিরুদ্ধে। আমি যা বুঝি তা লিখি, প্রকাশের আগে কাছের কাউকে পড়তে দিই, ওটার অর্থ তার কাছে বোধগম্য হয়েছে কিনা। কবিতা একটা প্রেমপত্রের মতো আমার কাছে, যা খুব আবেগ দিয়ে লিখি, আর ভাবি, এই কথাগুলো সে পড়বে আর তার মরমে পৌঁছবে। যদি কখনও মনে হয় এই লেখাটা তার মর্ম স্পর্শ করবে না, ওটার রিভিউ আমি করতেই থাকি। আমার কবিতার পাঠক আমার আরাধ্য প্রেমিকার মতো। কবিমাত্রই প্রচারপ্রিয় (সবাই)। আমি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে চাই, আপনাদের সবার মতোই।
আরও অনেক ছিল প্রকাশ করার, কিন্তু টাইপিং বড় সমস্যা। তাই হয়ত যা চেয়েছি তা ঠিকমত প্রকাশ পায়নি।
আপনারা সবাই শক্তিমান কবি। আপনাদের কবিতার মান অনেক উপরে। এই সুপার টেকনোলজির যুগে সাহিত্যে পাঠক ধরে রাখাটাই কঠিন। বাংলাদেশে মানুষ বইয়ের দিকে যে ঝুঁকে আছে এখনও সেজন্য সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদের, তাঁর লেখার সহজবোধ্যতার জন্যই।
আসুন, শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের জন্যও লিখি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




