আমার মায়ের একটা টিনের স্যুটকেস ছিল, যার রং ছিল জংপরা সবুজ
কাড়ের এক কোণে ওটা সযত্নে তুলে রাখতো মা, আর মাঝে মাঝে নামিয়ে তা থেকে
বের করতো পাতাবাহারের ছাপাঅলা একটা লাল পলিয়েস্টার শাড়ি;
আমরা ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা উৎসুক চোখে দেখতাম স্যুটকেসের ভিতরে
মায়ের মহামূল্য সম্পদগুলো- গোলমতো একটা সিঁদুরের কৌটো ছিল,
আমি এখনো জানি না আমার মুসলমান-জননীর কী প্রয়োজন ছিল ঐ সিঁদুরের।
আর যা যা ছিল, যদ্দূর মনে করতে পারি, কয়েকটা স্বর্ণের বালা, দুল, কিছু চুড়ি;
একটা বহুদিনের পুরোনো তিব্বত স্নো'র কৌটোও ছিল, হয়তোবা।
আমার মায়ের স্যুটকেসটা জীর্ণ হতে হতে ওর আংটা-টা হয়ে গিয়েছিল খুব ঢিলে;
একটা তালাও ছিল তাতে, চাবিটা কোথায় যেন লুকিয়ে রাখতো মা,
কেননা, তার আঁচলের গোছায় কয়েকটা চাবি ঝনাৎ শব্দ করতো, স্যুটকেসের চাবিটা
নিশ্চয়ই ওখানে দেখি নি।
মা যখন ভাঙা স্যুটকেসটা নামাতো, ওটা খুব ঝনঝন বা ঠনঠন শব্দ করতো।
মাঝে মাঝেই মাকে দেখতাম স্যুটকেস নামিয়ে
তা থেকে শাড়িটা বের করতো, আর মলিন মুখে তা পরতো। শাড়ি পরে আমার মা
কোথাও বেড়াতে না গিয়ে রসুই ঘরে ঢুকতো রান্না করতে, কিংবা ধান ভানতে,
কিংবা রাস্তার ওপার হতে নাড়ার আঁটি এনে গুছিয়ে রাখতো দুয়ারে।
তারপর বাবা যেদিন মেঘুলা বাজার থেকে একটা নতুন কাপড় কিনে আনতো
মায়ের জন্য, মা তার পরনের শাড়িটি খুলে, বহু যত্নে ভাঁজ করে ভাঙা স্যুটকেসের
ভিতর সাজিয়ে রাখতো। শৈশব হতে শুরু করে আমার ১৩-১৪ বছর বয়সে মায়ের
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে শাড়িটি পরতে দেখেছি।
মা আমাকে প্রায়ই বলতো, 'আমার এই শাড়িড্যা তর বউরে দিমু।' মায়ের বালা,
চুড়িগুলোও কোনো একদিন আমার বউয়ের হবে, মা বলতো।
আমি পরিবারের বড় ছেলে, এজন্য এটাই নিয়ম।
আমরা সে-সময় অতিশয় গরীব ছিলাম। আমার বাবা ছিল একজন দরিদ্র চাষা,
যার নিজের কোনো জমি ছিল না; আমার মা সেই দরিদ্র চাষার আহ্লাদী
ও লক্ষ্মী স্ত্রী ছিল, যাকে পরনের কাপড়ের অভাবে প্রায়ই তুলে-রাখা
শাড়ি পরতে হতো। আমরা অতিশয় গরীব ছিলাম, আর আমার বাবা ও
মায়ের ছিল দুরবিন চোখ- তার সন্তানেরা ভবিষ্যত পালটে দেবে।
৩০ কি ৩২ বছর পেরিয়ে গেছে। মায়ের ভাঙা স্যুটকেসটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে, জানি না। পাতাবাহারের ছাপাঅলা লাল শাড়িটা আমার চোখে এখনো দিব্যি ভাসে।
ওটার খবরও জানি না।
কাববোর্ডের ভিতর থকে থকে সাজানো স্ত্রীর শাড়িগুলোর দিকে তাকাই-
অকস্মাৎ বেহেশ্ত হতে নেমে এসে আমার মা যদি এগুলো দেখতে পেতো,
আনন্দে অজ্ঞান না হয়ে সে যেতোই না- তার গরীবের ঘরে আজ কী
সুন্দর সুন্দর চাঁদ ফুটেছে, একঝাঁক নাতি-নাতনি, যারা জানে না
তার দাদিমা একদিন কত্তো গরীব ছিল, যাকে পরনের কাপড়ের অভাবে
প্রায়ই তুলে-রাখা শাড়ি পরতে হতো।
সর্বত্র আমার মা :
অন্বেষা Click This Link
শৈশবের দুঃখগুলো Click This Link
মাকে আমার পড়ে মনে Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৩৬