somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের ক্লাসমেট শাহজাহানের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া এবং সোহানীর ইলিশ মাছ ধরা

০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা তখন নিউ টেনে পড়ি, অর্থাৎ, দশম শ্রেণিতে উঠেছি, কিন্তু তখনো এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় নি বলে আমাদের ক্লাসকে নিউ টেন বলা হয়।
স্কুলে ধুমাইয়া স্পোর্টসের প্র্যাক্টিস হচ্ছে। ক্লাস শুরু হয় ১১টায়, কিন্তু আমরা পারি তো ভোরে উঠেই স্কুলে গিয়া মাঠ দখল করি।
আমাদের বজলু ছিল লং জাম্প, হাই জাম্প আর ট্রিপল জাম্মে মাস্টার। আহসান আর আলীও। আহমেদ জীএস ভাই হলো শট পুটের চিরস্থায়ী চ্যাম্পিয়ন। মান্নানকে ঐ বছরই আবিষ্কার করি জ্যাভলিন থ্রোয়ার হিসাবে।

আমি কোন কোন ইভেন্টে ওস্তাদ ছিলাম বলবো না, দেখি আন্দাজ করে কমেন্টে কেউ কিছু লিখে কিনা।
তো যেদিন অ্যানোয়াল স্পোর্টস হলো, তার পরের দিন নিয়মানুযায়ী ছুটি ঘোষণা করা হলো। ঐ সময়ে আমরা এতটাই স্কুলপাগল হইয়া গেছিলাম যে, স্কুল ছুটি হওয়ার পর মন বেদনার ভারে আক্রান্ত হইয়া উঠতো। এর কারণটা বলে রাখা ভালো- আগের বছর পর্যন্ত মেয়েরা শুধু ক্লাসের সময় স্যারদের পিছে-পিছে ক্লাসে আসতো, ক্লাস শেষে স্যারদের আগে-আগে ক্লাস থেকে বের হয়ে কমন রুমে চলে যেত। এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জার জনক ও অপমানের জনক ছিল। এর বিরুদ্ধে আমাদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল; বিশেষ করে ক্লাস ক্যাপ্টেন শাহজাহান মিয়া শুরু থেকেই এটার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে আসছিল। ক্লাস টেনে ওঠার পর আমরা বেশ কয়েকবার শাহজাহানকে নিয়া সংলাপে বসলাম। আমরণ অনশনে যাব কিনা তা নিয়াও চিন্তাভাবনা করলাম। তারপর সবাই মিলে শক্ত একটা প্রতিবাদের লিপি লিখলাম। তাতে স্কুলের সকল ছাত্রের স্বাক্ষর গ্রহণ করলাম; আমাদের এ আন্দোলনে বেশ কয়েকটা মেয়ে আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলো। ফলে আমাদের শক্তি অনেক গুণ বেড়ে গেলো। শাহজাহান হেড স্যারের কাছে গিয়া প্রতিবাদের লিপিটা জমা দিয়া আসলো। ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবেই আমাদের পক্ষে এলো। ব্যাপারটা বুঝলেন তো! মেয়েরা তার পর থেকে কমন রুমে যাওয়া থেকে নিস্কৃতি পাইল। এখন ব্যাপারটা বুঝছেন তো কেন আমরা স্কুলে যাওয়ার জন্য এত পাগল ছিলাম? আমাদের আসলে বাসায় মন টিকতো না। মাত্র বছরখানেক পর স্কুল শেষ করে কে কোথায় চলে যাব, আমাদের ক্লাসমেট মেয়েগুলো বেছে বেছে বড়ো ভাইদের বিয়ে করবে, আমরা পথের এতিম হয়ে যাব। এই একবছর কাল যত বেশি ওদের সাথে সময় কাটানো যায়, ততই ভালো। এটা মিস করা যায় না। কেন যে ২৪/৭ নিয়মে ক্লাস হয় না- আমরা এ নিয়ে গভীর চিন্তার ভেতর মগ্ন হইয়া যাইতাম।

অ্যানোয়াল স্পোর্টসের পরের দিন, অর্থাৎ ছুটির দিন শাহজাহান মিয়া আমাদের সবাইকে ওদের বাড়িতে দাওয়াত দিল। ওদের বাড়ির পাশেই পদ্মা নদী। পদ্মা নদী দেখার আশায় শায়মা আর জুলিয়া লাফাইয়া উঠলো। আমরা বেশ কয়েকজন পদ্মায় সাঁতরানোর জন্য নেংটি নিয়া যাওয়ার প্লান করলাম।
করিম আর আবু তালেব আগেই শাহজাহান মিয়াদের বাড়িতে গেছে। ডিসিশন হলো, আমরা শুরুতে স্কুলের মাঠে জড়ো হবো। সেখান থেকে একযোগে করিম আর আবুতালেবের নেতৃত্বে শাহজাহানদের বাড়ি যাব। স্টার্ট টাইম সকাল ১০টা।

আমরা মোটে ২৩ জন ছেলেমেয়ে হাজির হলাম। মেয়েদের মধ্যে সোহানী, শমী কায়সার আর চম্পা এসেছে। ছেলেদের মধ্যে বেশি উৎসাহ ছিল জামাল আর অনন্ত জলিলের- ওরা আসে নাই। সোহানী এসে অনুপস্থিত ছেলেগুলোরে একচাপা ‘দামড়া’ বলতে লাগলো। অনুপস্থিত মেয়েগুলোরে কী বলা যায়, এইটা নিয়া আমি ভেবে ভেবে কোনো শব্দ না পাওয়ায় একা একাই চুপ মাইরা থাকলাম।

রাজীব আর মাসুদ মেঘুলা বাজার থেকে ১০ কেজি রসগোল্লা নিয়া হাজির। আমি আবার রসগোল্লা খুব বেশি পছন্দ করি। এক ফাঁকে ঐখান থেকে গপাগপ কয়েকটা সাবাড় করে দিলাম।
আমরা যথাসময়ে শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড। আমাদের যাওয়ার খবর শুনে ওর বাবা ওদের একটা তিন-সনী লাল ষাঁড় জবাই করেছেন। কচি ষাঁড়- পাক্কা ২ মণ ৪৩ সের মাংস হয়েছে। পুকুর থেকে আইর, কাতল, আর কোরাল মাছ ধরেছেন। এখানেই শেষ না, শাহজাহানের শ্বশুর-শাশুড়ি, ৪ শ্যালক আর ৫ শ্যালিকাও ওদের বাড়িতে এসেছেন। বাহির বাড়িতে মাটি খুঁড়ে লম্বা চুলা বানাইছে, বিরাট বিরাট ডেকচিতে রান্নাবান্না হচ্ছে। খাবারের গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করা শুরু করলো।
শাহজাহানের বউ এসে আমাদের ধমকানো শুরু করলো- এই, তোমাদের না সকালে আসার কথা ছিল, এই দুপুরবেলা তোমাগো কেডা আসতে কইছিল? এখন কি সকালের নাস্তা খাইবা, নাকি দুপুরের গোশত-পোলাও খাইবা? যত্তসব ফাজিলের দল। ইচ্ছা করে সবগুলার টেংরি ভাইংগা ফালাই।
কীসের খাওয়া খাওয়ি। আমরা সদলবলে পদ্মার পাড়ে চইলা গেলাম। মাত্র দেড়শ গজ দূরে পদ্মা। হা রে রে রে করে জোরসে দৌড় দিলাম, কেউ কেউ পোশাক না পাল্টেই পানিতে ঝাঁপ দিল। আমরা পানিতে দাপাদাপি করতেছি, এমন সময়ে দেখি মেয়েগুলো নদীতে বড়শি ফেলে মাছ ধরছে।
আমার বড়শিতে মাছ ধরার খুব শখ। আমি পানি থেকে উঠে এসে একজনের বড়শি কেড়ে নিলাম। দেখাদেখি হাবিব আর হাসানও এলো। পরে আরো কয়েকজনে এসে যোগ দিল।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বড়শি দিয়া বেশকিছু চিংড়ি, খল্লা আর বাইম মাছ ধরা হলো। এমন সময় সোহানী চিৎকার দিয়া উঠলো- ঐ আমার বড়শি টাইন্যা নিয়া যাইতেছে রে- তোরা ধর আমারে- ধর। আমরা আগাইয়া যাইয়া ওর ছিপ ধরে ফেলি। হাবিবের গায়ে শক্তি সবচাইতে বেশি। দেখি কী, আমাদের সবাইকে সহ ছিপ টাইন্ন্যা নিয়া যাইতে চায়। হালার কুমির না তো! আমার ভয় করলো। আস্তে আস্তে আমরা বড়শি টানছি। খুব শক্ত, আসতে চায় না। বড়শি কাছাকাছি হতেই দেখলাম পানির সামান্য নীচে রুপালি রঙের বিরাট একটা মাছ উঠে আসছে। ছিপ উঁচু করতেই দেখি প্রায় চার-পাঁচ কেজি ওজনের এক ইলিশ মাছ বড়শিতে লাফাইতেছে। আনন্দে আমরা চিৎকার করে উঠলাম। জীবনে এই প্রথম বড়শিতে ইলিশ মাছ ধরলাম। আমার মনে হয় এটা একটা জাতীয় রেকর্ডও হতে পারে। সাথে সাথে সোহানী ওটা ফেইসবুকে শেয়ার করলো; তাতে যতগুলো লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার হলো, সেটাও পৃথিবীর ইতিহাসে একটা জাতীয় রেকর্ড হবার কথা।

এই ইলিশ মাছ জবাই করা হলো। ভেতরে বোঝাই করা ডিম। কিছু ডিম ফুটে অলরেডি ইলিশের পোনা লাফালাফি করতেছিল। শাহজাহানের বউ কলুই শাক আর ঢেঁড়স দিয়ে সেই ইলিশ মাছ রান্না করলো। রান্নাটা এতই মজাদার হইছিল যে, দীর্ঘ ৩৫ বছর পরও মনে হচ্ছে এখনো হাতের তালুতে ইলিশ মাছের তেল লেগে আছে- বাকিদের খবর জানি না, আমি আজো বুড়ো আঙুলে তুড়ি বাজাতে পারি না।

সেদিনের দুপুরে যে আনন্দ হইছিল তা বলার মতো না। নানান পদের রান্না খেয়ে, বিশেষ করে পোলাও আর খাসির গোশত খেয়ে আমাদের নয়ন ভরে গেছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমরা শাহজাহানদের উঠোনে সবাইকে নিয়ে একটা গ্রুপ ছবি তুললাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গ্রুপ ছবিতে আমার চেহারা ঢাকা পড়ে গেছিল- কারণ, শাহজাহানের এক শ্যালিকা আমার সামনে দাঁড়ানো ছিল।

স্কুলজীবনে বন্ধু শাহজাহানের বাসায় বেড়ানোর এই কাহিনি আমার মানসপটে এখনো পরিষ্কারভাবে জ্বলজ্বল করিতেছে। আমাদের সেই ক্লাসমেটরা আজ পৃথিবীর নানান জায়গায় সেলিব্রেটি হিসাবে শীর্ষস্থান দখল করে দাঁড়াইয়া আছে। কেউ-বা বাংলার বিখ্যাত চিত্রনায়ক বা নায়িকা, কেউ-বা আবার বিখ্যাত সেলিব্রেটি ব্লগার। তাদের সবার জন্য রহিল ফুলেল শুভেচ্ছা।

৩০ মার্চ ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:১৯
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×