একদা ছিল এক গায়িকা। সে দেখতে সুন্দর ছিল না। কিন্তু তার গলায় ছিল অমর্ত্যের গান। সে গানে সারা পৃথিবী দুলতো। ভোরের পাখিরা তার ঘরের বাগানে এসে ভিড় করতো, বাতাস থেমে যেত। নদীরা স্থির হয়ে থাকতো তার গান শোনার জন্য।
তার নামডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে একদিন কিছু লোক এসে তাকে শহরে নিয়ে গেল। বিরাট হলঘরে মানুষ থৈথৈ করছে। ঝলমলে আলোতে চোখ ঝলসে যায়। গায়িকাকে মঞ্চে উঠানো হলো। সে গান ধরলো। কিন্তু মানুষের উল্লাস আর উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকলো। মানুষের মন উতলা হলো না। আসর জমলো না।
শহুরে লোকগুলো তবু থামলো না। আরেকদিন অনেক বড়ো এক খোলা ময়দানে তারা গানের আয়োজন করলো। বহু ডাকসাঁইটে শিল্পীরা গান গাইল। গাইল না, বলা চলে তারা নাচলো। শরীর দোলালো। কোমর দোলালো। গলা ফাটালো। চিৎকার করলো। লাফালাফি করলো। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে দর্শকরা মুগ্ধ ও উন্মাতাল হলো। আনন্দ উথলে উঠলো আকাশে বাতাসে। সবশেষে আমাদের গায়িকাকে মঞ্চে তোলা হলো। মেয়েটা খুব সাধাসিধে ছিল। সে জানতো না কীভাবে শরীরের কসরৎ দেখিয়ে দর্শকহৃদয়ে দোলা দিতে হয়। সে শুধু জানতো দু চোখ আধো-নিমীলিত করে নিগূঢ় কণ্ঠে সুর তুলতে। সে গান ধরলো। স্থির দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে সে একমনে গান গাইতে থাকলো। কিন্তু এবারও দর্শকরা সাড়া দিল না। তাদের মন ভরলো না মোটেও। কোনো উত্তেজনার ঢেউ নেই কোথাও। সবকিছু নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তারা একসময় জেগে উঠলো এবং ‘হিন্দি চাই হিন্দি চাই’ বলে তুমুল শোরগোল করলো।
আয়োজকরা বিমর্ষ হলো। তারা খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে বলেই ফেললো, ‘আপনি দেখতে সত্যিই একটা ‘ক্ষ্যাত’। আপনি কিচ্ছু কি বোঝেন না?’ এটা গায়িকাকে খুব আহত করলো। তার রূপ নাই সে জানে। সে চটপটে, সপ্রতিভ নয়, তাও সে জানে। সে আরো জানে, তার মোহনীয় অঙ্গসৌষ্ঠব নেই, যা মানুষের নজর কাড়ে। কিন্তু সে জানে তার একটা কণ্ঠ আছে, যা খুব মন্দ নয়; এ ব্যাপারে সে খুব আত্মবিশ্বাসী। সে নীরবে মাথা নীচু করে মঞ্চ থেকে নেমে গেল।
গায়িকা তার প্রিয় জন্মগ্রামে চলে এলো। সে আর শহরের মঞ্চে যায় না। কীজন্য তাকে আলোর শহরে নেয়া হয়েছিল, সে রহস্য সে জানে না। সে গায় মাটির গান। তার মাটির শরীরের প্রতিটি পরতে মাটির সুর গেঁথে আছে। এ সুরে মাটির হৃদয় দোলে। এ সুরে মাটির মানুষ দোলে। যাদের জন্য সে মঞ্চে উঠেছিল, তারা কেউ মাটির মানুষ ছিল কি?
জন্মভিটায় বসে নীরবে গায়িকা কাঁদে। নিরবধি কাঁদে। তার গলা খুব উচ্চমার্গীয় নয়, এ নিয়ে তাকে গালমন্দ করলে তার খুব কষ্ট হবার ছিল না। কিন্তু সে দেখতে একটা ক্ষ্যাত, সে চৌকষ বা সুদর্শনা নয়- এটা তাকে খুব আহত করলো। পৃথিবীতে সুরের কি সত্যিই কোনো মূল্য নেই? শরীরের ঝকমকিই কি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু? সে নিজে কোনোদিন রূপের কাঙাল ছিল না, ছিল সুরের কাঙাল। সে চায় সুর। সে চায় গান। তার কাছে গানই হলো সব সুন্দরের আধার।
গায়িকা কাঁদে। নীরবে গুমরে কাঁদে। সৃষ্টিকর্তা তাকে রূপ দেন নি – সেজন্য সে কাঁদে না, সে কাঁদে মানুষ কেন বোঝে না এই রূপ তার নিজের ইচ্ছেতে হয় নি। নিজের ইচ্ছেমতো রূপ সৃষ্টি করা গেলে এই পৃথিবীতে রূপের জন্য কোনো হাহাকার হতো না।
আরো সে কাঁদে এজন্য যে, মানুষের কাছে সুরের কোনো কদর নেই, শরীরের সম্ভারই মানুষের মূল্যবান সম্পদ, যা তাকে সবার কাছে দামি ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
গায়িকা কাঁদে; নিভৃতে তার হৃদয় পুড়ে যায়, কুরে কুরে ক্ষয় হয়।
কিন্তু আদতে সে কাঁদে না। তার কণ্ঠে নিঃসৃত হয় করুণ সঘন সুর। সেই সুরে নদীর কান্না গর্জন করে ওঠে। পাখিরা কূজন ভুলে গিয়ে তার বাড়ির চারপাশে এসে গাছে গাছে ডালে ডালে ভিড় করে বসে। তারা তন্ময় হয়ে শোনে - গায়িকার অন্তরক্ষয়ী গানের মূর্ছনায় সারা পৃথিবী দুলছে। পৃথিবীটা যেন একটা বেহেশতখানা। শুধু সুর আর সুর, যার গভীরে রূপের কোনো অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো বাহ্যিক চাকচিক্য। সেখানে এই সুরটাই হলো সমগ্র সৌন্দর্য্যের মূল রহস্য।
০২ মার্চ ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০২০ রাত ১০:৪১