somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রেম

০১ লা জুলাই, ২০২০ রাত ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় বছর খানেক হলো এমনটা হচ্ছে। রাহেলা বেগম বেঞ্চটায় বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই উলটো দিক থেকে লোকটা এসে বসেন। বসার সময় খুব স্বাভাবিক ভাবে রাহেলা বেগমের দিকে তাকান, মুখে সৌজন্যে ভরা খুব আলতো করে একটু হাসি দিয়েই সামনে দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকেন। রাহেলা বেগম জানেন লোকটা আসবেন, এজন্য তিনি বেঞ্চির একমাথায় বসেন।
অচেনা একটা পুরুষ মানুষ, মাত্র ছয় ফুটের একটা বেঞ্চিতে এভাবে বসে পড়ায় রাহেলা বেগম বেশ বিব্রত হন। তবে, তিনিও সৌজন্যবশত লোকটার হাসির বিপরীত প্রচ্ছন্ন একটা হাসির জবাব দিয়েই মাটির দিকে তাকান, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখেন, ছাতার বাট নাড়াচাড়া করেন।

সরু পায়ে-হাঁটা একটা রাস্তা উত্তর গ্রামের মাঝখান থেকে শুরু হয়ে ধূ-ধূ প্রান্তরের বুকের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণ গ্রামের মাঝখানে গিয়ে পড়েছে। এক গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ের দিকে তাকালে মধ্যিখানে ধুলোর কুয়াশায় চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে।

এই বিরাণ চকের মাঝখানে কে, কবে একজোড়া আমগাছ লাগিয়েছিল, তা কারো জানা নেই। সেই অজানা কালের চারাগাছ দুটো গলাগলি ধরে বড়ো হয়ে আজ বটগাছের-প্রায় ঝুঁপড়ি আকার ধারণ করেছে। গাছের পেছন দিকটা জুড়ে আরো কিছু ছোটোজাতের গাছ ও লতাগুল্ম বেড়ে ওঠায় দূর থেকে ছোটো বনবাদাড়ের মতো মনে হয়।
গাছের ছায়ায় একধারে একটা বাঁশের বেঞ্চি। বেঞ্চিটাও অনেক পুরোনো।

উত্তর গ্রামের রাহেলা বেগম দক্ষিণ গ্রামের একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আগে জারুল গাঁয়ে ছিলেন; অবসর গ্রহণের আগে বিশেষ বিবেচনায় বছর দেড়েক হলো বাড়ির নিকটতম স্কুলে বদলি এসেছেন।
সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে এ বেঞ্চিটির পাশ দিয়ে হেঁটে যান, কখনো জিরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। কিন্তু, স্কুল ছুটির পর দক্ষিণ গ্রামের শুরুতে এ রাস্তায় পা ফেলতেই যেন মাঝপ্রান্তরের বাঁশের বেঞ্চিটি তাকে ডাকতে থাকে; ক্লান্ত শরীরে পা টানতে টানতে বেঞ্চিটার কাছে এসেই হাতের ছাতাটি নিভিয়ে ধপ করে বসে পড়েন। ছায়ার নীচে নেচে চলা বাতাসে তার প্রাণ জুড়িয়ে যেতে থাকে। একপ্রস্থ জিরিয়ে নেয়ার পর উঠে দাঁড়ান, মনে হয় শরীরে বেশ শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে; নতুন উদ্যমে একহাঁটায় বাড়িতে পৌঁছে যান।

যেদিন থেকে পুরুষ লোকটাও তার ফেরার পথে শ্রান্তি নিবারণে ভাগ বসাতে শুরু করলেন, সেদিন থেকে তার অস্বস্তি হতে থাকলো। চেনাপরিচিত কেউ হলে হয়ত একদণ্ড কথা বলা যেত, সঙ্কোচ থাকতো না। ৬ ফুটের বেঞ্চির দু মাথায় দুজন অপরিচিত মানব-মানবী প্রায় মূর্তির মতো কতক্ষণ বসে থাকতে পারেন? এই অস্বস্তির কারণে অনেক সময় রাহেলা বেগম শ্রান্তি পুরোপুরি দূর হওয়ার আগেই উঠে নিঃশব্দে লোকটার সামনে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন।

মাঝে মাঝে রাহেলা বেগম অবশ্য ভাবেন, লোকটা কে, কোথায় থাকেন, কোথায় যান, অন্তত এ কথাগুলো জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। কিন্তু লোকটা খুব নির্বিকার, কোনোরূপ আলাপচারিতার জন্য তার একবিন্দু আগ্রহ বোঝা যায় নি। যে-যুগে নারীরা যেচে পুরুষের সাথে কথা বলতে পারেন, রাহেলা বেগম একজন শিক্ষিকা হয়েও তিনি নিজেকে সে-যুগের মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারেন নি। এজন্য, একজন অপরিচিত পুরুষ মানুষের সামনে তিনি এত অস্বস্তি বোধ করেন। তার দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়, কিন্তু তার মুখ ফোটে না।
বেঞ্চিতে বসার সময়ে লোকটার সৌজন্যমূলক হাসি, তারপর দূরে তাকিয়ে থাকা, এ ছবিটা রাহেলা বেগমের মুখস্থ হয়ে গেছে। লোকটা কে? লোকটা তার উত্তর গ্রাম থেকেই আসেন; চলে যান দক্ষিণ গ্রামে, যে-গ্রামে তিনি শিক্ষকতা করেন। লোকটার ব্যাপারে কারো সাথে আলাপ করবেন, এটা তার ব্যক্তিত্বে মানায় না বলে তিনি ভাবেন।

যে-কাকতালীয় ব্যাপারটায় রাহেলা বেগম অবাক হন সবচাইতে বেশি তা হলো, বেঞ্চিতে বসার কিছুপরই উত্তর দিকের গাছের আড়াল থেকে হেঁটে আসতে দেখেন লোকটাকে; তার অল্প পরেই যথাস্বভাবে বেঞ্চিতে বসে পড়েন তিনি। রাহেলা বেগম জানেন, লোকটা আসবেন। এজন্য তিনি রাস্তায় নেমেই মাঝে মাঝে উত্তর দিকে তাকান, কখনো আনমনে কখনো ইচ্ছে করে। কদাচিৎ দেখা গেছে লোকটা আসছেন।

একদিন লোকটা এলেন না। রাহেলা বেগম অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশি সময় নিয়ে জিরোলেন। তার স্বস্তি বোধ হলো খুব। পুরুষ লোকটার সামনে তিনি নড়াচড়াও তেমন করতেন না; বাতাসে আঁচল উড়ে যায়, এ ভয়েও তটস্থ থাকতেন। খুব ভালো লাগলো তার।
পরের দিনও লোকটা এলেন না। এদিনও খুব নির্বিঘ্নে আগের দিনের মতোই পর্যাপ্ত সময় নিয়ে জিরোলেন রাহেলা বেগম। কিন্তু তিনি একটু অবাকও হলেন- ব্যাপার কী? প্রথম যেদিন লোকটাকে দেখেছিলেন, তারপর থেকে একদিনের জন্যও লোকটা অনুপস্থিত ছিলেন না। অথচ আজ দুদিন ধরে তাকে দেখছি না। ব্যাপারটা কী?

তৃতীয় দিন? বেঞ্চিতে বসার পর উত্তর দিকে বার বার তাকিয়ে থাকলেন রাহেলা বেগম, কিন্তু লোকটা এলেন না। তার মন আনচান করতে থাকে, হায়, লোকটার কিছু হলো না তো?

আজ ৭দিন ধরে লোকটা নেই! কী হলো লোকটার? অসুখ করে নি তো? তাকে যতটুকু দেখা গেছে, কখনো অসুস্থ মনে হয় নি। বয়স হয়েছে যদিও, যদিও দেখা গেছে রাহেলা বেগমের মতো তার মাথায়ও কিছু পাকা চুল আছে, কিন্তু সুস্থ সুঠাম দেহের অধিকারীই মনে হয়েছে লোকটাকে। নাহ্‌, কোনো দুর্ভাবনাকে মনের মধ্যে ঠাঁই দিতে চান না রাহেলা বেগম।

রাহেলা বেগম অস্থির হয়ে গেলেন। গত একটি বছর ধরে যাকে প্রতিদিন একইভাবে দেখে আসছিলেন, যার অনুপস্থিতিতে তার ছবিটা আরো জীবন্ত ও প্রাণবন্ত ও মায়াময় হয়ে উঠছে, তাকে গত দু সপ্তাহ ধরে দেখতে পাচ্ছেন না। লোকটা কোথায় হারিয়ে গেলেন?
খুব অস্থির লাগছে তার। লোকটার প্রতি তার এত মায়া জন্মে গেছে, তিনি আগে বুঝতে পারেন নি। তার বুক ফেটে যেতে চাইছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভাবতে ভাবতে তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরতে থাকলো। এ অচেনা লোকটার জন্য এত অশ্রু কেন? তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
‘কেমন আছেন?’ চমকে চোখ খুলে শব্দের উৎসের দিকে ডানে তাকান রাহেলা বেগম। লোকটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে তার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসছেন।
রাহেলা বেগমের চোখ দিয়ে যেন আরো দ্রুতবেগে বন্যা নামতে শুরু করলো। তিনি বুকভাঙা আর্তস্বরে শুধু এটুকুই জিজ্ঞাসা করতে পারলেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন? আপনি ভালো আছেন তো?’

৩০ জুন ২০২০

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ রাত ১২:২৬
৪৮টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×